দুঃসময়ের স্বপ্নসিঁড়ি

রিজিয়া রহমান (২৮ ডিসেম্বর ১৯৩৯–১৬ আগস্ট ২০১৯)। ছবি: খালেদ সরকার
রিজিয়া রহমান (২৮ ডিসেম্বর ১৯৩৯–১৬ আগস্ট ২০১৯)। ছবি: খালেদ সরকার
রিজিয়া রহমান শ্রদ্ধাঞ্জলি : বাংলাদেশের বলিষ্ঠ এক কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান প্রয়াত হয়েছেন ১৬ আগস্ট। উত্তর পুরুষ, রক্তের অক্ষর, বং থেকে বাংলার মতো তাঁর আরেকটি কালজয়ী উপন্যাস ধবল জ্যোৎস্না। তাঁর গদ্যও ছিল ধবল জ্যোৎস্নার মতো। এই লেখককে নিয়ে এ আয়োজন।
মৃত্যুর আগে ১৯৭১ সালের আত্মস্মৃতি লিখে গেছেন রিজিয়া রহমান। অপ্রকাশিত সেই পাণ্ডুলিপি থেকে এখানে ছাপা হলো তাঁর ২৫ ও ২৬ মার্চের আত্মস্মৃতির নির্বাচিত অংশ।

২৫ মার্চের রাতটি পৃথিবীর আহ্নিক গতির নিয়মানুবর্তিতা জেনেই বিদায় নিতে থাকে। রাতের শরীরে ফুটে উঠে ভোরের আভাস। মসজিদ থেকেই কেঁপে কেঁপে ভেসে আসে ফজরের আজান। আমাদের ঘরগুলোতে তবু কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকে অন্ধকার। পর্দা টানা ঘরে দিন-রাতের পার্থক্য বুঝে উঠি না আমরা। সেই ভোরে, বাড়ির পেছনের ঝাপড়ানো শিরীষ গাছে পাখিরা ডেকে উঠেছিল কি না জানি না, সেদিন কি শহরের হতভম্ব কাকেরা কা-কা করে ডেকে ভোরের জানান দিয়েছিল? অথবা পথের বেওয়ারিশ কুকুরেরা ফুটপাতের আনাচ-কানাচে ডাস্টবিনের পাশে মরা মানুষের লাশের কাছে অসহায় ভঙ্গিতে ঘোরাঘুরি করেছিল? কিছুই জানতে পারিনি আমরা। আমাদের চেনতাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল দুর্বোধ শব্দের আতঙ্ক। সেদিন গোটা ঢাকা শহরটি হয়তো মৃতপুরীর মতো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, অবশ্য দূরে এবং কাছে তখনো থেকে থেকে ধমক দিয়ে চলেছিল মারণাস্ত্রের কঠিন শব্দ।

তখনো আমরা ধারণাই করতে পারিনি, কী ভয়ংকর বিপর্যয় ঘটে গেছে এই শহরে (১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা—স্বজনের মৃত্যু কিংবা মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার দুঃসহ স্মৃতি এখনো অনেকেই বহন করছেন)। সে সময়ের স্মৃতি এখনো দুঃস্বপ্নের মতো আমাদের তাড়িত করে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সেই রাতে অথবা পরবর্তী ৯ মাসের যেকোনো সময়ে আমরাও তো পাকবাহিনীর নৃশংস গণহত্যার শিকার হতে পারতাম, অথবা একাত্তরে ইজ্জত হারিয়ে বীরাঙ্গনার দুঃসহ সম্ভ্রমহীন জীবন কাটাতে পারতাম। দুঃখের সঙ্গেই স্মরণ করি সেই দিনটিকে—স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর, যে দিনটিতে জাতির কান্ডারি শেখ মুজিবুর রহমান ধর্ষিত নির্যাতিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব দিয়েছিলেন, বীরাঙ্গনা অর্থাৎ বীর নারী সম্বোধনে সম্মান জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে তাঁদের অবদানের উল্লেখ করেছিলেন। তিনি সেদিন এই দুর্ভাগা নারীদের অবস্থান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে একই সারিতে ঘোষণা করেছিলেন।

বলতে দ্বিধা নেই, আমরা অকৃতজ্ঞ এবং কুসংস্কারের শিকলে বন্দী স্মৃতিভ্রষ্ট এক জাতি, মহান নেতার মহৎ সেই উদ্দেশ্যকে আমরা গুরুত্ব দিতে পারিনি। যে কারণে ‘বীরাঙ্গনা’ সম্মানসূচক খেতাবপ্রাপ্ত বীর নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্য সম্মান অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ঘরে–বাইরে, পরিবারে, সমাজে ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দটি হয়ে গেছে যুদ্ধে দখলকার সৈনিক ও যুদ্ধাপরাধী দেশদ্রোহীদের দ্বারা নির্যাতিত-ধর্ষিত নারীদের পরিচয়ের সংজ্ঞার মতো। দেশ ও সমাজ কখনোই তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করেনি, বরং তাঁদের জন্য নির্ধারিত হয়েছে অপমান, লাঞ্ছনা ও অপবাদ। পরিবারও তাঁদের পরিচয় গোপন করতে বাধ্য হয়েছে (নিশ্চয় প্রিয়ভাষিণীর মতো সাহসী হওয়ার পরিবেশ ও প্রেরণার সুযোগ অনেকেই পাননি)।

বাংলাদেশের অতীত ইতিহাসেও এমন অনেক নারীর অপমানিত জীবনগাথা আজও নীরবে অশ্রুপাত করে চলেছে। পর্তুগিজ-হার্মাদ বা মগ জলদস্যুদের হানায় যে বাঙালি নারীরা ধর্ষিত নির্যাতিত হতেন, সমাজে তাঁরা হয়ে যেতেন অসতী, কুলটা, কলঙ্কিনী, অস্পৃশ্য। ‘মগা-নারী’ আখ্যায় তাঁদের একঘরে করে দেওয়া হতো। এই হতভাগিনীরা স্বাভাবিক সমাজজীবন হারিয়ে দুঃখ-বেদনায়, অভাবে-লাঞ্ছনায় অপমানিত জীবনযাপন করতেন, লোকালয় থেকে দূরে।

কয়েক শতাব্দী পেরিয়ে একটি গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পরেও আমাদের মানসিকতায় মধ্যযুগীয় সেই কুসংস্কারকে আমরা নির্মূল করতে পারিনি। তাই আমাদের সেই বীর নারীরা ‘বীরাঙ্গনা’র প্রকৃত সম্মান থেকে বঞ্চিত হয়ে অনেকেই মানবেতর জীবন অতিবাহিত করে গেছেন এবং এখনো করছেন। হয়তো সেই কারণেই হানাদারের হামলায় বীরাঙ্গনা হতে হয়নি বলে নিজেকে ভাগ্যবতীই মনে করেছি।

২৫ মার্চের সেই রাত থেকে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সময়টি দেশের কিশোরী–তরুণী কিংবা যুবতী অথবা মধ্যবয়সী নারীদের জন্য ছিল ধর্ষিত হওয়ার আশঙ্কায় ভরা, যা ছিল মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ। ২৬ মার্চের সেই ভৌতিক ভোরটিতেও গণহত্যা বা নারীর প্রতি নির্যাতিত নৃশংস নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে ছিলাম একেবারেই অজ্ঞ।

আমাদের সেই বিভ্রান্তি আর আতঙ্কে সাহস দেওয়ার জন্যই যেন জানালায় এসে মুখ বাড়ায় সকালের প্রথম আলো। কার্তিকের মা–ও (লেখকের গৃহকর্মী) তার দৈনন্দিন কর্তব্যে বিন্দুমাত্র অবহেলা করে না। টেবিলে সাজিয়ে দেয় সকালের নাশতা। সেই মুহূর্তে, গতরাতে একটি দুঃস্বপ্ন দেখেছি ভাবতে পারলে বেঁচে যেতাম। কিন্তু সেই উপায় ছিল না, বাতাসে তখনো ভাসছে বারুদের গন্ধ, তখনো ক্ষান্ত হয়নি স্বয়ংক্রিয় মারণাস্ত্রের হুমকি, অস্ত্র উঁচিয়ে বড় রাস্তায় ঘোরাফেরা করছে আর্মির ট্রাক ও জিপ। মীজানুর রহমান (লেখকের স্বামী) ভোর থেকেই ট্রানজিস্টর রেডিওর মিটারের কাঁটা ঘুরিয়ে চলেছে। সেই রেডিও মারফতই সকাল ৮টার পরে পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল টিক্কা খানের ঘোষণা এসে যায়। জানতে পারি, আজ ভোর থেকে কার্ফু জারি করা হয়েছে। পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত কার্ফু জারি থাকবে।

আরও জেনে যাই, খুব সহজ কার্ফু জারি করা হয়নি। পথে নামলে দেখামাত্র গুলি করবে টহলরত অস্ত্রধারী পাকিস্তান আর্মির সদস্যরা।

ঘট করে রেডিওর নব টিপে বন্ধ করে দিল ‘বুচার অব বেলুচিস্তান’ নামে কুখ্যাত জেনারেলের উদ্ধত ঘোষণা। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে দিল এ দেশে পাকিস্তানের মৃত্যু হলো আজ।

মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের নিয়মানুবর্তিতায় আমাদের দুর্ভাগা পৃথিবী আর একবার শেষ করে আহ্নিক গতির আবর্তন। একসময় শেষ হয় ১৯৭১–এর ২৫ মার্চের অবিশ্বাস্য রাতটিরও। ভোরের অস্পষ্ট আলোর আভা জেগে ওঠে পর্দা টানা জানালায়। সারা রাত ঘুম ছিল না আমার আর কার্তিকের মায়ের চোখে। শেষ রাতে জেগে উঠবার পর মীজানুর রহমানও আর ঘুমিয়ে পড়েনি। মনে হচ্ছিল গত রাতটি বোধ হয় ছিল ভয়ংকর কোনো দুঃস্বপ্নের। যেন সত্যি নয়, ঘুম ভাঙলেই মিলিয়ে যাবে দুঃস্বপ্ন। জেগে উঠবে অন্য দিনের মতোই একটি নিরাপদ স্বাভাবিক সকাল।

ঘরের ভেতরে তখনো অন্ধকার কাটেনি। ছোট্ট তপু (লেখকের ছেলে) গুটিসুটি হয়ে মেঝেতে ঘুমোচ্ছে। আলী হোসেন (লেখকের স্বজন) যথারীতি নিশ্চিন্ত ঘুমে অচেতন। এরই মধ্যে মসজিদ থেকে ভেসে আসে ফজরের আজান। ‘নিদ্রা অপেক্ষা প্রার্থনা উত্তম’—ফজরের নামাজের শেষে সেদিন কী বলেছিলাম আল্লাহকে জানি না। হয়তো চেয়েছিলাম ২৫ মার্চের ভয়ংকর রাতটি যেন সত্যি না হয়, যেন রাতের দুঃস্বপ্নের মতোই মিলিয়ে যায়।

ঘরের দেয়ালের দায়িত্বশীল ঘড়িটি সময় অতিক্রমের কাঁটা ঘুরিয়ে চলছিল অবিরত। আমরা কজন মানুষ তখন স্থবির অন্ধকারে বন্দী হয়ে আছি। ভয়াবহ শব্দের আতঙ্ক ছাড়া আর কিছুই যেন নেই চারপাশে। যেন এক হিংস্র বাঘের থাবায় নিরুপায় আত্মসমর্পণ করেছি। ক্রমে প্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতা মেনে প্রতিদিনের মতো সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ল শহরে। কাক ডাকল, বেলা বাড়ল, তখনো থেমে থেমে চলছে গোলাগুলির শব্দ।

কার্তিকের মা অন্য দিনের মতোই টেবিলে নাশতা সাজিয়ে দিয়েছে। ঘরের দরোজায় উঁকি দিয়ে বলে গেছে, ‘আফা, বেইল তো অনেক হইছে, নাশতা খাইতেন না?’ আমি জবাব দিইনি। ঘরের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছি, মীজানুর রহমান দুহাতের ভাঁজে মাথা রেখে ঘরের ছাদে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে শুয়ে আছে। তপু তখনো ঘুমুচ্ছে। ওকে আর ডাকি না। ভুলে যাই কয়েক দিন আগেও আমাদের ছিল কর্মব্যস্ত সকাল, ছিল কর্মময় দিনরাত।

চট্টগ্রাম থেকে এসে তপুকে ভর্তি করেছি নজরুল একাডেমির কিন্ডারগার্টেন শাখায়। ওর স্কুল শুরু হয় ৮টায়। সকালে উঠিয়ে ওকে স্কুলের জন্য তৈরি করি। বাথরুমে নিয়ে দাঁত ব্রাশ করানো, নাশতা খাওয়ানো, স্কুলের পোশাক পরিয়ে আলী হোসেনকে দিয়ে পাঠানো—এসব কাজেরও নানান ঝামেলা আছে।

প্রতিদিনই তপুর শিশুকণ্ঠে কলরব আর আমার ব্যস্ত কণ্ঠের শব্দে বাড়িটা হয়ে ওঠে সরব। তাড়াহুড়ো করে কাজ সারি। তপুর আব্বা মীজানুর রহমানের অফিস সকালেই। সাড়ে ৭টার মধ্যে তার নাশতা সারতে হয়। নাশতা শেষ হওয়ায় আগেই তার গাড়ি ধুয়েমুছে রেডি করতে হয়। এর মধ্যে আলী হোসেনকে তাড়া দিতে থাকি। মীজানুর রহমান নাশতা খেতে খেতেই সংসারের এবং আমার নিজস্ব প্রয়োজনীয় কথাগুলো সেরে ফেলি। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ঢাকায় আমার বদলির ব্যাপারে খোঁজ নিতে বলি। পরিকল্পনা কমিশনে চাকরির দরখাস্ত দিয়েছি, কবে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকবে জানা দরকার। ইপিআই ডিসির পরিকল্পনা শাখায় এখন পোস্টিং মীজানুর রহমানের। তার বিভাগীয় প্রধান রাজিয়া খানের বড় বোন কুলসুম হুদা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ছাত্রী ছিলাম, আমাকে চেনেন। অধীনস্ত কর্মকর্তা হিসেবে মীজানুর রহমানকে পছন্দ করেন। তিনিই পরিকল্পনা কমিশনে চাকরির জন্য আমাকে আবেদন করতে বলেছিলেন। ব্যাপারটা তিনি দেখবেন বলেও আশ্বাস দিয়েছিলেন। কুলসুম আপাকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য মীজানুর রহমানকে নাশতার টেবিলেই তাগাদা দিই।

এই একাত্তরের উদ্‌ভ্রান্ত সকালটিতে সেই সব ব্যস্ততা যেন দূরের কোনো ঘটনা হয়ে গেছে। উত্তাল মার্চের ঢেউ হঠাৎই স্তব্ধ হয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে। নাশতার টেবিলে সেদিন বসেছিলাম কি না মনে পড়ে না। তপুর স্কুলে যাওয়াও নেই। সে এলোমেলো এঘরে–ওঘরে ঘুরছিল। মাঝেমধ্যেই প্রশ্ন করছিল, আমরা ঘরের দরোজা জানালা খুলছি না কেন? তার স্কুলের অধ্যক্ষ ছুটি দিয়ে দিয়েছেন কি না, বাবা কেন আফিসে যায়নি ইত্যাদি।

তাকে বলতে হয়েছে, বাইরে গোলাগুলি হচ্ছে। সে যেন দরোজা খুলে বাইরের বারান্দায় না যায়। তপুর প্রশ্ন থামে না, জিজ্ঞেস করে, কেন গোলাগুলি হচ্ছে?

বলি, যুদ্ধ হচ্ছে তো তাই! পাকিস্তানিরা গুলি করছে।

তপু বুঝে নেয়। বলে, জয় বাংলা আর পাকিস্তানির যুদ্ধ হচ্ছে, তাই না আম্মা?

অন্য সময় হলে তপুকে অনেক কিছু বোঝাতাম। এখন শুধু বললাম, এত কথা বলতে হবে না, যাও, ও ঘরে বসে তোমার গাড়ি নিয়ে খেলো। একেবারে জোরে চেঁচামেচি করবে না। তাহলে পাকিস্তানিরা এসে আমাদের গুলি করবে। তপু চলে গেল পাশের ঘরে। তখনো থেমে থেমে দূরে-কাছে গুলির শব্দ হচ্ছে।

কার্তিকের মা এর মধ্যেই আমাকে দুবার চা দিয়ে গেছে। চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে আমি আর মীজানুর রহমান অকল্পনীয় ঘটনার সম্ভাব্য কারণ খুঁজে বের করতে চেষ্টা করছি। বাইরের দরোজায় টোকা পড়ল। পলকে সারা বাড়ি সন্ত্রস্ত। তপুও খেলা ভুলে এসে দাঁড়াল আমার শরীর ঘেঁষে। দরোজা খুলল মীজানুর রহমান, শুকনো মুখে মেজবাহ সাহেব (লেখকের প্রতিবেশী) এলেন ভেতরে। বসার ঘরে এসে দাঁড়ালেন, জিজ্ঞেস করলেন, ‘রেডিও শোনেননি আপনারা?’

বোকার মতো মাথা নাড়লাম। বাড়িতে একটা ট্রানজিস্টর রেডিও আছে বটে। মীজানুর রহমান কিছুদিন আগে জার্মানি গিয়েছিল, নিয়ে এসেছে। সেটা শোনাই হয় না বলতে গেলে। আমি মাঝেমধ্যে ছুটির দিনে কাজের অবসরে অনুরোধের আসরের গান শুনি।

মীজানুর রহমানই জিজ্ঞেস করল মেজবাহ সাহেবকে, ‘কী হয়েছে বলুন তো, রেডিওতে কি কোনো খারাপ খবর আছে?’

মেজবাহউদ্দীন প্রথমেই বেঈমান বলে গালি দিলেন ইয়াহিয়াকে তারপর ভুট্টোকে। এরপর বললেন, ‘ইয়াহিয়া কুত্তার বাচ্চা, নেকেড মার্শাল ল ঘোষণা করেছে। সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ। আওয়ামী লীগের বাড়াবাড়ি এবং দেশে অসহনীয় বিশৃঙ্খলা তারা বরদাশত করবে না। শেখ মুজিবুর রহমানকেও শাস্তি দেওয়া হবে।’

নিরুদ্ধ ক্রোধে ছটফট করেন মেজবাহ সাহেব, ‘শালারা কাল রাতে কার্ফু ছাড়াই ঢাকা শহর গরাদ করেছে। এখন আবার কার্ফুয়ের এলান দিচ্ছে।’

মেজবাহ সাহেব চলে যাবার পরে মীজানুর রহমান ট্রানজিস্টর রেডিও নিয়ে বসল। কাঁটা ঘুরিয়ে চলল নানা দেশের রেডিও স্টেশনগুলোতে।

ইয়াহিয়া খানের সেই কুখ্যাত জঘন্য মিথ্যাচারে ভরা বক্তব্যটি আমরা শুনেছিলাম। শুনেছিল সেদিন ঢাকা শহরে বেঁচে যাওয়া সব মানুষেরা। আমরা কি ভয় পেয়েছিলাম? সেই কদর্য মিথ্যাচার শুনে পরাজিত শত্রুর মতো নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেছিলাম? কখনোই নয়। আমরা বিদ্রোহী ছিলাম কি? আমরা চেয়েছিলাম ন্যায্য হিস্যা। আমরা ভাতের, ভোটের আর ভাষার দাবি জানিয়েছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম স্বাধিকার—স্বায়ত্তশাসন। অবশেষে অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে স্বাধীনতার উজ্জ্বল সূর্য আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানই তখন জাদুকর হয়ে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, ডাক দিয়েছিলেন। স্বপ্নের সিঁড়িটি ছিল তাঁরই হাতে।

যুদ্ধ সেদিনই তৈরি হয়েছিল আমাদের বুকের ভেতরে। ১৯৭১-এর পরের প্রজন্ম যেন ধরে না নেয় এটা লেখার খাতিরে লেখা, যেন মনে না করে এ শুধু আবেগের স্মৃতিচারণা। দীর্ঘ ৪৫ বছর আগের সেই কুখ্যাত বক্তৃতা ও মার্শাল ল-এর অনিশ্চিত কার্ফু ঘোষণার কথা মনে হলে বুকে একাত্তরের মতোই জ্বলে উঠে প্রত্যাঘাতের আগুন।

২৫ মার্চের রাত থেকে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ রক্তের ওপরে হেঁটে, ভয়–আতঙ্ক, স্বজন হারানো আর সম্পদ হারানোর শোককে জয় করতে পেরেছিল প্রথম প্রহরের প্রত্যাঘাতের আগুন জ্বলে উঠবার কারণেই। তবে তখনো গৃহবন্দী আমরা অনেকেই জানতে পারিনি রক্তাক্ত ঢাকা শহরের কথা, বুঝিনি ঢাকার বাতাস মানুষের মাংস পোড়া গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছে।

২০২০ সালের একুশে বইমেলায় আত্মস্মৃতিটি ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ থেকে দুঃসময়ের স্বপ্নসিঁড়ি শিরোনামে বই আকারে প্রকাশিত হবে।