শাড়ি

শিল্পীদের রিকশা চিত্রকলায় দারুণভাবে ফুটে ওঠে শাড়ির নান্দনিকতা
শিল্পীদের রিকশা চিত্রকলায় দারুণভাবে ফুটে ওঠে শাড়ির নান্দনিকতা
>বাঙালি নারীর কাছে শাড়ি তার সারা শরীর জড়িয়ে রাখা এক কাপড়ের একটা দীর্ঘ স্বপ্নখচিত জড়োয়া গয়না। যুগে যুগে এই পোশাককে বিচিত্র শব্দে–বর্ণে মহিমান্বিত করেছেন লেখক–সাহিত্যিকেরা। তবে বর্তমানে নারীদের মধ্যে কমে গেছে শাড়ি পরার চল। শাড়ি নিয়ে বিশেষ এ আয়োজনে লিখেছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। 

শাড়ি পৃথিবীর সবচেয়ে যৌনাবেদনপূর্ণ অথচ শালীন পোশাক। শুধু শালীন নয়, রুচিসম্পন্ন, সুস্মিত ও কারুকার্যময় পোশাক। নারী শরীরকে যতটুকু অনাবৃত রাখলে তা সবচেয়ে রহস্যচকিত হয়ে ওঠে, পোশাক হিসেবে শাড়ি তারই উপমা। শরীর আর পোশাকের ওই রমণীয় এলাকা বিভাজনের অনুপাত শারীর রচয়িতারা কি জেনে না না–জেনে খুঁজে পেয়েছিলেন, সে কথা বলা না গেলেও এর পেছনে যে গভীর সচেতন ও মুগ্ধ শিল্পবোধ কাজ করেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। আধুনিক শাড়ি পরায় নারীর উঁচু-নিচু ঢেউগুলো এমন অনবদ্যভাবে ফুটে ওঠে, যা নারীকে করে তোলে একই সঙ্গে রমণীয় ও অপরূপ। শাড়ি তার রূপের শরীরে বইয়ে দেয় এক অলৌকিক বিদ্যুৎ হিল্লোল। 

না, সব দেশের মেয়েদের শাড়িতে এমন অপরূপ লাগবে না। পৃথিবীর কোনো কোনো এলাকার নারী শরীরেই কেবল শাড়িতে এ অলীক রূপ ফুটে ওঠে, বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রিয়দর্শিনী সুকুমারী তন্বীদের দেহবল্লরীতে—সে বাংলা, পাঞ্জাব বা উত্তর ভারতের—যেখানকারই হোক। বিশালদেহী আফ্রিকার নারীর জন্য এ পোশাক নয়, জার্মান বা ইংরেজ নারীর উদ্ধত সৌন্দর্যেও এ পোশাক হয়তো খাপ খাবে না। শাড়ি সুকুমার ও নমনীয় শরীরের জন্যই কেবল সত্যিকার অর্থে মধুর। হয়তো উপমহাদেশের বাইরে একধরনের মঙ্গোলীয় নারীকেও শাড়িতে ভালো লাগবে তাদের শারীরিক কমনীয়তার জন্য। কিন্তু পোশাকটি তাদের ভেতর প্রচলিত নয় বলে সে কথায় এখন যাব না। এটি ভালো লাগে বিপুলসংখ্যক উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয় মেয়েদের। যদি বাঙালি মেয়েদের প্রশ্ন ওঠে তবে বলব, এটি ভালো লাগে প্রায় প্রত্যেকটি বাঙালি মেয়েকে। সত্যি কথা বলতে কি, অধিকাংশ বাঙালি মেয়েকে শাড়ি ছাড়া আর হয়তো কিছুতেই মানায় না। এ জন্য তাদের প্রকৃতিগত পোশাক—তাদের সহজাত রূপের অংশ। 

কেন, তা নিয়ে একটু ভাবা যাক। 

কোনো এক কবিতায় কবি ওমর আলী লিখেছিলেন, ‘এ দেশের শ্যামল রং রমণীর সুনাম শুনেছি।’ কেন এই শ্যামল নারীদের রূপের এত সুনাম? এর কারণ তিনি ব্যাখ্যা করে বলেননি, কিন্তু তাই বলে গড়পড়তা বাঙালি নারী রূপের দিক থেকে পৃথিবীর সেরা সুন্দরীদের মধ্যে পড়ে এ বললেও যেন কিছুটা বেশি শোনাবে। বাঙালি পুরুষদের ব্যাপারেও হয়তো তা–ই। ইংল্যান্ডের কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: এখানে রাস্তায় বেরোনোর বড় সুবিধা যে থেকে থেকেই সুন্দর মুখ দেখতে পাওয়া যায়। বাঙালি জাতির বেলায় কথাটা হয়তো ওভাবে খাটবে না। তবে মাঝে মাঝে এ দেশেও যে এক–আধজন সুন্দর মুখের দেখা পাওয়া যায় না, তা–ও নয়। তবে একটিমাত্র কারণেই কেবল তা হতে পারে; যদি তারা তাদের কমনীয় শাড়িগুলোকে নান্দনিক বা সুরুচিসম্মতভাবে পরতে পারে। রবীন্দ্রসংগীতের সুরের সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীতের অনিন্দ্য কথা যোগ হলে যা হয় আমাদের প্রিয়দর্শিনী ললনারা তখন তা–ই হয়ে যায়। 

কামরুল হাসানের চিত্রকর্ম ‘উঁকি’তে দেখা যায় বাঙালি নারীর শাড়ির সৌন্দর্য
কামরুল হাসানের চিত্রকর্ম ‘উঁকি’তে দেখা যায় বাঙালি নারীর শাড়ির সৌন্দর্য

বাঙালি সৌন্দর্যের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা: আমার ধারণা ‘উচ্চতা’। সবচেয়ে কম যে উচ্চতা থাকলে মানুষকে সহজে সুন্দর মনে হয়—যেমন পুরুষের ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি ও মেয়েদের ৫ ফুট ৫ বা ৬ ইঞ্চি—আমাদের গড় উচ্চতা তার চেয়ে অন্তত ২–৩ ইঞ্চি কম। দৈহিক সৌন্দর্য ছেলেদের বড় ব্যাপার নয় বলে এ নিয়েও তারা কোনোমতে পার পেয়ে যায়। কিন্তু আটকে যায় মেয়েরা। আমার ধারণা, একটা মেয়ের উচ্চতা অন্তত ৫ ফুট ৪–এর কম হলে তার শরীরে নারীজনিত গীতিময় ভঙ্গি পুরোপুরি ফুটে ওঠে না। এরপর তাদের দৈর্ঘ্য ৫ ফুট ৫, ৬ বা কিছু পরিমাণে ৭ ইঞ্চি পর্যন্ত উঠলে তা ক্রমাগত অলীকতর হয়ে উঠতে থাকে।

বাঙালি মেয়েরা বিপদে পড়ে এখানটাতেই। এদের গড় উচ্চতা ৫ ফুট ২ থেকে ৩ ইঞ্চির সামান্য এদিক–ওদিকে (অবশ্য ১০ শতাংশ মেয়েকে বাদ দিয়ে ধরলে)। এই উচ্চতা নিয়ে ললিত–মধুর ও দীর্ঘাঙ্গী নারীর কমনীয় শরীর নিয়ে ফুটে ওঠা কঠিন, যা দেখা যায় এই উপমহাদেশের উত্তর দিকের নারীর উন্নত দেহসৌষ্ঠবে। ওই অঞ্চলের মেয়েদের তুলনায় বাঙালি মেয়েদের আরও একটা জায়গায় ঘাটতি আছে। মনে রাখতে হবে, বাঙালিরা একটু বেশি রকমের মিশ্র জাতি। নানা জাতির দৈহিক বৈশিষ্ট্য এ জাতির মানুষের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গে অমিলভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। কিছুটা অবিন্যস্তভাবে, তাই বাঙালি মেয়েদের দেহ গঠন উপমহাদেশের উত্তরাংশের মেয়েদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অসম। যেকোনো অসমতাকে আড়ালে রেখে মানসম্মত দেহসৌষ্ঠব নিয়ে দাঁড়ানোর পথ একটাই—ইংরেজিতে যাকে বলে মেকআপ—যার গভীরতর মানে মেকআপ দ্য লস। শারীরিক অসমতার এত ঘাটতি থাকার পরও অন্যান্য মেকআপের মতো রূপকে নিটোলতা দেওয়ার মতো এক অনন্য সাধারণ মেকআপ রয়েছে বাঙালি মেয়েদের ভাঁড়ারে। আমার মতে, এর নাম ‘শাড়ি’। আগেই বলেছি, উচ্চতার কারণে উপমহাদেশের উত্তরাংশের গড়পড়তা মেয়েদের শাড়ি বা সালোয়ার–কামিজ দুটোতেই ভালো লাগে। কিন্তু ওই কাম্য উচ্চতার অভাবে বাঙালি মেয়েদের শাড়ি ছাড়া আর যেন কোনো গতিই নেই। আজ বাঙালি মেয়েরা সেই শাড়িকে প্রায় ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিচ্ছে। আজকাল শাড়ি ছাড়া অনেক রকম কাপড় পরছে তারা—সালোয়ার–কামিজ তো আছেই, পাশ্চাত্য ফ্যাশনের কাপড়ও কম পরছে না—এবং পরার পর ইউরোপ বা ভারতের ওই সব পোশাক পরা সুন্দরীদের সমকক্ষ ভেবে হয়তো কিছুটা হাস্যকর আত্মতৃপ্তিও পাচ্ছে। 

আমরা যেন না ভুলি যে এসব পোশাক বাঙালি মেয়েদের দেহ গঠনের একেবারেই অনুকূল নয়। দেহভঙ্গিমারও না। বাঙালি মেয়েদের উচ্চতার অভাবকে আড়াল করে তাদের প্রীতিময় ও কিছুটা তন্বী করে তুলতে পারে একমাত্র শাড়ি। মেয়েরা শাড়ি পরে মাথা বা কাঁধ থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত। এভাবে শাড়িতে শরীর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যেকোনো মেয়ের রূপে কমবেশি দীর্ঘাঙ্গি বিভ্রম দেখা দেবেই, ঠিক যে কারণে দীর্ঘ পাঞ্জাবি বা শেরওয়ানি পুরুষদের শরীরে দীর্ঘদেহিতার বিভ্রম জাগায়। এতে সঠিক উচ্চতার তুলনায় তাদের কিছুটা বেশি দীর্ঘ লাগে। মেয়েদের ব্যাপারেও তা–ই। ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার মেয়েদের ভুল করে এভাবে মনে হতে পারে ৫ ফুট ৪ ইঞ্চির মেয়ে! আর সেই সঙ্গে তাদের চিরস্থায়ী হাইহিলের উচ্চায়ত রহস্য তো রয়েছেই। 

প্রচ্ছদ: সাব্যসাচী মিস্ত্রী
প্রচ্ছদ: সাব্যসাচী মিস্ত্রী

শাড়ি একটা রহস্যময় পোশাক। নারী দেহকে কতটা প্রদর্শন করলে আর কতটা অপ্রকাশিত রাখলে তা শারীরিক মোহ বজায় রেখেও দর্শকের চোখে অনিন্দ্য হয়ে উঠবে, তা পোশাকটি যেন সহজাতভাবেই জানে। 

শাড়ি ছাড়া এমন জাদুকরি রহস্য আর পরস্পরবিরোধী মাধুরী আছে কোন পোশাকে? শরীর নিয়ে এমন শিল্পিত খেলা আর কে খেলতে পারে? সালোয়ার-কামিজ, টাইট জিনস, মিনি স্কার্ট কি এর সমকক্ষ? শেষেরগুলো তো প্রায় পোশাক না থাকারই শামিল। জাপানি কিমোনোর রং ওদিকে আবার বেশি রকম উচ্চকণ্ঠ। শরীরের সহজাত মাধুর্যকে এ প্রায়শই ছাপিয়ে যায়। বাকি পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই পোশাক হয় শরীরটাকে রমণীয় গুদামঘর বানিয়ে রাখে, নয়তো প্রায় বিবসনা করে রগরগে যৌনতার মৌতাত উদ্​যাপন করে। 

শাড়ির মধ্যে আছে এই দুইয়ের মিলিত জাদু। এ সৌন্দর্যের লালসাকেও বাদ দেয় না আবার আলোয়–ছায়ায়, মেঘে-রৌদ্রে শরীরকে যেন স্বপ্নরাজ্য বানিয়ে দেয়। 

আগেই বলেছি, নানা জাতির দৈহিক বৈশিষ্ট্য একত্র হওয়ায় বাঙালির শরীর অধিকাংশ সময় সুগঠিত নয়। এই ত্রুটিকেও শাড়ির রুচি স্নিগ্ধ–শৈল্পিক আব্রুর মধ্যে এনে যেন বাঙালি মেয়েকে প্রাণে বাঁচিয়ে দেয়। 

তাদের শরীরের অসম অংশগুলোকে লুকিয়ে ও সুষম অংশগুলোকে বিবৃত করে শাড়ি এই দুর্লভ কাজটি করে। 

শাড়ির আরেকটা দিক আছে, যা দীর্ঘ বা মধ্যম উচ্চতার সব মেয়েকেই প্রিয়দর্শিনী করে তোলে। সেটা হলো এর সহজ প্রীতিময়তা। 

কোনো মেয়ে শাড়িতে সুন্দর হয়ে উঠতে চাইলে তার শরীরকে শাড়ির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য তাড়াহুড়ো করতে হয় না। বিনীত শাড়িই তার কোমলতা দিয়ে ওই শরীরকে সৌন্দর্যে ফুটিয়ে তোলার দায়িত্ব নিয়ে নেয়। শাড়ি সারা শরীর জড়িয়ে রাখা এক কাপড়ের একটা দীর্ঘ স্বপ্নখচিত জড়োয়া গয়না। বৈচিত্র্যে, সৌন্দর্যে কারুকার্যে প্রায় তুলনাহীন। আমাদের সোনালি ধানখেতগুলো যেন গোটা বাংলাদেশকে নানান বাঁকে জড়িয়ে দেশজুড়ে বয়ে যায়, শাড়িও তেমনি নারীর শরীরে সৌন্দর্যের প্রতিটি ঢেউ আর সরণিকে আঁকাবাঁকা, উঁচু-নিচু ভঙ্গিতে বিন্যস্ত করে আঁচলের কাছে এসে একঝাঁক সাদা পায়রার মতো নীল আকাশে উড়তে থাকে। 

শাড়ি বা কিমোনোর মতো ঐতিহ্যময় পোশাককে হটিয়ে সালোয়ার-কামিজ, স্কার্ট, মিনি স্কার্ট, ট্রাউজার, শার্ট যে একালের মেয়েদের মন কাড়ল তার কারণ এই নয় যে শাড়ি বা কিমোনো পোশাক হিসেবে ভালো নয়, এর কারণেই কর্মব্যস্ত ঊর্ধ্বশ্বাস যুগের অকর্ষিত রুচি চাহিদা। জীবন প্রয়োজনের ক্লেদাক্ত চাপ শিল্পকে হটিয়ে দিয়েছে। এ যুগ সৌন্দর্যের পরিশীলনকে জানে না। সে বোঝে শুধু একটা জিনিস; লেস ইজ মোর। এই লেসের আক্রমণে মানুষের পোশাকরুচি তার শরীরের সমস্তরে নেমে গেছে।

আমার মনে হয়, এ রকম একটা অপরূপ পোশাককে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে বাঙালি মেয়েরা সুবুদ্ধির পরিচয় দেয়নি।