ওই নারীর চোখটিই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি

জয়া আহসান। বাংলাদেশ ও কলকাতার নন্দিত অভিনয়শিল্পী। অভিনয়ের জন্য বাংলাদেশে বেশ কয়েকবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ভারতে পেয়েছেন ফিল্মফেয়ার ও জি-সিনে অ্যাওয়ার্ড। তিনি লিখেছেন তাঁর প্রিয় ৫ বিষয়-আশয়।

১. প্রিয় বই

জয়া আহসান। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
জয়া আহসান। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

ভালোবাসার বই ‘আরণ্যক’

একটি প্রিয় বই বাছতে হলে আমি বিভূতিভূষণের আরণ্যকই বেছে নেব। বইটিজুড়ে অরণ্যের সবুজ আর সবুজ। অরণ্য সেখানে পৃথিবী আর স্বর্গের মাঝখানে এক মহাদরজা। আরণ্যক তাই আমার প্রিয়।

সবুজ আমার ভীষণ প্রিয়। ভারতেশ্বরী হোমসের ছাত্র থাকাকালে সেখানকার গাছপালায় কী প্রশান্তি যে পেতাম! গাছ এখনো আমার শুশ্রূষা। আরণ্যক-এ তাই আমার বেশি পক্ষপাত।

তবে রুশ দেশের উপকথা বইটির কথাও বলতে হবে। আমার মনে কল্পনা আর ফ্যান্টাসির স্ফুরণ ঘটিয়েছে বইটি। এখনো সময় পেলেই বইটি হাতে তুলে নিই। মনে মনে এর ছড়াগুলো আউড়ে চলি, ‘ছোট্ট গোল রুটি/ চলছে গুটি গুটি...’

বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী আর আরণ্যক, তারাশঙ্করের হাঁসুলী বাঁকের উপকথা এবং অভিজিৎ সেনের রহু চণ্ডালের হাড়ও আমার পছন্দের বই।

২. প্রিয় চিত্রকর্ম

নিষ্প্রভ চোখের মেয়েটি
এস এম সুলতান আর কামরুল হাসান আমার প্রিয় দুই চিত্রকর। সুলতান বলিষ্ঠতার জন্য, কামরুল কমনীয়তার জন্য। তবে ছবির কথা বলতে হলে কামরুলের ‘নাইয়র’ ছবিটির কথাই বলব। হয়তো ছোটবেলায় এটিই চিত্রকলার সৌন্দর্যের দিকে প্রথম চোখ টেনেছে বলে।

ছবিতে দৃষ্টি কেড়ে নেয় মেয়েটির চোখ। কী উজ্জ্বল রঙে আঁকা ছবি। অথচ নাইয়রে যাওয়া মেয়েটির চোখে আলো নেই। গরুর গাড়ির গরু দুটির চোখের মতোই। যেন তারা একই ঘেরাটোপে বন্দী।

শিল্পকর্ম যে কোথায় কীভাবে কাজ করে! বিসর্জন ছবিতে আমার পদ্মা চরিত্রটি যখন বিয়ের পর গরুর গাড়িতে করে নতুন সংসারে যাচ্ছে, কামরুলের ওই নারীর চোখ আমাকে ভীষণ সাহায্য করেছিল। ওর চোখটিই আমি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।

৩. প্রিয় নায়ক

তিনি হাভিয়ের বারদেম

চলচ্চিত্রে কি আলাদা করে নায়িকা বা নায়িকা থাকতে পারে? যে শিল্পী তাঁর সৃষ্টির জাদুতে ছোট্ট চরিত্রটিকেও জীবন্ত করে তুলতে পারেন, তিনিই তো নায়ক বা নায়িকা। পথের পাঁচালীর ইন্দির ঠাকরুণের কথাই ভেবে দেখুন।

তারপরও হাভিয়ের বারদেম আমার প্রিয় নায়ক। তাঁর যাত্রা শুরু স্পেনে, জয় করেছেন বিশ্ব। আলোছায়ায় ভরা কত বিচিত্র চরিত্রই না করেছেন। প্রতিটিই আলাদা এবং বিশ্বাসযোগ্য। আবার নানা চরিত্রের মধ্যেও অভিনেতা হাভিয়েরের নিজের স্বাক্ষর স্পষ্ট চেনা যায়। অভিনেতা হয়েও হাভিয়ের তাই আমার প্রিয় নায়ক।

উডি অ্যালেনের ভিকি ক্রিস্টিনা বার্সেলোনা ছবিতে নিজের একান্ত জগতে মগ্ন স্বার্থপর শিল্পীচরিত্রটিও কেমন চুম্বকের মতো টানে। হাভিয়েরের কারণেই শুধু এমনটা হতে পারে। এই না হলে নায়ক!

৪. প্রিয় নৃত্যশিল্পী

অতুলনীয় পিনা বাউশ

নৃত্য রচনায় পিনা বাউশের সঙ্গে কারও তুলনাই চলে না। জার্মান এই নৃত্যশিল্পী ও রচয়িতার হাতে নাচ আর নাচ নেই, বরং আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা-শিল্পের এক চূড়ান্ত অভিব্যক্তি। শরীরের প্রতিটি অংশ তাঁর নাচের জীবন্ত অংশ, প্রতিটি ভঙ্গিমা অব্যক্ত বাণী।

কবে যে পিনা বাউশের নাচ প্রথম দেখেছিলাম। ইউটিউবে তখনো তিনি সেভাবে আসেননি। প্রথমবার দেখার সময় বুক কেমন ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল, মানুষের পক্ষে এতটাও সম্ভব! তারপর মন্ত্রমুগ্ধের মতো একটার পর একটা তাঁর নাচ খুঁজেছি আর দেখেছি।

আমার কাছে পিনা বাউশের পরিকল্পিত নৃত্যের বেশ কিছু সংগ্রহ আছে। শুনেছি, জার্মান পরিচালক ভিম ভেন্ডার্স তাঁকে নিয়ে নাকি একটি ছবি তৈরি করেছেন। এখন সেটি দেখার অপেক্ষায় আছি।

৫. প্রিয় শিল্পী

মারিনা আব্রামোভিচ

আমার প্রিয় শিল্পী হলেন মারিনা আব্রামোভিচ। তিনি করেন বডি আর্ট। শরীরই তাঁর উপকরণ।

নিউইয়র্কের মোমাতে করা ‘দ্য আর্টিস্ট ইজ প্রেজেন্ট’ই সম্ভবত মারিনার সেরা কাজ। একটি চেয়ারে টানা এক মাস তিনি নিশ্চুপ বসে ছিলেন। তাঁর উল্টো দিকে ছিল আরেকটি চেয়ার। শিল্পীর দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে যেকেউ সেই চেয়ারে বসতেন, নীরবে।

এই পারফরমেন্সের সময় চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে যায়। বহু দিন আগে বিচ্ছিন্ন মারিনার ছেলেবন্ধু উলায় হঠাৎ এসে তাঁর হাতটি নিজের মুঠোয় নেন। মারিনা চোখ মেলে দেখেন উলায়কে। নীরব চোখ জলে ভরে যায়। কী যে মায়াবী মুহূর্ত। যতটা শৈল্পিক, ততটাই মানবিক।

উলায়ের সঙ্গে মারিনার বিচ্ছেদও হয়েছিল চীনের প্রাচীরে একটি অভূতপূর্ব পারফরমেন্স দিয়ে। তবে সে তো আরেক গল্প।