যে গল্পকার সৈন্যদের আদেশ মানে না

জিয়াদ খাদাশ
জিয়াদ খাদাশ

ফেসবুকে পাওয়া এক সুন্দরী বিধবার সঙ্গে দেখা করতে নাবলুস যাওয়ার পথে আতারা ইসরায়েলি আর্মি চেক পয়েন্টে যানবাহনের লাইনে আটকে পড়া এক ট্যাক্সিতে বসে থাকতে থাকতে আমার মনে হলো, নাবলুস যাওয়ার জন্য এই দিনটা বেছে নেওয়াটা হয়েছে দুর্ভাগ্যের বিষয়। কারণ, আতারা চেক পয়েন্টে একটা শহীদি অভিযান (আত্মঘাতী হামলা) হয়েছে, কিছু বসতি স্থাপনকারী মারা গেছে। 

সড়কে আরও কয়েকটা চেক পয়েন্ট ছিল, বসতি স্থাপনকারীরা ক্ষোভে ফুঁসছিল। কিন্তু আমি ছটফটে আর অধৈর্য স্বভাবের লোক বলে সুন্দরী বিধবার সঙ্গে মিলিত হওয়ার বাসনা ত্যাগ করতে পারছিলাম না। সে লিখেছিল যে তার জীবনের গল্পটা আমাকে শোনাতে চায়, যাতে আমি সেটাকে একটা উপন্যাসের রূপ দিতে পারি। পরাবাস্তব দৃশ্য কল্পনা করে লেখার কষ্ট থেকে সে আমাকে বাঁচাতে চায়, তার জীবনটাই নাকি এক লম্বা পরাবাস্তব কাহিনি। ‘আপনি শুধু লিখবেন,’ বলেছিল সে, ‘উদ্ভট ঘটনা অজস্র আছে আমার জীবনে, আপনাকে শুধু একটু গুছিয়ে লিখতে হবে, এখানে-ওখানে একটুখানি রং লাগাতে হবে।’ 

আমি তার সঙ্গে দেখা করার জন্য ভীষণ উদ্​গ্রীব হয়ে ছিলাম, তার গল্প শোনার জন্য নয়। তার মেসেজের উত্তরে আমি লিখেছিলাম, ‘প্রত্যেক মাসে আমি অচেনা মেয়েদের কাছ থেকে অজস্র মেসেজ পাই, তারা আমাকে তাদের জীবনের গল্প লিখে জানায়, সেগুলো ব্যবহার করে দিব্যি উপন্যাস লেখা যায়।’ আসলে গল্প শোনার জন্য নয়, আমি ওই মহিলার সঙ্গে দেখা করতে উদ্গ্রীব হয়েছিলাম তাকে পাওয়ার জন্য। এই ধরনের ধোঁকাপূর্ণ নেপথ্য গল্পের পথ ধরে প্রায়ই কামনার উদ্দাম তটে পৌঁছে যাওয়া যায়। 

ট্যাক্সিটা ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগোচ্ছিল। সামনের যাত্রীদের কাঁধের ওপর দিয়ে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম ইসরায়েলি সৈন্যরা কয়েকটা ছেলেকে চড়-থাপ্পড় মারছিল। আমি আমার মানিব্যাগ বের করে দেখে নিলাম, আইডি কার্ডটা আনতে ভুলে গেছি কি না। 

সৈন্যরা যখন আমাকে আমার গায়ের শার্টটা গুটিয়ে ওপরে তুলতে বলল, তখন লজ্জায় ও ভয়ে কেঁপে উঠলাম। ওরা দেখতে চাচ্ছিল, আমি আমার কোমরে কোনো বিস্ফোরক বেঁধে রেখেছি কি না। আমি ভদ্রভাবে বললাম যে শার্ট তুলতে পারব না। তখন তারা আমাকে আমার পরনের ট্রাউজার টেনে কোমরের একটু নিচে নামাতে বলল। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম, প্রায় পড়ে যাওয়ার দশা। মনে হচ্ছিল, এখন কিছু একটা করা দরকার। 

‘সোলজার, আমি একজন ফিলিস্তিনি, যে ছোটগল্প লেখে।’ 

সৈন্যটা আমার মুখের দিকে তাকাল: ‘কিন্তু আমি ছোটগল্প পছন্দ করি না, পছন্দ করি লম্বা গল্প। আজ তোমার কপাল ভালো না।’ 

আমার অসহ্য বোধ হলো। পেছনে শত শত যানবাহন দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোর চালক ও যাত্রীরা চেয়ে চেয়ে দেখছে সামনে কী ঘটছে। শুনতে পাচ্ছিলাম তারাও বলাবলি করছে, ‘জঘন্য! জঘন্য!’ 

একটা সৈন্য, যে ছোটগল্প পছন্দ করে না, যার হাতে একটা রাবারের লাঠি, চোখে যার ইতিমধ্যে বিরক্তি জমে উঠেছে, যে ভাবছিল যে সে আমার সবকিছু জানে। সে আবার আমাকে ট্রাউজার নামাতে বলল। নিশ্চিত হতে চাইল যে আমি একটা নির্দোষ লোক। এবার আতঙ্কে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল কিছু একটা করা দরকার। 

‘সোলজার, তুমি কি এৎগার কেরেতের লেখা দ্য বাস ড্রাইভার হু ওয়ান্টেড টু বি গড বইটা পড়েছ?’ 

‘কী বললে? এৎগার কেরেত? তুমি সত্যিই এৎগার কেরেত পড়েছ? ওহ্! তাকে তোমার নিশ্চয়ই ভালো লেগেছে! যাও যাও! এগিয়ে যাও!’ 

এভাবেই পার পেয়ে গেলাম, বিখ্যাত ইসরায়েলি লেখক এৎগার কেরেতের বদৌলতে, যার কিছু গল্প আরবি অনুবাদে পড়া হয়েছিল আমার। ঠিক করলাম, এরপর থেকে প্রত্যেকটা ইসরায়েলি আর্মি চেক পয়েন্টে সৈন্যদের লাঞ্ছনা এড়াতে এই কায়দাটাই কাজে লাগাব। 

ট্যাক্সি ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল; পেছনে শত শত গাড়ি। এইভাবে উইয়ুন আল-হারামিয়া চেক পয়েন্টে পৌঁছে সৈন্যদের লাঞ্ছনা এড়াতে আগেভাগেই আইডি কার্ডটা বের করলাম। 

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

এখানকার সৈন্যটা ভীষণ লম্বা, তার চুলগুলো ঝকঝকে সোনারঙের। দেখতে লাগে বয়স তিরিশের ঘরে। তার নীল চোখ দুটো দেখে আমার মনে হলো, সে নিশ্চিত এৎগার কেরেতের কয়েক ডজন গল্প পড়েছে। আমার কানে এমন কতগুলো কণ্ঠস্বর বাজছিল, যারা বলছিল, এই সৈনিকের ওপর এৎগার কেরেতের কল্পিত জগতের প্রভাব মারাত্মক। 

‘নাম?’ 

‘জিয়াদ।’ 

‘পেশা?’ 

‘শিক্ষক।’ 

‘যাওয়া হচ্ছে কোথায়?’ 

‘নাবলুস।’ 

‘ঠিক কার কাছে যাচ্ছেন?’ 

‘এক সুন্দরী বিধবার কাছে।’ 

‘কী বিষয়ে কথা বলতে?’ 

‘জীবন, সাহিত্য এবং হয়তোবা যৌনতাও।’ 

‘আর?’ 

‘আমাদের আলাপটা হবে ইসরায়েলি লেখক এৎগার কেরেতের গল্প নিয়ে।’ 

এটা বলার পর ভাবলাম, সে হয়তো এখন আমাকে যেতে দেবে, কিংবা হয়তো তার চোখেমুখে সংশয় দেখা দেবে। কিন্তু আমার নাবলুস যাওয়া নিয়ে সে কাটা কাটা প্রশ্ন করেই চলল। আমার মনে হলো, এৎগার কেরেত এ দফায় আর আমাকে বাঁচাতে আসছে না। 

সৈন্যটা আমাকে গাড়িতে ফিরে গিয়ে ড্রাইভারকে ইঞ্জিন বন্ধ করার জন্য বলল। 

এ ধরনের আদেশ পালন করার চেয়ে মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করে যে গল্পলেখক, তার জন্য অপমানের এটাই চূড়ান্ত। আমার রক্ত টগবগ করে ফুটতে আরম্ভ করল। 

‘সোলজার, আমি তোমার আদেশ মানতে পারছি না। আমি একজন গল্পলেখক, গল্পলেখকেরা সৈন্যদের আদেশ পালন করে না।’ 

ঘুষি ও লাথির বৃষ্টি শুরু হলো। কয়েক গন্ডা সৈন্যের হাত-পা-মুষ্টি চলতে লাগল আমার মুখে, পিঠে, পেটে; লাথি আর ঘুষি...শেষে গিয়ে পড়লাম ফিলিস্তিনি যাত্রীদের মধ্যে; তারা আমাকে তুলে নিয়ে একটা গাড়িতে ওঠাল, সেটার চালক দয়া করে আমাকে নিয়ে গেল সবচেয়ে কাছের হাসপাতালে। 

রামাল্লা হাসপাতালের প্রবেশপথে দখলদার সৈন্যরা একটা চেক পয়েন্ট বসাচ্ছিল: হাসপাতালে ঢোকা ও বেরিয়ে যাওয়ার সময় লোকজনের দেহ তল্লাশি করবে। তারা আমার রক্তাক্ত মাথা বরাবর অস্ত্র তাক করল। 

‘কোথায় যাচ্ছ?’ 

‘চিকিৎসা নিতে।’ 

‘কারা মেরেছে তোমাকে?’ 

‘যারা ছোটগল্প ঘৃণা করে, যারা এৎগার কেরেতের গল্প পড়েনি।’ 

‘এৎগার কেরেত?’ ওহ্, আমরা তো এই লেখককে পছন্দ করি। কিন্তু তুমি তাকে কীভাবে চিনলে?’ 

‘সে এক লম্বা কাহিনি! এখন আমাকে ভেতরে যেতে দাও, মাথার রক্তপাত বন্ধ করা দরকার।’ 

হাসপাতালের ভেতরে আমার বেডের কাছেই আরেকটা বেডে শুয়ে ছিল এক সুন্দরী মহিলা। তার মাথায়ও জখম। 

‘ম্যাডাম, আপনি কোথা থেকে এসেছেন? মাথায় এমন জখম হলো কীভাবে?’ 

‘আতারা চেক পয়েন্টে সৈন্যরা আমার মাথাটা ফাটিয়ে দুফাঁক করে দিয়েছে। কারণ, আমি ওদেরকে আমার শরীর হাতাতে দেই নাই। বিধবা একটা মহিলাকে ওরা কী হেনস্তাই না করল, যে কিনা যাচ্ছিল এক বিখ্যাত লেখকের সঙ্গে দেখা করতে, কারণ লেখক নিজে থেকেই বলেছিল, বিধবার জীবনের দারুণ কাহিনিটাকে সে একটা সুররিয়ালিস্ট নভেল বানাবে।’ 

অনুবাদ: মশিউল আলম

আরবি থেকে রাফায়েল কোহেনের অনূদিত ইংরেজি ভাষ্যের অনুসরণে গল্পটির বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে।