শামসুর রাহমানের কয়েকটি কবিতিকা

শামসুর রাহমানের  কবিতার খাতার একটি পৃষ্ঠা
শামসুর রাহমানের কবিতার খাতার একটি পৃষ্ঠা

একালে হাফিজ

একালে হাফিজ মহাকবি হলে,
তোমাকে দেখলে নতুন গজলে
বলতেন তিনি, বলতেন স্রেফ—
দয়িতা আমার তুমি তো আলেফ।

 আমার মননে

আমার মননে ব্যাপ্ত বস্তুত ছিলেন
মহান লেনিন, বুদ্ধ, বনলতা সেন।
 আগস্ট ১৯৮২

 কথকতা

মনের ভেতর নিত্য জমে
কত কথকতা।
তোমার দিকে মুখ ফিরিয়ে
বলতে গেলাম কথা।

 কিন্তু আমার কথকতার
হারিয়ে গেল খেই।
তোমার দিকে চোখ ফিরিয়ে
দেখি তুমি নেই।
২২ আগস্ট ১৯৮২

 ভালোবাসা
চক্ষুতে গোলাপ গুঁজে, শাদা গম্বুজের ছায়া ছেড়ে নিরালায়
কে এক অচিন পাখি খুব একা উড়ে যায় সদর রাস্তায়
২ অক্টোবর ১৯৮২

 পদত্যাগ
একটি হরিণ আজ হয়েছে নিখোঁজ
একটি যুবতী আজ হয়েছে বিধবা
ডোরাকাটা বাঘ তুমি পদত্যাগ করো।
একটি মায়ের বুক হয়েছে ব্যাকুল,
কিশোর ফেরেনি ঘরে, জ্বলেনি সন্ধ্যার বাতি আজ;
নেকড়ে তোমার
পদত্যাগ চাই।
একটি শহর আজ কালকূটে নীল,
বিষধর সাপ তোর পদত্যাগ চাই।
১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩

আমার পুরোনো চটি
আমার পুরোনো চটি আঁধারে উদাস
পড়ে আছি, বিবর্ণ মেরুণ পর্দা ফেলে দীর্ঘশ্বাস।
অত্যন্ত নিঝুম ঘরবাড়ি
মধ্যরাতে, মনে পড়ে কবেকার রৌদ্রদায়ী শাড়ি।
হঠাৎ কীসের ঘোরে যখন–তখন
বেজে ওঠে আমার একান্ত ব্যক্তিগত টেলিফোন।
১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩

 নিঃসঙ্গতা
কাউকে পাই না খুঁজে আশেপাশে, তীব্র নিঃসঙ্গতা
নিত্যসঙ্গী আজকাল। চতুর্দিক থেকে ছুটে আসে
হিংস্র ঢেউ অবিরত, খুব নোনা পানির আঘাতে
অস্তিত্বের ভিত্তিমূল ক্ষতবিক্ষত সতত আর
কোনোমতে হাওয়া টানি বুকের ভেতরে। মাঝে মাঝে
তোমার গহন কেশভার, সুগন্ধি হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গতা।

 ঘরোয়া
গিন্নী বলেন, গয়নাগুলি
হতেই হবে জড়োয়া।
বলেন হেঁকে পাতি নেতা—
কে করে কার পরোয়া?
রাজনীতিটা জমবে ভালো,
হোক না সেটা ঘরোয়া!
২৫ মার্চ ১৯৮৩

সংগ্রহ ও ভূমিকা: ভূঁইয়া ইকবাল

রবীন্দ্রনাথ দু-চার ছত্রের ছোট ছোট বেশ কিছু কবিতা লিখেছিলেন, এর অনেকটি স্বাক্ষরলিপির দাবি মেটাতে লিখতে হয়েছিল; স্ফুলিঙ্গ সংকলনে সেসব গ্রথিত। এ ছাড়া কবি কণিকা কাব্যেও(১৩০৬ বঙ্গাব্দ) ছোট কবিতা প্রকাশ করেন। নিজে তাঁর ক্ষুদ্র কবিতাকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘কবিতিকা’। রবীন্দ্রনাথের আগেও বাংলা কবিতার ধারায় ভারতচন্দ্র এবং মধুসূদনও ছোট আকারের কবিতা লিখে গেছেন।

শামসুর রাহমান তাঁর কবিজীবনের সূচনায় ছোট কবিতা লিখেছেন, এমন নিদর্শন মেলেনি। প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে (১৯৬০) াব্যগ্রন্থের সবচেয়ে ছোট কবিতা ‘শিখা’ (৯ ছাত্র) ও ‘পূর্বরাগ’ (১১ ছত্র)। 

১৯৮৫ সালে শামসুর রাহমান আমাকে তাঁর একটি কবিতার খাতা উপহার দিয়েছিলেন। কবির নিজের হাতে লেখা একটি রুলটানা ক্রাউন সাইজের এক্সারসাইজ এই খাতায় ৮৪টি কবিতা আছে। তার মধ্য থেকে এখানে মুদ্রিত হলো ছোট আটটি কবিতিকা—‘একালে হাফিজ’, ‘আমার মননে’ (একই নামে আরেকটি দীর্ঘ কবিতাও আছে) ‘কথকতা’, ‘ভালোবাসা’, ‘পদত্যাগ’ ‘আমার পুরোনো চটি’ ‘নিঃসঙ্গতা’ ও ‘ঘরোয়া’। দুটি কবিতিকার নিচে তারিখ নেই। তবে অন্য মুদ্রিত কবিতিকাগুলো ১৯৮২-৮৩ কালপর্বে রচিত। আমার জানামতে, এগুলো এখনো অপ্রকাশিত।

আর ‘পদত্যাগ’ কবিতিকার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বলতে হবে, এটি লেখার আগের দিন ঢাকায় ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ ও সান্ধ্য আইন জারি হয়। বন্ধ ঘোষণা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-চট্টগ্রামের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে সান্ধ্য আইনের কড়াকড়ি করা হয়। কবিতিকাটি পড়ে বোঝা যায়, স্বৈরাচারী এরশাদের রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগের দাবিই এটি লেখার মূল অনুপ্রেরণা। কবিতিকাগুলোতে সমকালীন বানানরীতি অনুসৃত হয়েছে।