'শাড়ি'র প্রতিক্রিয়া: 'শাড়ি'র নারী

>গত ৩০ আগস্ট ‘অন্য আলো’য় প্রকাশিত আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘শাড়ি’ শিরোনামে নিবন্ধটি নিয়ে প্রতিক্রিয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এ বিষয়ে অত্যন্ত সরব। যেকোনো লেখার প্রতিক্রিয়ায় যৌক্তিক তর্ক-বিতর্ককে আমরা স্বাগত জানাই। এখানে প্রকাশিত হলো ‘শাড়ি’র পাঠ-প্রতিক্রিয়া।
শিল্পী: আবদুস শাকুর শাহ্‌
শিল্পী: আবদুস শাকুর শাহ্‌

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কবিতায় শাড়ি পরা একজন নারীকে যেভাবে দেখতে চান, ‘শাড়ি’ শিরোনামের নিবন্ধে তিনি তেমনভাবেই বর্ণনা করেছেন। আমাদের রক্ষণশীল সামাজিক প্রেক্ষাপটে এটি একটি সাহসী লেখা। অনেক উদার লেখা।

১৯৭০-এর দশকে ইউরোপে সেক্সুয়াল রেভল্যুশন হয়েছিল। তাই ইউরোপীয়রা মেয়েদের ‘সেক্স বোমা’ হিসেবে দেখে না।

বাংলাদেশে আমি যখন কোনো পোশাকের (পুরুষ বা নারীর) নতুন একটা ডিজাইন করে বলতাম, ‘নাইস, সেক্সি’, তখন খেয়াল করতাম লোকজন এই ‘সেক্সি’ শব্দটিকে অতিমাত্রায় আক্ষরিক অর্থে নিত। ফলে আমি এটি বলা ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু আমরা কি আসলেই নিজেদের আকর্ষণীয় করার জন্য পোশাক পরি না? আমরা কি শুধু নিজেদের কাছে ভালো লাগবে মনে করেই জামাকাপড় পরি? নাকি অন্যদের কাছে আমাদের কেমন দেখাবে, সেটি ভেবেও পোশাক পরি? 

আমি যখন লন্ডনের ফ্যাশন কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়তাম, তখন আমরা পেয়েছিলাম বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার জুলিয়েন ম্যাকডোনাল্ডকে। আমাদের তিনি পোশাক ডিজাইন করার ক্ষেত্রে সব সময় যে জিনিসটি মাথায় রাখতে বলতেন তা হলো, ‘পোশাকটি কে পরবে? পোশাকটি কী উপলক্ষে পরা হবে? এবং পোশাকটিতে কি যৌন আবেদন আছে?’ হ্যাঁ, আকর্ষণ করার ক্ষমতা, আবেদনময়তা ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা—এগুলোই পোশাকের প্রধান বৈশিষ্ট্য। 

এবার বাঙালি মেয়েদের উচ্চতা প্রসঙ্গে আসি। অবশ্যই সব পোশাকে আমাদের মানায় না। আমরা পশ্চিমা পোশাক পরি ঠিকই, কিন্তু আমাদের মধ্যে ঠিক কতজন আছেন, যাঁরা পত্রপত্রিকায় নিজেদের পশ্চিমা পোশাকে উপস্থাপন করেন? আমরা সেটি করতে পারি না, কারণ আমাদের পশ্চিমাদের মতো দৈহিক উচ্চতা নেই। আমাদের বেশির ভাগের দৈহিক কাঠামোই এমন যে পশ্চিমা ধাঁচের পোশাকের সঙ্গে মানানসই হয়ে ওঠে না। আধুনিক সমাজে অবশ্যই যে কারও যেকোনো পোশাক পরার অধিকার আছে। নিজের ভালো লাগা বা অন্য কোনো বাস্তবিক কারণে যে কেউ যেকোনো পোশাক পরতেই পারেন। তাতেও যে সবাইকে দেখতে ভালো লাগবে, তা-ও নয়। তবে শাড়িই এমন পোশাক, যা আমাদের সবার জন্য মানানসই।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর সাহিত্যিক জীবনে বঙ্কিমচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথের প্রভাবে দারুণভাবে প্রভাবিত। তাই আমার মনে হয়েছে, আলোচ্য নিবন্ধে তিনি যে ‘ইউরোপীয় উদ্ধত সৌন্দর্য’-এর কথা বলেছেন, সেটি সরাসরি রবীন্দ্রনাথ থেকে নিয়েছেন। একই সঙ্গে বঙ্কিমের কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসের রোহিণীর শাড়ির বর্ণনাও এতে ধরা পড়ে। 

পশ্চিমের রেনেসাঁ আন্দোলন যৌন সুড়সুড়ির দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়াই যৌনতাকে দেখতে সাহায্য করেছিল। আমাদের বুঝতে হবে নগ্নতাকে উপজীব্য করে সৃষ্টি করা পুরোনো ধ্রুপদি চিত্রকর্ম আর পর্নোগ্রাফির মধ্যে ফারাক রয়েছে। 

যাহোক, সায়ীদ স্যারের এই লেখায় নারীবাদী লেখকেরা হয়তো ইন্ধন খুঁজে পেয়েছেন। তবে এটিও মনে রাখা দরকার, সায়ীদ একজন রোমান্টিক লেখক। শাড়ি পরলে একজন নারী কেমন সৌন্দর্য ও বিভা নিয়ে উপস্থাপিত হন এবং সেই সৌন্দর্যকে লেখক হিসেবে তিনি কীভাবে দেখেন, সেটি বলার সাহস দেখানোয় আমি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ওপর খুশি। 

আমাদের অবদমিত সমাজে হাজারো বিধিনিষেধ আছে। যখন বলা হচ্ছে, ‘এটা কোরো না, ওটা করো’, তখন আমরা নুসরাত হত্যাকাণ্ডের মতো কিছু ঘটনা এবং যত্রতত্র ধর্ষণের ঘটনা দেখেছি। সেই প্রেক্ষিতে বলতে পারি, এই মানসিকতার লোকজনের কাছে সব মেয়েই ‘সেক্স বোম্ব’। আমরা তাদের চেয়ে কেন কিছুটা উদার হব না? আমরা শরীর বা যৌনতা নিয়ে কেন আরেকটু খোলামেলা কথা বলব না? 

না, আমি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের অন্ধ সমর্থক নই; এমনকি বহু ইস্যু ও বিষয়ে আমি তাঁর অনেক সমালোচনা করেছি। কিন্তু এই লেখার ব্যাপারে, এই ইস্যুতে তাঁকে আমি সমর্থন করি। আমি তাঁর লেখায় কাউকে আহত করার মতো কিছু পাইনি। ‘শাড়ি’ শিরোনামের লেখাটিতে আমি বরং আমার সৌন্দর্যকে স্বাগত জানানো এবং আমার নারীত্বকে অভিনন্দন জানানোর ভাষা দেখতে পেয়েছি। আমি খুশি যে তিনি একটি বিতর্কের শুরু করেছেন। আমি আরও খুশি এ জন্যও যে রক্ষণশীল সমাজের তথাকথিত শুদ্ধাচারকে তিনি চ্যালেঞ্জ করতে পেরেছেন। 

খাদিজা রহমান: ফ্যাশন ডিজাইনার।