কাবুলে শেক্সপিয়ার

মঞ্চে ওঠার আগমুহূর্তে লাভস লেবার্স লস্ট নাটকের পাত্রপাত্রীরা। ছবি: সংগৃহীত
মঞ্চে ওঠার আগমুহূর্তে লাভস লেবার্স লস্ট নাটকের পাত্রপাত্রীরা। ছবি: সংগৃহীত

কাবুলিওয়ালাদের বাঙালি চেনে মহাজন হিসেবে, যারা খাতকদের কাছে ‘আসলি নেহি মাংতা’—সুদটাই চাইত। তাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ছাপোষা বাঙালির নিঃস্ব হওয়ার দেদার গল্প একসময় খুব প্রচলিত ছিল। তবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অমর গল্প ‘কাবুলিওয়ালা’র মাধ্যমে রুক্ষ দেশের কাঠখোট্টা মানুষের হৃদয়ের উষ্ণতার ছোঁয়া দিয়ে বাঙালি মানসে এই বহিরাগত চরিত্রের জন্য জায়গা তৈরি করেছেন। আর জীবনরসিক সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর প্রথম সাহিত্যকীর্তি দেশে বিদেশের মাধ্যমে এই দেশ আর তার বাসিন্দা আবদুর রহমানকে বাঙালি হৃদয়ে স্থায়ী আসন গড়ে দিয়েছেন।

আফগানিস্তান ছিল মধ্য এশীয় তুর্কি, আরব ও ইরানিদের ভারতবর্ষে প্রবেশের পথ, অপেক্ষার ডেরা। মধ্য এশিয়ার ফারঘানার তুর্কি বংশোদ্ভূত বাবর আফগানিস্তানে ডেরা গেড়ে ছিলেন কয়েক বছর। বাবরনামায় সেসব স্মৃতি ফিরে ফিরে এসেছে। বৃহত্তর পারস্য সভ্যতার অন্তর্গত ধূলিধূসরিত রুক্ষ পাহাড়ি দেশ আফগানিস্তান। আল–বেরুনী, রুমিসহ অনেকেই এখানে বাস করেছেন। বহু গোত্রে বিভক্ত সমাজে যুদ্ধ যত ছিল, শান্তি ততটা নয়, ব্রিটিশ তার উন্নত অস্ত্র, ধুরন্ধর রণকৌশল আর ধূর্ত কূটনীতি প্রয়োগ করেও আফগানদের বশ করতে পারেনি, দেশটাকে উপনিবেশ বানাতেও পারেনি। এই স্বাধীনচেতা বিচিত্র গোত্রের মানুষের দেশটা শেষ পর্যন্ত তালেবানি যোদ্ধা আর তাদের কট্টরপন্থী হিংস্র শাসনের কারণে তাবৎ দুনিয়ায় পরিচিতি পেয়েছিল। পাকিস্তান-মার্কিন মদদে মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে সোভিয়েত-সমর্থিত সরকারের পতন ঘটার পরে মুসলিম জঙ্গিবাদের চেহারা বিশ্ব দেখতে শুরু করে। ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়েদা এতে আরও রং চড়িয়েছিল। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত সে দেশ নিরন্তর যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যেই রয়েছে। মার্কিনিরাই এখন দূর থেকে দেশটির ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছে।

যে দেশ সম্পর্কে রক্তাক্ত হানাহানির খবরেই আমরা অভ্যস্ত, সে দেশটা সম্পর্কে নতুন করে ভাবনার প্রয়োজন হলো দুটি বইয়ের সূত্রে—হাতে এল মার্কিনপ্রবাসী আফগান লেখক খালিদ হোসাইনির পাঠকনন্দিত প্রথম উপন্যাস কাইট রানার এবং পরের দুটি উপন্যাস। আর দ্বিতীয় বইটির নাম শেক্‌সপিয়ার ইন কাবুল। এ বইয়ের লেখক দুজন—ওয়াশিংটন পোস্ট ও বিবিসির সাবেক কর্মী স্টিফেন ল্যান্ডরিগান এবং কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় স্নাতক ও চতুর্থ প্রজন্মের কার্পেট ব্যবসায়ী, কাবুলনিবাসী লেখক কায়েস আকবর ওমর। তাঁদের বইটি একটি দারুণ অভিজ্ঞতার প্রাণবন্ত বয়ান। বলা ভালো, কাইট রানার-এর অভিজ্ঞতা খালেদের পরের দুটি উপন্যাসও পড়ে নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

তালেবান শাসন অবসানের পরেও কাবুলসহ আফগানিস্তানের নানা শহরে জঙ্গিদের চোরাগোপ্তা হামলা তো চলছেই। এরই মধ্যে ২০০৪-০৫-এর দিক থেকে কাবুল সরকারের পশ্চিমা মিত্ররা নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছিল হানাহানিতে লিপ্ত ছিন্নভিন্ন সমাজে কোনোভাবে জীবনের ইতিবাচক দিক উদ্‌যাপনের আয়োজন করা যায় কি না। তারই অংশ হিসেবে কাবুলে আধুনিক নাটক মঞ্চায়নের উদ্যোগ। এ কাজের পেছনে মূল ব্যক্তি প্যারিসবাসী অভিনেত্রী কোরিন জ্যাবের। কোরিনের বাবা জার্মান, মা সিরীয়। পৃষ্ঠপোষকতায় ছিল কালচার অ্যা-সিভিল সোসাইটি ফাউন্ডেশন ও কাবুলের ব্রিটিশ কাউন্সিল।

অনেক নাটক নিয়ে ভাবনাচিন্তার পরে আফগান জাতির কাব্যপ্রীতি ও বাচিক দক্ষতা এবং তাদের জাতিগত যোদ্ধাভাব, তাদের সহজাত দোস্তি-হামদরদির সংস্কৃতি ও বিপরীতে সাম্প্রতিক নানা স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং ব্যক্তিচরিত্রের উচ্চকিত নাটকীয়তা ইত্যাদি মাথায় রেখে কোরিনের মনে হলো মলিয়ের নয়, শেক্‌সপিয়ারই হবেন উপযুক্ত নাট্যকার।

কিন্তু শেক্‌সপিয়ারের কোন নাটক তাদের জন্য উপযুক্ত হবে? কঠিন কাজ। বিস্তর পঠন–পাঠন, অনেক ভাবনাচিন্তা চলেছে। কোরিনকে আফগান মানস, দারি ভাষার বৈশিষ্ট্য, দেশের ইতিহাস ও সাম্প্রতিক ট্র্যাজেডিময় বাস্তবতার সঙ্গে পরিচয় করানোর প্রাথমিক কাজটা কোরিন-কায়েস উভয়ের জন্য ছিল কঠিন। এ কাজের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও অঙ্গীকারই কোরিনকে শেষ পর্যন্ত সব বাধা উতরে যাওয়ার সাহস জুগিয়েছিল।

কোরিন যথার্থই ভাবলেন, ট্র্যাজেডি আক্রান্ত এ দেশে আরও ট্র্যাজেডি চাপানোর চেয়ে শেক্‌সপিয়ারের কমেডি মঞ্চায়নই হবে যথোপযুক্ত কাজ। তাঁর পছন্দ লাভস লেবার্স লস্ট। তবে মূলের ২ হাজার ৭৮৫ পঙ্‌ক্তি থেকে কেটে-ছেঁটে হাজারখানেক পঙ্‌ক্তি বাছাই করে নাটকটি সাজানো শুরু করেন কোরিন। সম্পাদনার কাজে স্বভাবতই অনেক সময় লেগেছে, সংশ্লিষ্টদের ধৈর্যের পরীক্ষা হয়েছে রীতিমতো।

ধাপে ধাপে এগিয়েছে কাজ। কুশীলবদের খুঁজে নেওয়াও সহজ কাজ ছিল না। সিনেমার পাকা অভিনেতা থেকে জীবনে কখনো মঞ্চেও নামেননি—এমন বিচিত্র সব উৎসাহী মানুষের ভেতর থেকে তাৎক্ষণিক অভিনয়ের দক্ষতা দেখে বাছাই করা হয়েছিল দল। কোরিন পশ্চিমা সংস্কৃতির মানুষ। শৃঙ্খলা ও নিয়মের মধ্যে নির্দেশকের ভূমিকায় ছাড় দিতে অনভ্যস্ত। মানুষটা মাঝেমধ্যে থমকেছেন, সংশয়ে পড়েছিলেন, বিরক্ত হয়েছেন যখন মহড়ার মধ্যে প্রায়ই কুশীলবরা তাঁর নির্দেশনা নিয়ে নিজেদের মতামত দিতেন, কখনো বচসায় জড়াতেন। কিন্তু যখনই কারেন জানতে চাইতেন কায়েসের কাছে, ওরা কী বলছে; তখনই সবাই দারি ভাষায় নিচুস্বরে তাঁকে অনুনয় করে বলত ওকে যেন সত্যটা না বলে খুশি হওয়ার মতো কিছু বলে। কারেন মূল ব্যাপারটা আঁচ করতে পারলেও অভিনয়ে ওদের সহজাত ক্ষমতায় এবং কাজটার প্রতি ভালোবাসা দেখে পিছু হটেননি।

শেক্‌সপিয়ার ইন কাবুল-এর প্রচ্ছদ
শেক্‌সপিয়ার ইন কাবুল-এর প্রচ্ছদ

নায়িকা মারিনার চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বহু খোঁজাখুঁজির পরে পাওয়া গেছে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া ছবি ওসামায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করে তারকাখ্যাতি পাওয়া মারিনা গুলবাহারকে। সে বস্তিতেই বড় হয়েছে। ১০ বছর বয়সে যখন সিদ্দিক কারমানের ওই ছবিতে অভিনয় করে, তখন সে পরিবারের জন্য ভিক্ষা করে আর রেস্টুরেন্টের এঁটো খাবার সংগ্রহ করে দিন কাটাত। এর চার বছর পরে যখন এ নাটকের জন্য সে অডিশনে দাঁড়িয়েছে, সে সময় মাত্র চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়া মেয়েটি না শুনেছে শেক্‌সপিয়ারের নাম, না জানে ইংরেজি এক বর্ণ। নাটকটা হচ্ছে অবশ্য দারি ভাষায়, দারি যেহেতু ফারসিই ভগ্নিভাষা, তাই পুরোনো রীতির ফারসি অনুবাদের সাহায্য নিয়েই স্ক্রিপ্ট দাঁড় করানো হয়েছে। মারিনার চলচ্চিত্রে অভিজ্ঞতা থাকলেও সে কখনো নাটকে অভিনয় করেনি, মঞ্চাভিনয় সম্পর্কে কিছুই জানে না। কুশীলবদের কেউ ইংরেজি শিক্ষিত আধুনিক মানুষ, টিভি-চলচ্চিত্রে অভিনয়ে সিদ্ধ, আবার কেউ একেবারে আনকোরা, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ। তবে সবার জন্য একইভাবে ছিল তালেবানি জঙ্গিদের হুমকি আর রক্ষণশীল সমাজের তীব্র বাধা। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, এতসব বাধা ডিঙিয়ে নাটক কেবল সফলভাবে মঞ্চস্থ হয়নি, আফগানিস্তানের পরিস্থিতি উপেক্ষা করে দেশের অন্যান্য শহরেও এটি মঞ্চায়িত হয়েছে।

আফগান সমাজে মোল্লাদের আধিপত্য থাকলেও তালেবানি জঙ্গিদের একচেটিয়া জবরদস্তির অবসানের ইঙ্গিতও দেয় নাট্যপ্রদর্শনী। স্বভাবতই নাটক মঞ্চায়ন নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমে খুব আগ্রহ ছিল। শিকাগো ট্রিবিউন-এর প্রতিনিধি ভেতরের উৎকণ্ঠা তুলে ধরেছিলেন এভাবে: বুধবারেনাটক শুরুর আগে এর সঙ্গে যুক্ত সবার উদ্বেগের শেষ ছিল না। আফগানরা কি নাটক দেখতে আসবে? নারীরাও আসবে? কুশীলবরা নিরাপদ থাকবে তো? সংলাপগুলো ওদের মনে থাকবে তো? মহড়ার মতো ওদের মধ্যে হঠাৎ মারামারি বাধবে না তো? দর্শকেরা হাসবে তো? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, ওরা নাটকটি বুঝবে তো?

এএফপির প্রতিবেদক লিখলেন: কাবুলে বহুকাল পরে হলভর্তি দর্শক হাস্য রোলের মধ্যে শেক্‌সপিয়ারের নাটক উপভোগ করেছে। এরা কেউই মঞ্চে কখনো নাটক দেখেনি, ছেলেমেয়ের একসঙ্গে অভিনয় দূরের কথা।

বোরকার বাইরে পুরুষের সঙ্গে পর্দাহীন নারীর মঞ্চাভিনয় অনেকের জন্যই ছিল আনকোরা অভিজ্ঞতা। নাটক নিয়ে দলটি কাবুলের বাইরে গিয়েও চমৎকার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। ছেলেদের কৌতূহল ছিল প্রবল, কিন্তু নাটকের সাফল্য তাদের প্রতিক্রিয়াকে সব সময় ইতিবাচক রেখেছে। কখনো ভিন্ন শহরে রাস্তার পাশে পার্কে হয়েছে নাটক, তাতেও ওরা অসুবিধায় পড়েনি।

তবে সবটাই মধুর সমাপ্তির অভিজ্ঞতা নয়। পারভীন ও তার স্বামী নাটকের জন্য পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য হয়েছিল। তাতেও রক্ষা পায়নি। এক রাতে অজ্ঞাত কিছু লোক তার স্বামীকে বাইরে ডেকে নিয়ে যায় এবং একসময় অন্ধকার ঘরে সন্ত্রস্ত সন্তানদের নিয়ে অপেক্ষার মধ্যেই ভয়ার্ত পারভীন তিনটি গুলির শব্দ শুনতে পায়। তার পক্ষে তখন সম্ভব ছিল না ঘরের বাইরে যাবে। ভোরে প্রতিবেশী আর পুলিশের কাছে তার সর্বনাশের কথা জানতে পারে। তারপর চলে তার পলায়ন আর সন্তানদের রক্ষার প্রাণান্ত সংগ্রাম। শেষ পর্যন্ত সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ঠাঁই হয় পাকিস্তানে। সেখানেও পিছু ছাড়েনি তালেবানরা। অবশেষে কোরিনের ব্যাকুল চেষ্টায় কানাডায় তাদের ঠাঁই হয়। পারভীন হয়তো অকাল বৈধব্যের বোঝা নিয়ে হলেও বেঁচে গেছে।

তবে এ বই পড়তে পড়তে তালেবানিদের চোরাগোপ্তা হামলার ভেতরেই একটা অন্য কাবুলের জাগরণও বোঝা যায়। এক সন্ধ্যায় শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত ও শিক্ষাবঞ্চিত কুশীলবেরা মিলে অন্ত্যাক্ষরী (একটি গান বা পদ্যের শেষ বর্ণ দিয়ে একটি গান/পদ্য বলার প্রতিযোগিতা) খেলছিল, তখন মার্কিন পর্যটক জ্যাকব বেইনহাম সবিস্ময়ে লক্ষ করে, তারা প্রত্যেকেই অনায়াসে হাফিজ, রুমির মতো ফার্সি ভাষার মহৎ সব কবিদের কাব্য থেকে মুখস্থ বলতে পারে। তার মনে হলো, যদিও এ দেশে শিক্ষার হার খুব কম, কিন্তু আমেরিকার মুষ্টিমেয় কিছু শিক্ষিত লোকও এই সাধারণ আফগান তরুণ-তরুণীর মতো নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভগ্নাংশও বহন করার যোগ্যতা রাখে না।

কথাটা সত্য, এবং এখানেই এ জাতির টিকে থাকার শক্তি নিহিত। যুদ্ধ-বিগ্রহ, রক্তপাত ও ধ্বংস সংস্কৃতির এই প্রবাহ বন্ধ করতে পারবে না।