পুরোনো দিনের খোঁজে

প্রচণ্ড ঝড়ের পর উনিশ শতকের কলকাতা শহরের দশা, ১৮৬৪ সালের ১৯ নভেম্বর সাপ্তাহিক ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ পত্রিকায় অজ্ঞাতনামা ইংরেজ শিল্পীর আঁকা এচিং
প্রচণ্ড ঝড়ের পর উনিশ শতকের কলকাতা শহরের দশা, ১৮৬৪ সালের ১৯ নভেম্বর সাপ্তাহিক ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ পত্রিকায় অজ্ঞাতনামা ইংরেজ শিল্পীর আঁকা এচিং

বিদেশি ঔপনিবেশিক শাসনের লুণ্ঠন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হয়েছিল দেশি মানুষ। উপনিবেশকে পাকাপোক্ত করতে বিদেশিরা দেশিদের ওপর বিদেশি ভাষা, সংস্কৃতি, আদবকেতা ও খাদ্যাভ্যাস চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। তার প্রতিক্রিয়ায় দেশিরাও আঁকড়ে ধরেছিল নিজেদের ঐতিহ্য।

মুহিত হাসানের দিশি ও বিলাতি নিবন্ধগ্রন্থের ‘দিশি’ মূলত ব্রিটিশ উপনিবেশে থাকা বাঙালি। তার সঙ্গে ‘বিলাতি’ ব্রিটিশের দ্বন্দ্বের কিছু চিত্র বইয়ে পাওয়া যায়। কিন্তু তার চেয়ে বেশি পাওয়া যায় দিশি-বিলাতির পরস্পর সম্পর্কে দৃষ্টিকোণ। 

ঔপনিবেশিক বাংলার পরিবেশ-প্রকৃতি নিয়ে বিলাতি নানা বর্ণনার কথাই ধরা যাক না! প্রথমে ব্যবসা, পরে শাসনের নামে লুণ্ঠন চালাতে এসে ব্রিটিশদের বেশ নাস্তানাবুদ হতে হয়। এর মূল কারণ ইউরোপ ও এ অঞ্চলের প্রকৃতি-পরিবেশের আচরণগত বড় তফাত।

বিদেশি পত্রপত্রিকায় কিছুকাল আগেও তো বাংলাদেশের খবর বলতে ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি আর প্রাণহানির কথা। এর উৎস সম্ভবত ঔপনিবেশিক আমলে বাংলার ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, দাবদাহের ব্যাপারে সাহেব-মেমদের ভাষ্যগুলো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক এ ভাষ্যগুলো তুলে ধরা হয়েছে তিনটি নিবন্ধে।

ব্রিটিশদের আদবকেতার বহু জিনিস বাঙালি গ্রহণও করেছিল। সময়মতো সেসব আবার ব্যবহার করেছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধেই। এর একটি হলো ভোট। এখন যে ধারার ভোটে আমরা অভ্যস্ত হয়েছি, তা মূলত ইংরেজরাই এ অঞ্চলে প্রথম চালু করে।

ভোটবিষয়ক নিবন্ধটিতে আছে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভোটে দাঁড়ানোর গল্প। ১৯২৬ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক পরিষদে ঢাকা বিভাগের মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট কেন্দ্র থেকে তিনি সদস্য হতে চেয়েছিলেন। বিধান চন্দ্র রায়ের স্বরাজ্য দল থেকে দাঁড়িয়েছিলেন নির্বাচনে। তবে শেষ পর্যন্ত অর্থাভাবে নজরুল জিততে পারেননি।

ব্রিটিশদের থেকে বাঙালি পেয়েছিল ফুটবলও। ১৮৮৪ সালে নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর নেতৃত্বে গঠিত হয় প্রথম বাঙালি ফুটবল দল ওয়েলিংটন। কিন্তু অচিরেই সেটি ভেঙে যায়। বছরখানেক পর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন শোভাবাজার ক্লাব। তারও বছর চারেক পর ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা হয় বিখ্যাত ফুটবল দল মোহনবাগানের।

ইংরেজরা ভেবেছিল, ফুটবল দিয়ে বাঙালির স্বাধীনতার চিন্তাকে দূরে সরিয়ে রাখবে। কিন্তু হলো ঠিক তার উল্টো। ১৯১১ সালে ইংরেজ দল ইস্ট ইয়র্কসকে হারিয়ে দিয়ে বিখ্যাত ফুটবল দল মোহনবাগান জিতে নেয় ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (আইএফএ) শিল্ড পুরস্কার। মাঠে উপস্থিত লাখখানেক হিন্দু-মুসলমান দর্শক সেদিন সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়েছিল।

মজার ব্যাপার হলো, সেই ম্যাচে মোহনবাগান একাদশের ১০ জনই ছিল পূর্ব বাংলার ‘বাঙাল’। অথচ এই জয়ের মাত্র নয় বছর পরেই বাঙাল-ঘটির কথিত দ্বন্দ্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব। মোহনবাগান-ইস্ট বেঙ্গলের এই দ্বন্দ্বের উৎস কী, তা জানা যায় ‘বাঙালির স্বদেশি ফুটবল’ নিবন্ধে।

‘বিলাতি’ ব্রিটিশ শাসন নিয়ে বাঙালির অসন্তোষের মধ্যে ১৯১৭ সালে যখন রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হলো, তখন তা নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে বেশ আগ্রহ সৃষ্টি হয়। বইয়ের একটি নিবন্ধে পরাধীন বাংলায় অক্টোবর বিপ্লবের প্রভাব ও অভিঘাতের কথা জানা যাবে।

বাঙালির রসনা ও শিকারবিলাসের কথা আছে দুটি নিবন্ধে। আরও আছে বাঙালি সংস্কৃতির উপাদান সেকালের বাংলা পঞ্জিকার কথা। বাংলায় মুদ্রণযন্ত্রের বিকাশের সময়ে বাংলা বইয়ের বিপণনব্যবস্থা কী করে গড়ে উঠেছিল, তার বর্ণনা আছে একটি নিবন্ধে। এখানে একটি বড় ভূমিকা ছিল সাহিত্যিকদেরই। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত প্রেসটি বন্ধ করে দেওয়ার দুঃখজনক খবরটি সম্প্রতি পাওয়া গেছে। রবীন্দ্রনাথের আগে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মীর মশাররফ হোসেনের মতো সাহিত্যিকেরা এই ব্যবসায় যুক্ত হয়েছিলেন। নিবন্ধে তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা বেশ কৌতূহল জাগায়।

দিশি ও বিলাতি গ্রন্থে ১০টি নিবন্ধে ঔপনিবেশিক বাংলার খণ্ডচিত্র তুলে ধরেছেন মুহিত হাসান। নিবন্ধগুলোর বিষয়বৈচিত্র্য নানা দিক থেকে সে সময়কার বাংলাকে বুঝতে সাহায্য করে। বর্ণনার বৈঠকি ঢং বইটিকে সুখপাঠ্য করেছে। আগ্রহী ব্যক্তিরা পড়তে গিয়ে আরাম পাবেন।