লাঠিটা নজরুলের

>২৯ আগস্ট কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রয়াণ দিবস। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আয়োজন।

ঢাকায় কীভাবে সেবার এসেছিলেন নজরুল, সে গল্পটা বলেছেন প্রতিভা বসু, বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে বিয়ের আগে যাঁর নাম ছিল রানু সোম। ১৯২৮ সাল। কলকাতার গড়ের মাঠে ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগানের খেলা দেখতে গিয়েছিলেন কবি। খেলা শেষে খেলা নিয়েই বন্ধুর সঙ্গে বেদম তর্ক। প্রবল তর্কের ঘোরে কখন যে চলে এসেছেন শিয়ালদা রেলস্টেশনে, সে খেয়াল নেই তাঁর। যখন বুঝলেন, দেখলেন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা মেইল। ভাবলেন, মেইল ট্রেনটা যখন দাঁড়িয়েই আছে, তখন ঢাকা থেকে একটু ঘুরে আসি। ব্যস! আগুপিছু না ভেবে কাউন্টার থেকে টিকিট কিনে সোজা উঠে পড়লেন ট্রেনে। গন্তব্য ঢাকা। ঢাকায় আছেন কাজী মোতাহার হোসেন, তাঁর বন্ধু। থাকেন বর্ধমান হাউসে। নজরুল এসে উঠলেন তাঁর বাড়িতে।

তবে এ ব্যাপারে এটাও বলা হয়ে থাকে যে সেবার নজরুল এসেছিলেন মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে।

নজরুল তখন উজ্জ্বল কমলা রঙের মোটা পাঞ্জাবি, একই রঙের কাছা দেওয়া ধুতি, কাঁধে চাদর, মাথায় গান্ধি টুপিতে মজেছেন। তাঁর উপস্থিতি মানেই চারদিক গরম হয়ে ওঠা। দশ দিক কাঁপিয়ে তাঁর অট্টহাসি। পুরো বাড়ি সবাইকে নিয়ে তাঁর মতো মাতিয়ে তুলতে আর কে পারে।বর্ধমান হাউসের সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত বেগে নিচে নামছেন তিনি, কণ্ঠে গান। সিঁড়ির নিচে ততক্ষণে জড়ো হয়ে গেছে গুণগ্রাহীরা। সিঁড়ির একধাপ ওপরে নজরুল, নিচে দর্শক। এবার শুরু হতো ‘ওয়ান ম্যান শো’। নজরুল সে সময় নিজের ‘নারী’ কবিতা আবৃত্তি করতে পছন্দ করতেন। পছন্দ করতেন ‘মহুয়া’ গীতিনাট্যে নদের চাঁদের সংলাপ। আর প্রিয় ছিল রবীন্দ্রনাথের কবিতা, ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’। তারপর শুরু হতো গান।

মাছের শাড়ি আর হরিণ-মাছের প্রতিযোগিতার কথা নজরুল শুনেছিলেন এই বাড়িতেই। বড় টেবিলে সেদিন খেতে বসেছেন নজরুল ইসলাম আর মোতাহার হোসেন। কাজী মোতাহার হোসেনের বড় মেয়ে যোবায়দা মির্যা তখন ছোট। মাছের কাঁটা বেছে খেতে পারে না। বাড়ির ভেতর থেকে কাঁটা বাছিয়ে সে–ও খেতে বসেছে টেবিলে। তাঁর প্লেটে ছোট ছোট করে মাছের ভাগ। এক এক গ্রাসের সঙ্গে এক এক ভাগ খেতে হবে। যোবায়দা খায় আর বাবার প্লেটের দিকে তাকায়। তারপর বলে, ‘বাবা, তোমার প্লেট থেকে মাছের শাড়ি আর হরিণের মাংস দাও।’

নজরুল অবাক হয়ে যান! এর মধ্যে মাছের শাড়ি আর হরিণের মাংস এল কোত্থেকে? মাছের তেলতেলে চামড়াটা যে মাছের শাড়ি, সে কথা জেনে খুবই উল্লসিত হয়ে পড়লেন। আর হরিণ ও মাছের প্রতিযোগিতায় হেরে হরিণ মাছকে তার একটু মাংস কেটে দিয়েছিল, সেটাই যে চকলেট রঙের হয়ে মাছের গায়ে থাকে, সে কথাও নজরুল এখানেই প্রথম শুনলেন। ফলে যোবায়দার ভাগ্যে বাবার পাতের মাছের শাড়ি আর হরিণের মাংস তো এলই, আরও এল নজরুলের প্লেট থেকে। নজরুল বলেছিলেন, এ গল্প আমার চিরদিন মনে থাকবে।

নজরুল সেবার গান শিখিয়েছিলেন বেশ কয়েকজনকে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাঁদের নাম পাওয়া যায়, তাঁরা হলেন প্রিন্সিপাল সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের মেয়ে উমা মৈত্র (নোটন), মিস ফজিলাতুন্নেসার বোন শফিকুন্নেসা, ওয়ারীর রানু সোম (পরবর্তী সময়ে বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী প্রতিভা বসু)।

এই প্রতিভা বসুর বাড়ি থেকে ফেরার পথেই একবার নজরুল পড়েছিলেন গুন্ডাদের পাল্লায়।

ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার দুদিন আগে প্রতিভা বসুদের বাড়িতে বসেছিল গান আর কবিতার আসর। আসর ভাঙল একটু দেরি করে। সবাই যে যার মতো বাড়ি ফিরল। নজরুল রাতের খাবার খেলেন বলে একটু বেশি দেরি করে ফেললেন। রাত বেশি হয়েছে বলে প্রতিভার বাবা আশুতোষ সোম সাইকেলে করে গাড়ি ডেকে আনার প্রস্তাব করলেন। নজরুল তা আমলেই নিলেন না। বেরিয়ে গেলেন একা। প্রতিভার মা সরযূবালা সোম তাঁর স্বামীকে জানালেন, পাশের বাড়ির কিছু লোক আজ সন্দেহজনক আচরণ করেছে। ওখানে নাকি একজন গুন্ডার সরদারকেও দেখা গেছে। কথা যখন হচ্ছিল, তখন রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে ভেসে আসে কোলাহল। ওরা বুঝে ফেলেন, ঝামেলায় পড়েছেন নজরুল। প্রতিভার বাবা দৌড়ে বেরিয়ে যান। কিছুদূর এগোনোর পর দেখেন নজরুল ফিরে আসছেন। বনগ্রাম পেরিয়ে ঠাটারিবাজার মোড়ে যখন পৌঁছেছিলেন নজরুল, তখন সাত-আটটি ছেলে লাঠি, হকিস্টিক দিয়ে আঘাত করে নজরুলকে। আচমকা আঘাতে একটু বিহ্বল হলেও পরক্ষণেই একজনের হাত থেকে একটা লাঠি কেড়ে নিয়ে বোঁ বোঁ করে সেটি ঘোরাতে থাকেন নজরুল। যুদ্ধফেরতা মানুষটা বলতে থাকেন, ‘কে আসবি আয়, কটা আসবি আয়।’ এরপর ভয়ে পালিয়ে যায় ওরা।

সে রাতে কবিকে ওয়ারীর বাড়িতেই থেকে যেতে বললেন প্রতিভা বসুরা। কিন্তু নজরুল একেবারেই রাজি হলেন না। রানুর বাবাকে বললেন, ‘আপনার বাড়ি যাই বলে ওরা আমাকে মেরেছে। রানুকে নিয়ে অনেক কুৎসিত কথা বলেছে। এখন যদি আবার যাই, ওই শূকর সন্তানগুলো তো বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেবে।’

কিছুক্ষণ রানু সোমদের বাড়িতে বসে ওষুধ খেয়ে এবং ক্ষততে ওষুধ দিয়ে নজরুল সেই রাতেই বর্ধমান হাউসে ফিরে এলেন।

এদিকে বর্ধমান হাউসের সবাই উদ্বিগ্ন। নজরুল ফিরছেন না! অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থেকে ছোট যোবায়দা মির্যাও ঘুমিয়ে পড়েছে ততক্ষণে। গভীর রাতে নজরুলের কণ্ঠস্বরে ভেঙে গেল তার ঘুম। নজরুল তখন সবাইকে অভিনয় করে দেখাচ্ছেন, কী ঘটেছিল। যে লাঠিটা কেড়ে নিয়েছিলেন, সেটা নজরুলের সঙ্গে ছিল। সেই ঐতিহাসিক লাঠিটা ছিল বেশ মজবুত, ছড়ির মতো, মাথায় মুঠ পাকিয়ে ধরার উপযোগী গোল, চামড়া দিয়ে টাইট করে বাঁধানো, দেয়ালের পেরেকে ঝুলিয়ে রাখার জন্য চামড়ার একটা সরু ফিতে দিয়ে লুপ করা।

এই লাঠিটা যোবায়দাদের বাড়িতে অনেক দিন পর্যন্ত ছিল। গরু-ছাগল বাড়ির বারান্দায় উঠলে ওই লাঠি দিয়ে তা তাড়ানো হতো। লাঠিটার নাম হয়ে গিয়েছিল নজরুল-মারা লাঠি।

সূত্র: যোবায়দা মির্যার সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি ও প্রতিভা বসুর জীবনের জলছবি