ব্যক্তিক স্মৃতি যখন দেশের প্রতিচিত্র

শওকত ওসমান (২ জানুয়ারি ১৯১৭-১৪ মে ১৯৯৮), ছবি: নাসির আলী মামুন
শওকত ওসমান (২ জানুয়ারি ১৯১৭-১৪ মে ১৯৯৮), ছবি: নাসির আলী মামুন

কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের সঙ্গে আমাদের অনেকেরই পরিচয় সেই মধ্য-কৈশোরে, যখন স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে আমরা পড়ছি তাঁর বিখ্যাত ছোটগল্প ‘আব্বাস’। তারপর তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ-পরিচয় ও সখ্য। এই সূত্রেই জানবার সুযোগ হয়েছিল লেখক ও ব্যক্তিমানুষ হিসেবে শওকত ওসমানকে। এ বইয়ের পাণ্ডুলিপির জোগানদাতা হিসেবে সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর মুখবন্ধে শওকত ওসমান সম্পর্কে লেখেন, ‘সরকারি চাকরি করতেন বলে প্রত্যক্ষ দলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন না, কিন্তু প্রগতিশীল বাম ধারার রাজনীতিকদের প্রতি ছিল তাঁর সমর্থন। তাঁদের অনেকের সঙ্গে ছিল তাঁর বন্ধুত্ব। তিনি ছিলেন অবিচল বাঙালি জাতীয়তাবাদী এবং সমাজতন্ত্রের সমর্থক।...পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের দুই শীর্ষ নেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতিকে তিনি সমর্থন দিয়েছিলেন।’

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শওকত ওসমান সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের কলকাতায় চলে যান। পালন করেন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকা। প্রবাসী সরকারের নেতা ও কর্মকর্তা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারে অংশগ্রহণ করেন। প্রবাসীদের মধ্যে জনমত গঠনে পালন করেন অবিচল ভূমিকা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়পর্বটিকে তিনি দেখেছেন খোলা চোখে, খোলা মনে এবং নানা দৃষ্টিকোণ থেকে। শওকত ওসমান তাঁর এই দিনলিপিতে সেসব কথা কিংবা ঘটনা তারিখওয়ারি, কখনোবা ফ্ল্যাশব্যাকের আশ্রয়ে তুলে ধরেছেন।

প্রিয় পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই যে, লেখকের এই দিনলিপি বা স্মৃতিলিপি—যার নাম স্মৃতিলিপি ১৯৭২—মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হয়ে শেষ হয়েছে একই বছরের জুলাই মাসে এসে। অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ৭ মাসের স্মৃতিকে আধার করেই তাঁর এ বইয়ের জন্ম।

স্মৃতিলিপি ১৯৭২, শওকত ওসমান, প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০১৯, ১০৩ পৃষ্ঠা, দাম: ২০০ টাকা।
স্মৃতিলিপি ১৯৭২, শওকত ওসমান, প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০১৯, ১০৩ পৃষ্ঠা, দাম: ২০০ টাকা।

ব্যক্তির স্মৃতিকথা, দিনলিপি বা ডায়েরির আকারে লেখা বিবরণ যে ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য উপাদান হয়ে উঠতে পারে, তার ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে। এ বইও সেই কাতারে শামিল হওয়ার যোগ্য। শওকত ওসমান ১৯৭২ সালের ১৫ জানুয়ারি দেশে ফেরেন বিমানযোগে। তার আগ পর্যন্ত সময়ের বিবরণ থেকে আমরা জানতে পারি গভীর নাড়ির টানে তাঁর জন্মস্থান সবলসিংহপুর গ্রামে যাওয়ার কথা, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার কথা। এসব বিবরণের পাঠ পাঠককে স্মৃতিমেদুর না করে পারবে না। খোলাখুলিভাবে তিনি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশ থেকে কলকাতায় আশ্রয় নেওয়া সেই সব মানুষের কথা, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের ধারেকাছে যাওয়া তো দূরের কথা, যে আয়েশি জীবন যাপন করেছেন, তার বিবরণ পাঠে বমির উদ্রেক হয়। আবার বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সাহসী, মানব দরদি সাংবাদিক টনি মাসকারেনহাসের ভূমিকার কথা শওকত ওসমান এতটাই অন্তরঙ্গভাবে তুলে ধরেছেন যে পড়তে পড়তে মন উদ্বেল হয়ে ওঠে।

বিবরণের পর বিবরণ। দেখার ও বিশ্লেষণের প্রখর চোখ ও মন ছিল শওকত ওসমানের। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস যেসব বুদ্ধিজীবী, লেখক দেশের ভেতরে থেকে সুবিধাবাদের পথ বেছে নিয়েছিলেন, তিনি উন্মোচন করেছেন তাঁদের মুখোশ। দেশের রাজনৈতিক দলাদলির উল্লেখ করে তিনি শঙ্কিত হয়েছেন। আছে সেই বিবরণও। স্বজন ও মুক্তিযুদ্ধে অন্তরঙ্গজনদের হারানোর বেদনাও প্রকাশ পেয়েছে গভীর হাহাকারদীর্ণতায়।

শওকত ওসমানের এ বই শুধু ব্যক্তিগত স্মৃতি বা দিনলিপি নয়, আমাদের জাতীয় জীবনের একটি নির্দিষ্ট কালপর্বের ইতিহাসেরও অঙ্গীভূত অংশ।