রবীন্দ্রনাথের 'পিতামহ' ও 'পিতৃদেব'

দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪—১ আগস্ট ১৮৪৬)
দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪—১ আগস্ট ১৮৪৬)
>গতকাল ছিল রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের মৃত্যুবার্ষিকী। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির বৈভব ও প্রতিপত্তির প্রধান উৎস ছিলেন দ্বারকানাথ। কিন্তু তিনিই হয়েছেন বিস্মরণের শিকার। এমনকি রবীন্দ্রনাথও তাঁর সম্পর্কে তেমন কিছু লেখেননি। কেন?

পুরো সাহিত্যিক জীবনে পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ প্রায় নীরব। তবে বিভিন্নজনের লেখায় দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের পরস্পর সম্পর্কে মনোভাবের কিছু খণ্ডচিত্র পাওয়া যায়।

আগামী মঙ্গলবার রবীন্দ্রনাথের ৭৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। আর গতকাল ছিল দ্বারকানাথের ১৭৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৮৪৬ সালের ১ আগস্ট যুক্তরাজ্যের লন্ডনে দ্বিতীয় বিলেতযাত্রায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এই বিশেষ সময়ে ঠাকুর পরিবারের তিন পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের আভাস পেতে চাইছি।

সুবিশাল রচনাবলীতে পিতামহ দ্বারকানাথ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কিছুই বলেননি, এমনটাও নয়। ঠারেঠোরে দ্বারকানাথের প্রসঙ্গ এসেছে তাঁর গুটিকয় রচনায়। সেগুলো বিশ্লেষণ করলে পিতামহ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের জানাশোনা ঠিক কেমন ছিল, তার কিছু আন্দাজ পাওয়া যায়।

দ্বারকানাথ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ সরাসরি প্রথম কথা বলেছিলেন পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন প্রায় ৪৪। ১৯০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি (৬ মাঘ ১৩১১) মারা যান দেবেন্দ্রনাথ। মৃত্যুর পর প্রথম শ্রাদ্ধের দিন রবীন্দ্রনাথ পিতা সম্পর্কে কিছু কথা বলেছিলেন। বক্তৃতার সংকলন চারিত্রপূজায় এর শিরোনাম ‘মহর্ষির আদ্যকৃত্য উপলক্ষে প্রার্থনা’।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আজ প্রায় পঞ্চাশ বৎসর অতীত হইল, আমাদের পিতামহের মৃত্যুর পরে এই গৃহের উপরে সহসা ঋণরাশি ভারাক্রান্ত কী দুর্দিনে উপস্থিত হইয়াছিল তাহা সকলে জানেন...কতকাল ধরিয়া তাঁহাকে (দেবেন্দ্রনাথ) কী দুঃখ, কী চিন্তা, কী চেষ্টা, কী দশাবিপর্যয়ের মধ্য দিয়া প্রতিদিন প্রতিরাত্রি যাপন করিতে হইয়াছে, তাহা মনে করিতে গেলে শরীর কণ্টকিত হয়। তিনি অতুল বৈভবের মধ্যে লালিতপালিত হইয়াছিলেন—অকস্মাৎ ভাগ্যপরিবর্তনের সম্মুখে কেমন করিয়া তিনি অবিচলিত বীর্যের সহিত দণ্ডায়মান হইলেন!’

দেখা যাচ্ছে, পিতার মহানুভবতার কথা স্মরণ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ পিতামহের প্রসঙ্গ টানছেন। লন্ডনে দ্বারকানাথের হঠাৎ মৃত্যুর পর তাঁর সন্তানেরা, বিশেষত দেবেন্দ্রনাথ, ‘ঋণসমুদ্রে’ পড়েছিলেন।

১০ বছর পর পিতামহ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের পরের বক্তব্য আমরা পাই একটি চিঠিতে। ১৩২১ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে ভবসিন্ধু দত্ত রচিত মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনচরিত প্রকাশিত হয়। সে মাসেরই ২৩ তারিখে প্রবাসী পত্রিকার সহসম্পাদক লেখক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘ভবসিন্ধুবাবু পিতৃদেবের যে জীবনী লিখেছেন তার মধ্যে একটি গল্প আছে যে আমি দ্বারকানাথ ঠাকুরের কোন ঘর আমার ইচ্ছামত ভাঙচুর করাতে পিতৃদেব প্রথমে আমাকে ভর্ৎসনা করেন তারপরে আমার অকীর্ত্তি সংশোধন করে দেন, তারপরে আমাকে বাস করবার জন্যে নূতন বাড়ি দেন। যখন সমালোচনা করবে তখন পাঠকদের বোলো আমার নূতন বাড়ির ভিত্তি এই ঘটনার ভিত্তির উপর স্থাপিত নয়। তার প্রধান কারণ আমি দ্বারকানাথ ঠাকুরের কোনো কিছুই ভাঙিনি, যা কিছু ক্ষণভঙ্গুর তা তিনি নিজেই একরকম ভেঙে শেষ করে গেছেন, উত্তরবংশীয়ের জন্যে অপেক্ষা করেননি।’

এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে পরে প্রবাসীর ফাল্গুন সংখ্যায় ভবসিন্ধু দত্তের বইয়ের সমালোচনার নিচে রবীন্দ্রনাথের কথার অনুসরণে একটি সম্পাদকীয় মন্তব্যও ছাপা হয়।

দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ পিতামহ দ্বারকানাথ প্রসঙ্গে সদর্থক কিছু বলছেন না। রবীন্দ্রনাথ ও দ্বারকানাথ দুজনেরই জীবনীকার ছিলেন কৃষ্ণ কৃপালনী। আত্মীয়তার সূত্রে তিনি ঠাকুর পরিবারের সদস্য (রবীন্দ্রনাথের দৌহিত্রী নন্দিতার স্বামী)। পিতামহের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা তাঁকেও অবাক করেছে।

এদিকে দেবেন্দ্রনাথ-পৌত্র ক্ষিতীন্দ্রনাথ (হেমেন্দ্রনাথ-পুত্র) দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনীতে লিখছেন, দ্বারকানাথ প্রতিষ্ঠিত ‘কার ঠাকুর কোম্পানি’র কাগজপত্র রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে পুড়িয়ে ফেলা হয়। একই রকম অভিযোগ দেবেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধেও আছে।

কৃপালনী প্রশ্ন তুলেছেন, ‘তিনি (দ্বারকানাথ) কেন অবজ্ঞাত উপেক্ষিত হয়ে রইলেন? এই বিস্মৃতপ্রায় লোকটি কি তবে কুলে কালি দিয়েছিলেন বলে পরিবারের কেউ তাঁর নাম উচ্চারণ করে না? যে-লোকটি তাঁর জীবিতকালে এত লোকের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন, মৃত্যুর পর তাঁকে এত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হলো কেন?’

মাত্র ৫১ বছর বয়সে হঠাৎ মৃত্যুর পর প্রিন্স দ্বারকানাথের ভাবমূর্তি দাঁড়িয়েছিল উড়নচণ্ডী, অপব্যয়ী, ভোগবিলাসে মত্ত এক পুরুষ হিসেবে। কৃষ্ণ কৃপালনী লিখেছেন, ‘ঠাকুর-পরিবারের লোকেদের মুখে কিংবা বহুকাল শান্তিনিকেতন থেকেও আমি তো এঁর (দ্বারকানাথ) নাম বড় একটা শুনিনি।’ তাই হয়তো বইয়ের নাম দিয়েছিলেন দ্বারকানাথ টেগোর: আ ফরগটেন পাইওনিয়ার: আ লাইফ

দ্বারকানাথের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির পেছনে বাইরের মানুষের চেয়েও পরিবারের লোকদের, বিশেষত পুত্র দেবেন্দ্রনাথের ভূমিকা ছিল। দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত কার ঠাকুর কোম্পানির পতন হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আত্মজীবনীতে দেবেন্দ্রনাথ সখেদে লিখেছেন, ‘কল্য কি খাইব, কি পরিব, তাহার আর ভাবনা নাই। কাল এ বাড়িতে থাকিব, কি, এ বাড়ি ছাড়িতে হইবে, তাহার ভাবনা নাই। একেবারে নিষ্কাম হইলাম।’

দ্বারকানাথের মৃত্যুর প্রায় ১৫ বছর পর রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন। পিতামহকে সরাসরি জানা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। শৈশবে মাকে হারিয়ে বড় হয়েছেন পিতার প্রচণ্ড প্রভাবে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পিতার প্রভাব থেকে অনেকটা বেরিয়ে এলেও পিতামহ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মনোভাব পরিবর্তনের কোনো ইঙ্গিত মেলে না।

উত্তর লন্ডনের কেনসাল গ্রিন সেমেট্রিতে সমাহিত হয়েছিলেন দ্বারকানাথ। রবীন্দ্রনাথ অন্তত চারবার বিলেতযাত্রা করেছেন, একটিবারও ঠাকুরদার সমাধি দেখতে যাননি।

অথচ বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনোভাব ছিল ভিন্ন। অত্যন্ত মেধাবী সত্যেন্দ্রনাথ প্রথম ভারতীয় আইসিএস হন। বিলেতে প্রশিক্ষণ নিতে যান। দ্বারকানাথের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোতে সত্যেন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন। স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর স্মৃতিকথায় জানা যায়, তাঁদের অকালপ্রয়াত শিশুপুত্রকে সমাহিত করা হয় দ্বারকানাথের সমাধির পাশে।

১৮৪২ সালে সত্যেন্দ্রনাথের জন্ম। চার বছর পর দ্বারকানাথ মৃত্যুবরণ করেন। সত্যেন্দ্রনাথের মনে ঠাকুরদার কিছু স্মৃতি কি ছিল? নিজের বুদ্ধি ও আর্থিক স্বাধীনতা দিয়ে দ্বারকানাথের ব্যাপারে স্বতন্ত্র মূল্যায়ন করতে পেরেছিলেন তিনি?

এ ব্যাপারে সরাসরি কিছু জানা যায় না। ১৮৮২ সালে দ্বারকানাথের সমাধিতে গিয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। সঙ্গে ছিলেন সুহৃদ মনমোহন ঘোষ। দ্বারকানাথের সমাধির দুর্দশা দেখে দুজনেই ব্যথিত হন। ১৯ মে মনমোহন চিঠি লেখেন দেবেন্দ্রনাথের আরেক পুত্র জ্ঞানেন্দ্রনাথকে। ইংরেজি চিঠিতে মনমোহন লেখেন, মহর্ষি যদি চান খুব অল্প খরচেই দ্বারকানাথের সমাধির উন্নয়ন সম্ভব।

এর কোনো উত্তর দেবেন্দ্রনাথ দেননি। পিতা দ্বারকানাথের ব্যাপারে দেবেন্দ্রনাথের অবস্থান খুব স্পষ্ট নয়। আত্মজীবনীতে একদিকে তিনি পিতার ঋণসমুদ্রের কথা লিখে গেছেন, অন্যদিকে নিজেদের বিষয়বুদ্ধিহীনতার কথাও বলেছেন।

দেবেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমার পিতা ১৭৬৩ শকের পৌষ মাসে য়ুরোপে প্রথমবার যান। তখন তাহার হাতে হুগলী, পাবনা, রাজসাহী, কটক, মেদিনীপুর, রঙ্গপুর, ত্রিপুরা প্রভৃতি জেলার বৃহৎ বৃহৎ জমিদারি এবং নীলের কুঠী, সোরা, চিনি, চা প্রভৃতি বাণিজ্যের বিস্তৃত ব্যাপার। ইহার সঙ্গে আবার রাণীগঞ্জে কয়লার খনির কাজও চলিতেছে। তখন আমাদের সম্পদের মধ্যাহ্ন সময়। তাঁহার সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে তিনি বুঝিয়াছিলেন যে, ভবিষ্যতে এই সকল বৃহৎ কার্য্যের ভার আমাদের হাতে পড়িলে আমরা তাহা রক্ষা করিতে পারিব না।’

দেবেন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন, এ জন্য দ্বারকানাথ পৈতৃক দুটি ও নিজের অর্জিত দুটি জমিদারি ট্রাস্টের কাছে দিয়ে যান। দ্বারকানাথের তিন ছেলে এখান থেকে মাসে নির্দিষ্ট অর্থ পেতেন। দেবেন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘এই কার্য্যে আমাদের প্রতি তাঁহার স্নেহ ও সূক্ষ্ম ভবিষ্যৎ দৃষ্টি, উভয়ই প্রকাশ পাইয়াছে।’

দেবেন্দ্রনাথের এই লেখা থেকে দ্বারকানাথের বিশাল কর্মোদ্যোগের খানিকটা পরিচয় পাওয়া যায়। মাত্র ১৬ বছর বয়সে পৈতৃক দুটি জমিদারির ভার গ্রহণ করে তিনি খুব দ্রুত প্রচুর সম্পদ অর্জন করেছিলেন। আয়ের জন্য শুধু জমিদারির ওপর তিনি নির্ভর করেননি, আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করেছেন। পাশাপাশি আইন ব্যবসায় নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। এ ছাড়া দুই দফায় প্রায় ১২ বছর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে দেওয়ানি ও সেরেস্তাদারির চাকরি করেছেন।

দ্বারকানাথ যে পুত্র দেবেন্দ্রনাথের বিষয়বুদ্ধির ওপর তেমন আস্থা রাখতে পারেননি, সেটা মৃত্যুর মাস দুই আগে দেবেন্দ্রনাথকে লেখা তাঁর শেষ চিঠিতে স্পষ্ট। কমলেন্দু ধরের দ্বারকানাথ ঠাকুর: বাংলার শিল্প-বাণিজ্য বইয়ে চিঠিটি আছে।

২২ মে ১৮৪৬ সালে দ্বারকানাথ লিখেছেন, ‘অপরাপর জায়গা থেকে যে-সব খবরবার্তা ইতিমধ্যে আমি পেয়েছি এবং মি. গর্ডন তোমার আমলাদের বিষয়ে যা-কিছু লিখেছেন তা থেকে আমি এখন দৃঢ়নিশ্চিত এ-সব রিপোর্ট সত্য। আমার সমস্ত এস্টেটগুলি যে এখনো ছারেখারে যায়নি—এইটেই আশ্চর্য। আমি বেশ বুঝতে পারছি তোমার অধিকাংশ সময় ব্যয় হয় খবরকাগজের জন্য লিখে নতুবা মিশনারি সায়েবদের সঙ্গে ঝগড়া করে। অথচ তোমার উচিত ছিল বিষয়-আশয়ের এই সব জরুরী ব্যাপারের উপর সর্বদা নজর রাখা ও বিষয়-আশয় রক্ষা করা। যে-সব কাজ সতর্ক হয়ে তোমার নিজের করা উচিত ছিল, সেগুলি ফেলে রেখেছ তোমার সব পেয়ারের আমলাদের হাতে। দেশের জলহাওয়া ও গরমি সহ্য করার মতো আমার যদি শক্তি থাকত, তাহলে এতদ্দণ্ডে লন্ডন ছেড়ে আমি চলে যেতাম নিজের হাতে সবকিছু তত্ত্বাবধান করতে।’

শুধু বিষয়-আশয় রক্ষা করা নিয়ে পিতা-পুত্রের মধ্যে মনোমালিন্য ছিল, তা নয়। দেবেন্দ্রনাথের মা দিগম্বরী দেবীও এখানে বড় অনুঘটক বলে প্রতীয়মান হয়। ইংরেজ সাহেব-বিবিদের সঙ্গে দ্বারকানাথকে একসঙ্গে সুরা পান করতে দেখে দিগম্বরী গোঁড়া ব্রাহ্মণসমাজের কাছে মতামত চান, স্বামী যদি ‘ম্লেচ্ছ’দের সঙ্গে পানভোজন করে, তাহলে তাঁর সঙ্গে একসঙ্গে থাকা কর্তব্য কি না। বিধান আসে, স্বামীর ভক্তি-সেবা করা কর্তব্য, কিন্তু সহবাস অকর্তব্য।

এই বিধান আমৃত্যু মেনেছিলেন দিগম্বরী। দ্বারকানাথও স্ত্রীর সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানিয়ে মূল বাড়ির বাইরে আলাদা থাকতে শুরু করেন। কোনো প্রয়োজনে স্বামীর সঙ্গে কথা বললে পরে শরীরে সাত ঘড়া গঙ্গাজল ঢেলে নিজেকে ‘পরিশুদ্ধ’ করতেন দিগম্বরী।

‘দ্বারকানাথের মৃত্যুমুখোশ’ লেখায় অনিরুদ্ধ সান্যাল ইঙ্গিত করেছেন, দিগম্বরীর প্রভাবেই হয়তো দ্বারকানাথের মা অলকাসুন্দরী দেবীকে মৃত্যুর তিন দিন আগে গঙ্গাযাত্রায় নিয়ে যান দেবেন্দ্রনাথ। দ্বারকানাথ তখন উত্তর ভারতে। ২১ বছরের নাতিকে অলকাসুন্দরী বলেছিলেন, দ্বারকানাথ থাকলে এমনটা কখনোই হতে দিতেন না। ফিরে এসে মায়ের মৃত্যুসংবাদ পান দ্বারকানাথ। পরবর্তীকালে দিগম্বরী দেবী মরণাপন্ন হলেও গঙ্গাযাত্রা করতে দেননি দ্বারকানাথ। আমৃত্যু বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা করিয়েছেন।

যে ব্রাহ্মণ সমাজের বিধানে দিগম্বরী স্বামীর প্রতি এত কঠোর আচরণ করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন দ্বারকানাথের ঘোর বিরোধী। তাঁদের বিরুদ্ধেই রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গে দ্বারকানাথ সক্রিয়ভাবে লড়েছিলেন সতীদাহ প্রথা বিলোপ করতে। প্রথমবার সমুদ্র পার করে বিদেশযাত্রা থেকে ফিরে ব্রাহ্মণ সমাজের বিধানমতে ‘শুদ্ধ’ হতেও রাজি হননি দ্বারকানাথ। তিনি ধার্মিক ছিলেন, আবার একই সঙ্গে ছিলেন সংস্কারমুক্ত আধুনিক মানুষ।

এমন মানুষকে নিয়ে নানা কথা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। ভোগবিলাসী আচরণ, বেলগাছিয়া বাগানবাড়িতে সুরা পান, নৃত্যগীত, বিদেশি নারীদের সঙ্গে অন্তরঙ্গতার নানা অভিযোগ তাঁকে শুনতে হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পর ঠাকুরবাড়ির সদস্যরা পর্যন্ত দ্বারকানাথের নাম নিতে সংকোচ করতেন। অথচ কৃপালনীর লেখা জীবনীতে আছে, ক্ষিতীন্দ্রনাথকে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, দ্বারকানাথকে তিনি খুব ভালো করে চিনতেন। তাঁর বিরুদ্ধে যা বলা হয়, সেগুলো নির্লজ্জ মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়।

এ কথা ঠিক যে দ্বারকানাথ ঋণ করেছিলেন। কিন্তু একটি চলমান কারবারে ঋণ থাকা অস্বাভাবিক নয়। ঋণের চেয়ে তাঁর সম্পদের পরিমাণ ছিল কয়েক গুণ বেশি। দ্বারকানাথের অর্জিত ও রক্ষিত জমিদারির আয়েই তাঁর ঋণ শোধ করেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। এই আয়েই ঠাকুর পরিবারের কয়েক পুরুষ সচ্ছল জীবন যাপন করেছিলেন। কেন দেবেন্দ্রনাথসহ দ্বারকানাথের উত্তরসূরিরা তাঁর ব্যাপক শিল্পোদ্যোগ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেটি অন্যত্র আলোচ্য।

রবীন্দ্রনাথ পিতা দেবেন্দ্রনাথের মতো ‘অতুল বৈভবের মধ্যে লালিতপালিত’ হননি বটে, কিন্তু তাঁর বাল্যকাল অসচ্ছলও ছিল না। দেবেন্দ্রনাথের বৈভবশালী ও রবীন্দ্রনাথের সচ্ছল শৈশব—দুই–ই দ্বারকানাথের সৌজন্যে।