'শাড়ি'র প্রতিক্রিয়া: সায়ীদ স্যারকে খোলা চিঠি

>গত ৩০ আগস্ট ‘অন্য আলো’য় প্রকাশিত আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘শাড়ি’ শিরোনামে নিবন্ধটি নিয়ে প্রতিক্রিয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এ বিষয়ে অত্যন্ত সরব। যেকোনো লেখার প্রতিক্রিয়ায় যৌক্তিক তর্ক-বিতর্ককে আমরা স্বাগত জানাই। এখানে প্রকাশিত হলো ‘শাড়ি’র পাঠ-প্রতিক্রিয়া।

প্রথম আলোয় প্রকাশিত আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের লেখাটা বাংলাদেশের মেয়েদের খুব আহত করেছে। আঘাত করেছে আমাদেরও। প্রতিবাদ করার খুব একটা ইচ্ছে নেই এ মুহূর্তে। কারণ, শরীর খুব ক্লান্ত। মনটাও তেমন কাজ করছে না। এই খোলা চিঠিতে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে শুধু এটুকু বলতে চাই, স্যার, আমরা কেন ইলিশ খাই জানেন? কারণ, ইলিশ আমাদের গঙ্গা, পদ্মা, মেঘনায় হয়। জর্ডানে ইলিশ পাওয়া যায় না, অন্য কোথাওই পাওয়া যায় না। তাই তারা খায়ও না। যে মাটিতে চাল ভালো হয়, সেখানকার খাদ্যাভাসে ভাত প্রধান হয়ে ওঠে। যে মাটিতে বাজরা হয়, সেখানকার লোকে বাজরা খায়। ইতিহাস সাক্ষী, প্রাগৈতিহাসিক কালের মানুষেরা ঠান্ডার দেশে পশুর চামড়ার পোশাক পরত। আমাদের এই উপমহাদেশীয় অঞ্চলের মানুষ হালকা পাতলা গাছের বাকল পরেছে, লোমওয়ালা পশুর চামড়া দিয়ে অঙ্গ আচ্ছাদিত করেনি।

শাড়িকে এখানকার নারীরা পোশাক হিসেবে নিজেরা বেছে নেয়নি, স্যার। আমাদের এখানকার সভ্যতার অবদান হলো শাড়ি। এই সভ্যতাই এ রকম পোশাক কল্পনা করেছে। এই উপমহাদেশের সবকিছুর সঙ্গে—আবহাওয়া, জল, মাটি, রোদের সঙ্গে সে কল্পনা সামঞ্জস্যপূর্ণ। শাড়ি, ধুতি, বেনিয়ান, কাঁচুলি—যা যা আমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, সবই সেই সামষ্টিক কল্পনাপ্রসূত ব্যাপার। ঘাম, গরম মিশে আছে এসব পোশাক-কল্পনায়।

এ দেশের মেয়েদের শরীর এবং তার গড়ন-পেটোন, রং—এসবও আসলে ভৌগোলিকতার ফলাফল, নৃতাত্ত্বিকতার ফলাফল। এর সঙ্গে মিশে আছে বহু বহু জাতিতত্ত্ব। আমাদের মধ্যে আর্য রক্ত আছে, দ্রাবিড়দের রক্ত আছে, আফ্রিকান রক্ত আছে, মধ্যপ্রাচ্যের রক্ত আছে, ইউরোপীয় রক্তও আছে। এ ছাড়া আছে জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাস। আমাদের মেয়েরা কেউ নিজে বেছে নেয়নি এ রকম ফিগার। আর মেয়েদের কি এক রকমেরই ফিগার হয় স্যার? এমনকি একটা মেয়েরই তো দশ রকমের ফিগার হয় একজীবনে—সে কৈশোরে এক রকম, যৌবনে এক রকম আবার চল্লিশে আরেক রকম। পঞ্চাশ বছর বয়সে আরও অন্য রকম। এখানে আরেকটি কথাও বলা দরকার, নারীরা তাদের ফিগার বা দেহসৌষ্ঠব নিজে বেছে না নিয়েও যা পেয়েছে, তা অসাধারণ—চোখ, চুল, ভুরু, স্তন, নিতম্ব। ফোয়ারার মতো শরীর। আবার কখনো শুকিয়ে যাওয়া ফোয়ারা। তাতে কিছু এসে যায় না। কারণ প্রত্যেকেরই তো একটা ‘বেস্ট টাইম’ থাকে। মানুষ তো স্ট্যাচু অব লিবার্টি নয় যে একই রকম আকার ও আয়তনে দাঁড়িয়ে থাকবে আজীবনকাল? আর শাড়ি? শাড়িকে আমরা পরি না, স্যার। শাড়িকে আমরা শরীরে চালিয়ে দিই। পা থেকে মাথা অব্দি শাড়ি চলে বেড়ায় আমাদের শরীরে। অসম্ভব গতিশীল হয়ে থাকে শাড়ি আমাদের দেহের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে। থামে না। দাঁড়ায় না। চলতে থাকে। সাত–আট হাজার বছরের এই চলাচল। শাড়ি খুব বিমূর্ত একটা পোশাক; এবং আমাদের দেশের মেয়েরা ছাড়া শাড়ির এই চলিষ্ণুতাকে কেউ অঙ্গে ধারণ করতে পারে না, সে যত সাদা রং হোক, যত দীর্ঘাঙ্গী হোক, যত নিখুঁত দেহসৌষ্ঠবের অধিকারী হোক না কেন। হয় না, স্যার। অনেক দেখেছি বিদেশিনীদের শাড়ি পরার চেষ্টা। অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্ত্রী শ্রীমতী লীলা রায়ের মতো হাতেগোনা দু-একজন বোধ হয় শাড়িকে শরীরে মিশিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই সব মিলেমিশে তৈরি হয়েছি আমরা এই অঞ্চলের মেয়েরা। আপনার লেখাটার মধ্যে যুক্তির বড্ড অভাব পেলাম।

শেষে একটা কথা বলতে চাই, দেহের গড়নের সঙ্গে পোশাকের একটা ক্ষীণ সম্পর্ক যে থাকে না, তা নয়, তবে আসল সম্পর্কটা অ্যাটিটিউড বা আচরণগত। নইলে ভাবুন আমাদের এই উপমহাদেশের নারী সেনা কর্মকর্তাদের কথা, পুলিশ মেয়েদের কথা, কর্মরত অবস্থায় তাঁরা যে ইউনিফর্ম পরেন, তাতে কি তাঁদের কম গ্রহণযোগ্য মনে হয়, স্যার? যে মেয়ে দায়িত্ব নিতে পারে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সব পোশাকেই তাঁকে মানিয়ে যাবে।

সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়: কথাসাহিত্যিক।