কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন

বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রে এ মহীয়সীর ভাস্কর্য এবং মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতিকেন্দ্রে রয়েছে কালজয়ী এ লেখকের আবক্ষমূর্তি
বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রে এ মহীয়সীর ভাস্কর্য এবং মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতিকেন্দ্রে রয়েছে কালজয়ী এ লেখকের আবক্ষমূর্তি
বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে রয়েছে দুটি প্রতিষ্ঠান—মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতিকেন্দ্র ও বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র। এ দুই প্রতিষ্ঠান ঘুরে এসে লেখাটি লিখেছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক।

কাঁটা ফুটে আছে মনে, খচখচ করে। কাঁটা বিঁধেছে গলায়, দমবন্ধ অবস্থা। কাঁটা পড়ে আছে পথে, চলাচলে দায়। কাঁটা ঘিরে আছে সীমানা, যাতায়াত নিষিদ্ধ। ইত্যাদি ইত্যাদি। যে কাঁটা ফুলে কিংবা যে কাঁটা কূলে তা-ও কিন্তু বেঁধে। কাঁটা নিয়েই যত বিপত্তি! আবার কাঁটার অপর প্রান্তে কিংবা কাঁটার আড়ালেই কমলের দেখা মেলে। তবে কাঁটা নিয়ে যতই হোঁচট খাই, কাঁটামুক্ত হওয়া কিন্তু বড় কঠিন। একবার যদি কাঁটায় পায় তবে সাদামাটা বিষয়ও তার চরিত্র বদলায়।

কাঁটা জ্বরে কাঁপায়, ঘরে জ্বালায়। ঘরের কাঁটা নানাবিধ। ডালে লবণ, সবজিতে উল্টো-সিধে শয়ন-স্বপন, ঝাল দাপিয়ে বেড়ায় ঝোলে; এবং ভাতের বিষয়টি এমন ঘেঁটে গেছে যে নতুন জো পেয়ে আবার ধান বোনার জন্য জমি প্রস্তুত। এ তো গেল খানাখাদ্যের, এরপর শয্যা-নিদ্রা থেকে দর্শন-শ্রবণ পর্যন্ত এগোলে কাঁটামালা শরীর-মন জড়িয়ে নৃত্য করে, বাদ্য বাজায়। ঘরের ওপাশেই যে ঘর—সেখানে জ্বরের তাপ আর খরের মাপ প্রায় সমান সমান! একজীবনে কাঁটার দিশে পাওয়া ভার! রক্তের কাঁটা স্নেহ-শ্রদ্ধায় পৌঁছালে তখন বুকের পাটা ফুলিয়ে তালপাতার সেপাইও পথ আগলায়। কাঁটা ধরে রাখা কিংবা কাঁটা পোষা যেন নিয়তির ফের। চারদিক ফকফকা থাকলেও নিশ্চিন্ত হওয়ার অবকাশ নেই যে পা বাড়ালেই ফুটবে না! ফোটার সঙ্গে জোটার ভাব স্বার্থে এবং ঈর্ষা তার পায়ে পায়ে ঘোরে। চোখ আছে, তবে ফোটেনি—মুখ আছে, তবে বুলি নেই—পা আছে তবু বিপত্তি পথে—সবকিছু উতরিয়ে পাওয়ার অঙ্ক কেবল সুখে। সুখ ও দুঃখ যেন কমল ও কাঁটায় লীন!

‘কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন

        কমল তুলিতে

দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে’

এক পূর্ণ মূর্তি

বিস্তীর্ণ সবুজের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি—বেগম রোকেয়া—মিশ্র ধাতুতে গড়া এক পূর্ণ মূর্তি। তাঁর বাঁ দিকে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের মূল ভবন, ডান দিকে ডরমিটরি কাম বিশ্রামাগার। পেছনে সামান্য দূরে পুকুর এবং সম্মুখে প্রবেশপথ। মূল ভবনে আছে শিক্ষাকেন্দ্র, পাঠাগার, জাদুঘর, সেমিনার হল, মিলনায়তনসহ দাপ্তরিক কর্মসম্পাদনের জন্য কক্ষসমূহ। কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের আবাসন নিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ এ কেন্দ্রটির আয়তন ৫ একরের মতো। ফল-ফুল ও প্রকৃতি যেন সম্মিলিতভাবে অভিবাদন জানাচ্ছে এই মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়াকে।

তিনি আছেন, যেন ঘাসের ডগায় লাগে প্রাণের স্পর্শ। তাঁর জীবনের সঙ্গে যে সংগ্রাম মাথা তুলে নারীর অধিকারের কথা বলেছে তা শুধু এই কেন্দ্রে স্থাপিত একটি ভাস্কর্যেই নয়, পুরো অঞ্চলেই আছে এক মুক্তির আহ্বান। অবরোধের বাইরে এসে, অবগুণ্ঠনের আড়াল ছিন্ন করে তিনি শত-লক্ষ-কোটি নারীর অন্তরে বাঁচার হাওয়া বইয়ে দিয়েছেন। তাঁকে সহস্র অভিবাদন।

স্মৃতিকেন্দ্রের মূল ফটকের বাইরে কয়েক পা দূরে তাঁর জন্মস্মৃতিসংবলিত একটি সংরক্ষিত এলাকা। এখানেই একটি কক্ষকে জন্মস্থান বলে চিহ্নিত করে স্থায়ী বেদি নির্মিত হয়েছে। রংপুর জেলার পায়রাবন্দের এ অঞ্চলটি যেন ধারণ করে আছে তাঁরই হাতের দীপশিখাটি। শিক্ষাবিস্তারের পরমব্রত নিয়ে যিনি একদিন বাঙালি নারীদের ঘরে ঘরে ফিরেছেন, তাঁকে স্মরণে রেখে এই কেন্দ্রের কার্যপরিধি বিস্তৃত করার লক্ষ্যে যুগোপযোগী পরিকল্পনা হাতে নেওয়ার সময় এসেছে। আসুন, দুঃখিনী মায়েরা, আসুন নিগৃহীতা বোনেরা, আপনাদের পথ চিনে নিন!

বিষাদ-সিন্ধুর স্মরণচিহ্ন

শতবর্ষ পার করেও বিষাদের এক সিন্ধু প্রবাহিত হচ্ছে ভক্তের হৃদয়ে, বিশ্বাসীর মানসলোকে। এক সীমার, এক এজিদ কারবালার প্রান্তর থেকে সেই বেদনাধারা বঙ্গদেশের আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে দিয়েছে মীরের কলমে। বিষাদ–সিন্ধু—রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন। তাঁর স্মৃতিকে সমুজ্জ্বল রাখতে নির্মিত হয়েছে রাজবাড়ী জেলার পদমদীতে এক আধুনিক স্থাপনা—মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতিকেন্দ্র। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে মনোহর এই সবুজ প্রান্তরে শেষশয্যায় শায়িত আছেন তিনি। পাশাপাশি আছেন পরিবারের আরও কয়েকজন সদস্য। মীরের সাহিত্যকর্মের তালিকা দীর্ঘ—তার মধ্যে জমিদার–দর্পণ, বিষাদ–সিন্ধু, গো-জীবন, গাজী মিয়াঁর বস্তানী ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য সম্পদ। তাঁর জন্মস্থান লাহিনীপাড়া, কুষ্টিয়ায়ও স্মৃতিবহ কিছু সামগ্রী বর্তমান। তবে সার্বিকভাবে কর্ম ও কীর্তিকে স্মরণ করে নির্মিত এ স্মৃতিকেন্দ্রটি পালন করতে পারে এক অসাধারণ ভূমিকা। কালে কালে এটি যাতে মীর মশাররফ হোসেন চর্চার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে, সেই প্রচেষ্টায় রত হওয়ার এখনই সময়।

যে যাপনের মধ্য দিয়ে একজন মীর মশাররফ হোসেন বাঙালি পাঠকহৃদয়ের কাছাকাছি এসেছিলেন, যেন সেই তাপ আজও বয়ে চলেছে। তাঁর কলমের কৃষ্ণধারায় নিঃসৃত হচ্ছে কারবালার শোণিত প্রবাহ।

 ‘মীরদর্শনের পথে

সামান্যই ধরে পদ্মা

অসাধ্য অজানা

হাওয়া মানে মাটির সংসার।

মীরে পৌঁছে কারবালা

      মীরেই বিষাদ

দয়া দাও হে পাবন

          সিন্ধুসাধ করি।’