আমাদের অভ্রান্ত যাত্রা

সেলিম আল দীন (১৮ আগস্ট, ১৯৪৯–১৪ জানুয়ারি ২০০৮)। ছবি: বারীণ ঘোষ
সেলিম আল দীন (১৮ আগস্ট, ১৯৪৯–১৪ জানুয়ারি ২০০৮)। ছবি: বারীণ ঘোষ

আজ আমার পঞ্চান্নতম জন্মদিন—অঙ্কের হিসাবে অনেক দীর্ঘ বছর। তবে বয়সের অঙ্কে অভিজ্ঞতা অর্জনের হিসাব মেলে না। কারণ, একজীবনে যার যতটুকু জানাবার ও দেবার, ততটুকুই সে জানে বা দেয়। এটা একটা সাধারণ অভিজ্ঞতা, কিন্তু বাংলা ভাষার সহস্র বছরের ধারায় যাঁদের অবদান কালের আঁধার ছাপিয়ে সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসে চিরকালের তটে আছড়ে পড়ে, তাঁদের পায়ের ছাপের ধূলিকণা–সংশ্রবেই আমার জীবন কেটেছে। এ কথা ভেবে নিজের মনের ভেতর একটা অতৃপ্ত আনন্দ কাজ করে বৈকি। সেই সকল অমরবৃন্দকে স্মরণ করি, যাঁরা লেখায়, চিত্রে, সংগীতে, ভাস্কর্যে, চিন্তাচক্রে, দর্শনে, ধর্মের আবরণে মানবমুক্তির অন্বেষণে নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন। এই বিশাল নীলাভ্রের নিচে দেশকাল, ভূগোল, রাজ্য ও রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বে যাঁরা সকল মানুষের খরা ও মহামারিতে সুশীতল মেঘ বর্ষণ করেন—তাঁদের উদ্দেশে বিপুল সম্ভ্রমে মস্তক অবনত করি।

স্মরণ করি আমার জন্মদাতা মরহুম মৌলভি মফিজ উদ্দিন আহমেদকে, যাঁর ঔরসে আমার জন্ম। আমার আম্মা মরহুমা ফিরোজা খাতুনকে, যাঁর গর্ভে পুষ্ট এই আমি আজ থেকে অর্ধশত বছরেরও অধিককাল পূর্বে রক্তলালার স্রোতে ছোট পাল তুলে এই মর্ত্যলোকে এসেছিলাম।

প্রণতি জানাই উপকূলীয় অঞ্চলের সেই নির্জন গ্রাম সেনেরখীলকে, যে তার আকাশ, জলোচ্ছ্বাস, কৃষকের ক্ষেতে ফসল বিনষ্টের হাহাকার এবং শ্রাবণ–শরৎ–বসন্ত কাল আমার ক্ষীণ হাতে তুলে দিয়েছিল, এবং তুলে দিয়েছিল তার আনন্দ–বেদনার শ্বেত ও রক্তবর্ণ কুসুম। উপকূলীয় লবণাক্ত মাটি, ঝড়ের প্রথম গর্জন আর দূর আকাশে উড়ন্ত বুনোহাঁস ও সারসের ঝাঁক আমার দেখবার দুটি দৃষ্টির গোলককে দিয়েছিল অপূর্ব জীবনজিজ্ঞাসা।

জন্মদিনের এই আয়োজনে নিজেকে ততটা সংকুচিত করতে চেয়েছিলাম, যাতে আমার ভেতরে নিজের গৌরবের অবলেশ মাত্র কারও দৃষ্টিগোচর না হয়। ভেবেছিলাম এ আমার জন্য এক আত্মহননের আয়োজন। কারণ, নিরবধিকাল বিপুল পৃথিবী ও সৌরজগতের অনির্ণেয় সীমার মধ্যে আমার মতো দীন–হীনের জন্মদিনের উদ্​যাপন—এই উৎসব শেষে অচিরাৎ এক আত্মধিক্কারে নির্মম পরিহাসে আমার নিজের ভেতর অমৃত অনাকাঙ্ক্ষী বাজনা সে জর্জরিত করবে। তবু যাঁরা এই অপূর্ব সম্মানে অভিষিক্ত করেছেন আমাকে, তাঁদের চরণে বিনত হই। তাঁদের দেওয়া পুষ্পার্ঘ্যকে প্রত্যাখ্যানের সাহস নেই আমার। কারণ, আমার চলবার পথে এই পুষ্পস্তবক সন্ধ্যার অন্ধকারে মৌমাছিদের গুঞ্জনের সুরে সুগন্ধ ছড়াবে। নিঃসীম অন্ধকারে লুপ্ত হবার আগে এই একটু লোভ একটু জয়ের আভাস না নিই যদি তবে তো হতশ্বাসে ভরে যাবে এই একটুখানি বেঁচে থাকা।

 দুই.

আজ আমার জন্মদিন। সেই দূর কোন এক ভাদ্র–ভোরের আলোতে মায়ের কোলে এসেছিলাম। শিশুর দু–চোখে যে পৃথিবী তখন দেখেছি, সে পৃথিবী উৎসবের, সুগন্ধের, বিস্ময়ের—মমতাময় নক্ষত্ররাজির মায়ের বুক। সে ক্রমেই জীবনের নিশ্চিত শুভতর মর্মে অশুভের অশোভন দেখা যেত—বাংলা সাহিত্য এক আত্মবিস্মৃত পালকে, ঔপনিবেশিক দাস্যকে এক অনিবার্য প্রবলে বা প্রাণে পরিণত করবার আয়োজনে উন্মত্ত। উপনিবেশের দুঃসহ অত্যাচারে, শৃঙ্খলিত আশা যখন মুক্তির নৈসর্গিক পন্থায় অগ্রসর হলো, তখন উপনিবেশেরই রাষ্ট্র গঠনের ছলনায় রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার নাগবন্ধনে আবদ্ধ হলাম। আমরা দেখলাম, উপনিবেশ অন্তর্হিত হলেও উপনিবেশের অবলেশসমূহ সগৌরবে বহন করে চলেছি শিল্পে–সাহিত্যে, অর্থে, সমাজ–রাজনীতিতে।

সেই কৃত্রিম প্রচলনের বিরুদ্ধে নিজেদের চেষ্টায় নিজেদের মতো করে দাঁড়াতে চাইলাম। সহস্র বছরের বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে বিশ্বসাহিত্যের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা যারা কাজ করলাম, তাদের ভাগ্যে জুটল ধিক্কার, উপহাস—এবং ধিক্কার উপহাসের অধিক যা—সুপরিকল্পিত অবস্থা। তবু আমরা অটল রইলাম নিজ সচলতার পথে। উপনিবেশের বাতলে দেওয়া শিল্পরীতির মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাইলাম নিজের ভূমি থেকে নিজের ধর্ম ও সংস্কৃতির বাস্তবতায় উৎসারিত শিল্পরীতি। কিন্তু তার পূর্ণতা বা সফলতা এখনো হয়তো বহুদূরে। কারণ, এ এক নিছক পুরাতাত্ত্বিক খনন নয়, এ নতুন করে বিশ্বের সঙ্গে নিজেদের মেলাবার আবর্তনশীল আধুনিকতার দিকে আমাদের অভ্রান্ত যাত্রা।

কিন্তু এই শিল্পরীতির পথ অগ্রসর হতে গিয়ে আমরা দেখেছি,এই একবিংশ শতাব্দীতে রাষ্ট্র সুশীল ও সংহত হবার বদলে এক মানব নিপীড়ক যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রের রূপটা যেন বা ইংল্যান্ডীয় রেনেসাঁ পূর্বকালের স্টুয়ার্ট। স্টুয়ার্ট আমাদের মানব নিধন মেশিন। যার এক পাশ দিয়ে জীবিত মানুষকে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো শয়তান বলে, আর অপর পাশ দিয়ে সে বেরোত মাংসের থকথকে আঠালো খাই হয়ে।

তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে ওই সকল দেশের সাধারণ মানুষের সম্মতিতে নয়, বরং ইংরেজ, ফরাসি, স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ শাসকদের ষড়যন্ত্রের ফলে। আজ এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর দিকে তাকালেই বুঝতে পারি, রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের স্বাধীনতার অধিকার হরণ করেছে—কখনো সামরিক শাসন, কখনো সমাজতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র বা গণতন্ত্রের নামে। দুঃসহ দারিদ্র্য, গোত্র ও মতবাদভিত্তিক হত্যাযজ্ঞ, রাজনৈতিক সংঘাত, অবৈধ সুখ-সমৃদ্ধির লালসা সৃষ্টিকারী এসব রাষ্ট্রের গণতন্ত্র এক বিধিনির্বন্ধ অপঘাত হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে।

আর অন্যদিকে বৃহৎ ও ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের বাণিজ্য লালসা দেশে দেশে বিস্তারিত হয়েছে। সেই সকল রাষ্ট্রের ক্ষমতা এতটা নির্মমরূপে প্রকাশিত হতে দেখি যে মনে করতে বাধ্য হই তবে কি সকল সভ্যতায় একজন হালাকু খান, একজন চেঙ্গিস কিংবা একজন হিটলার থেকেই যাচ্ছে?

আজ জীবনের অর্ধশত বছরের অধিককাল পেরোতেই দেখছি রাষ্ট্রের সংজ্ঞাটা ভারী একটা মুদ্রিত ব্যাপার। রাষ্ট্রের চেয়ে ক্ষমতাধর হবার চেষ্টা ছিল ধর্মের—এককালের ইউরোপে। আজ দেখছি সে জায়গাটা দখল করে নিয়েছে বৃহৎ রাষ্ট্রের পণ্য উৎপাদনকারীরা। এই ভূমণ্ডলের ভাগ–বাঁটোয়ারা সবই তাদের হাতে। সরকার এবং জনগণের ভাগ্য নিয়ন্তা ওই সব লোকেরা, যারা রাষ্ট্রকে কর দিচ্ছে সরকারটিকে তাদের রোবট বানিয়ে পুরো রাষ্ট্রটাকেই তাদের কবজায় আনবার জন্য।

আজ সমগ্র বিশ্বে রাষ্ট্ররেখাগুলো নিরর্থক অট্টহাসির রেখা ব্যতীত আর কিছু নয়। কারণ, মুক্তবাজার সীমান্ত মানে না। সীমান্ত গুঁড়িয়ে দিয়ে ক্ষুদ্র, অসহায় ও বিস্ময়ময় রাষ্ট্ররেখাগুলো পণ্য বিপণনকারীদের খোলাবাজার মাত্র।

যে বিশ্ব ফিরদাউসি, হাফিজ, গ্যাতে, তলস্তয়, রবীন্দ্রনাথ, আইনস্টাইনের, সে বিশ্ব আজ আর কোথাও নেই। আজকের সভ্যতা নিরেট পণ্যসভ্যতা। মানুষ এখানে পণ্যের চেয়ে গৌণ। পৃথিবীর সকল মানুষ বাজার অর্থনীতির নিচে চাপা পড়ে গেছে। তাদের রক্তাক্ত চিৎকারে মানবসভ্যতার দুই চোখে অশ্রু ও রক্তবর্ণ রেখা দেখতে পাই। মানুষের অমিত সম্ভাবনাকে যারা নিরন্তর যন্ত্র সংস্কৃতি দ্বারা উৎপাদন ও বিপণনের জটিল জালে আটকে ফেলেছে, তাদের বিরুদ্ধে ধিক্কার ও অভিশাপবাণী উচ্চারণ করি। একদিন নিজের তাগিদে মানুষ রাষ্ট্রসীমা লুপ্ত করে দিয়ে বিশ্বমানব হয়ে উঠবে, গ্রহ থেকে গ্রহে পৃথিবীর সবুজ বীজ বহে নিয়ে যাবে নতুন জীবনের অসীম আকাঙ্ক্ষায়—মানুষ সম্পর্কে এই অমৃত আশা এই দুর্দিনে রক্তবৃষ্টির প্রবল বর্ষণেও নিরুদ্ধ হয় নাই। তবে এ অর্জন কোনো আত্মমগ্ন সাধনার বিষয় নয়। কারণ, সভ্যতার ইতিহাসে দেখেছি, মানবসৃষ্ট বর্বরতার বিরুদ্ধে মানুষই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বারংবার। আজও সেই প্রত্যাশা আপনাদের কাছে—মানবতার যে অবলম্বন, মানুষের যে সমূহ বিনষ্টের খেলা চলছে তার বিরুদ্ধে এখনই রুখে দাঁড়াতে হবে। তা না হলে এই সুশীল সবুজ ভূগোলের পৃথিবীব্যাপী খুনি হিংস্রতা ডায়নোসরের দানবীয় চিৎকারে ভরে যাবে।

নিজের লেখার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি সেখানে কত–না অসম্পূর্ণতা, অস্পষ্টতা। বিশ্বমানবের আর্তনাদের মুখে ভরসা জোগাবে, অসীম সৃষ্টিশীলার অদম্যরহস্য উদ্​ঘাটন করবে—সে রকম লেখা তো লিখতে পারি নাই। হয়তো মৃত্যুর আগে এই সব লেখা বারংবার নিজেদের অসম্পূর্ণতার রক্তক্ষত নিয়ে দাঁড়াবে। তবু অন্তত আজকের এই শুভ ক্ষণে চিৎকার করে বলব, সেই আজ ভ্রাতাদের মতো সতর্ক হও, ঝড়ের মেঘ ঘন হয়ে আসছে।

এই অপটু অসম্পূর্ণ অভিভাষণের অন্তে ঢাকা থিয়েটারকে স্মরি। আমার আজীবনের শিল্পসঙ্গী নাসির উদ্দিন ইউসুফকে জন্মদিনের সকল অর্ঘ্য অর্পণ করি। কেননা তাঁর অমিত শিল্পবাসনা মানবচিন্তা ও বিশ্বভাবনার কাছে চিরঋণী।

চাঁদপুরবাসী গৌড়জন, ত্রিনদী মেঘনার কূলে ভাঙনমুখা এ শহর, কিন্তু ওই স্থিতাবস্থায় নদীদের সবল স্রোত আপনাদের বুকে বহে যায়। আপনাদের অন্তরে খোলা নদীর হাওয়া, সেইখানে আমার খানিক পালখাটানো নৌকায় ভাসানো আজীবনের স্বার্থ সঞ্চয় হয়ে থাকল, যে চন্দ্রপুর একদা সমগ্র জনপদের অন্ন–আহার–সমৃদ্ধির জোগান দিত, সে শহর নদীর থাবার নিচে। তাকে বাঁচাবার শক্তি কি এ জাতির নাই? তবে তো ধিক্কার দিই তাদের, যারা নিজের ঐতিহ্যকে নিজের চোখের সামনে ভেসে যেতে দেখে চোখ আকাশে রেখে নক্ষত্রের গল্প শোনায়।

আপনারা সবাই এবং বর্ণচোরা নাট্যগোষ্ঠীর সকলকে আমার আজীবনের কৃতজ্ঞতা জানাই।

২৩ আগস্ট ২০০৪

 সংগ্রহ ও ভূমিকা: বোরহান উদ্দিন

নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন ছিলেন আমার অগ্রজ। ১৮ আগস্ট তাঁর ৭০তম জন্মবার্ষিকী। ক্ষণজন্মা এ নাট্যকারের ৫৫তম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়েছিল ২০০৪ সালে চাঁদপুরে, বর্ণচোরা নাট্যগোষ্ঠীর উদ্যোগে। তখন এ আয়োজনে সহায়তা করেছিলাম আমি এবং চাঁদপুর জনতা ব্যাংক, পুরানবাজার শাখার তৎকালীন এসপিও নুরুল ইসলাম সাহেব।

১৮ তারিখ জন্মদিন হলেও চাঁদপুরের শিল্পকলা একাডেমিতে তাঁর ৫৫তম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি হয়েছিল ২৩ আগস্ট। এ অনুষ্ঠানে সেলিম ভাই একটি লিখিত অভিভাষণ পাঠ করেন। পরে অভিভাষণটি আমার সংগ্রহে থেকে যায়, যা অধ্যাবধি প্রকাশিত হয়নি।

এই অভিভাষণে নিজের জন্ম, বাবা–মা, শিল্প–সাহিত্যসহ নানা প্রসঙ্গ ছুঁয়ে যেতে যেতে তিনি বলেছিলেন সমকালীন বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে। বলেছিলেন দেশে দেশ রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন বিষয়ে নানান কথা। আমরা মনে করি, বর্তমান বিশ্বের বাস্তবতায় তাঁর ওই কথাগুলো এখনো প্রাসঙ্গিক।