'শাড়ি'র প্রতিক্রিয়া: বর্ণবাদ, নারীবিদ্বেষ ও পুরুষতান্ত্রিকতা

>গত ৩০ আগস্ট ‘অন্য আলো’য় প্রকাশিত আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘শাড়ি’ শিরোনামে নিবন্ধটি নিয়ে প্রতিক্রিয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এ বিষয়ে অত্যন্ত সরব। যেকোনো লেখার প্রতিক্রিয়ায় যৌক্তিক তর্ক-বিতর্ককে আমরা স্বাগত জানাই। এখানে প্রকাশিত হলো ‘শাড়ি’র পাঠ-প্রতিক্রিয়া।
শিল্পী: কাইয়ুম চৌধুরী
শিল্পী: কাইয়ুম চৌধুরী

‘নারী সম্ভবত মহাজগতের সবচেয়ে আলোচিত প্রাণী’, বলেছিলেন ভার্জিনিয়া উল্​ফ। তাঁর আক্ষেপ, নারী সম্পর্কে আলোচনা করেছেন নারীর প্রতিপক্ষ প্রায় সবাই; শুধু যার সম্পর্কে আলোচনা, যাকে কেটেছেঁটে পিটিয়ে পালিশ করে জোড়াতালি দিয়ে নিজেদের স্বপ্নের আদলে বানানোর জন্য বিনিদ্র থেকেছেন মহাপুরুষেরা, সেই নারীই কেবল অংশ নেয়নি। নারীর প্রতিপক্ষ পুরুষ, যে শক্তিমান ও প্রতিভাবান, তাঁরা সবাই অন্তত একটি করে শ্লোক রচনা করে গেছেন 

নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। পুরুষ নারীকে চেয়েছে দাসী ও সম্ভোগের সুখকর বস্তুরূপে, আবারও কখনো মেকি স্তব করেছে দেবীরূপে। পুরুষ তৈরি করেছে এমন এক ‘আলোকিত
সভ্যতা’, যা কেবল পুরুষের জন্য; ওই সভ্যতা স্বীকার করেনি নারীর প্রতিভা, মেধা, বিকশিত হতে দেয়নি নারীর সৃজনশীলতাকে। 

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ‘শাড়ি’ শিরোনামে ৩০ আগস্ট প্রথম আলোর ‘অন্য আলো’তে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। কেন তিনি লেখাটি লিখেছেন, তা বোঝার জন্য উপর্যুক্ত এই অনুচ্ছেদই যথেষ্ট। তাঁর অজান্তে এই লেখায় ভয়ংকর পুরুষতান্ত্রিকতা, অন্ধকার মনস্তত্ত্ব আর নারীকে দেখার তাঁর এক পশ্চাৎপদ মনের মানচিত্র একলাফে যেন হাঁ হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। পাশাপাশি লেখকের বিরুদ্ধে উঠেছে লিঙ্গবৈষম্য ও বর্ণবৈষম্যের অভিযোগ। সায়ীদের এই রচনায় নারীকে ‘যৌনবস্তু’ ও ‘পুরুষের দেখন-সুখের সামগ্রী’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে একধরনের যৌনসুখ পাওয়া এবং পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বলে আমরা মনে করি। কেননা, এখানে লেখকের ‘মেইলগেজ’ (সাহিত্য বা ভিজুয়াল মাধ্যমে নারীকে দেখার পুরুষের চোখ বা পার্সপেক্টিভকে বলা হয় মেইলগেজ)-এর কাছে নারী শুধু পুরুষের চক্ষুতৃপ্তির জন্য অস্তিত্বশীল। নারী যেন মানুষ নয়, নিরেট যৌনসর্বস্ব মাংসপিণ্ড, শুধুই চোখের আরাম ও আনন্দ নেওয়ার সামগ্রী। আর সেই চোখ একান্তই পুরুষের। 

সায়ীদের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে উপরোক্ত বক্তব্যগুলো প্রমাণ করা সম্ভব। যেমন, লেখার শুরুতেই শাড়িকে একটি ‘শালীন’ পোশাক বলে উল্লেখ করে লেখক বলেছেন, ‘শাড়ি একটি রহস্যময় পোশাক। নারীদেহকে কতটুকু প্রদর্শন করলে আর কতটা অপ্রকাশিত রাখলে তা শারীরিক মোহ বজায় রেখেও দর্শকের চোখে অনিন্দ্য হয়ে উঠবে, তা পোশাকটি যেন সহজাতভাবে জানে...সালোয়ার-কামিজ, টাইট জিনস, মিনি স্কার্ট কি এর সমকক্ষ?’ 

এই কথা অত্যন্ত আপত্তিজনক ও অমর্যাদাকর। বিজ্ঞাপনে নারীর শরীরকে ক্রেতা-দর্শকের চোখে পণ্য হিসেবে প্রদর্শন করার যে চর্চা, একুশ শতকের পৃথিবীতে তা প্রতিরোধ ও সমালোচনার মুখে পড়েছে। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে নারীশরীরকে পুরুষের কাম ও লালসার বস্তু হিসেবে তুলে ধরা অত্যন্ত হীন মানসিকতার পরিচায়ক বটে। 

নারীকে ভোগ্যপণ্য ও যৌনবস্তু হিসেবে উপস্থাপন করার দোষেই লেখাটি দুষ্ট নয়, নারীকে এটি নামিয়ে এনেছে আরও নিচে। সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সায়ীদ যেভাবে নারীকে পুরুষের চেয়ে অধস্তন হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন, তা আমাদের মর্মাহত করেছে। উপরন্তু বাঙালি নারীরর ‘উচ্চতা’র প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এবং সেখানে ‘অসমতা’ বা ‘ঘাটতি’ অন্বেষণপূর্বক চরম পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। তাঁর বক্তব্য, ‘বাঙালি সৌন্দর্যের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আমার ধারণা, উচ্চতা...দৈহিক সৌন্দর্য ছেলেদের বড় ব্যাপার নয় বলে এ নিয়েও তারা কোনোমতে পার পেয়ে যায়। কিন্তু আটকে যায় মেয়েরা...বাঙালি মেয়ে বিপদে পড়ে এখানটাতেই...ওই কাম্য উচ্চতার অভাবে বাঙালি মেয়েদের শাড়ি ছাড়া আর যেন কোনো গতিই নেই।’ 

তাঁর এই বক্তব্যকে ‘মেইলগেজ’-এর চূড়ান্ত নমুনা হিসেবে দেখা যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে কেইট মিলেটের কথা। তিনি খেদোক্তি করেছিলেন এই বলে, ‘শরীরই নারীর নিয়তি’। আর এখানে বাঙালি নারীদের সায়ীদ বললেন, শাড়িই তাদের নিয়তি। 

দেশে এখন পোশাকশিল্পে কর্মরত রয়েছেন ৫০ লাখের বেশি নারী। এর বাইরেও আছেন বিরাটসংখ্যক কর্মজীবী নারী। তাঁদের বেশির ভাগই সালোয়ার-কামিজ পরেন, কেউ কেউ প্যান্ট-শার্টও পরেন। এটা এখন তাঁদের বাস্তবতা, এই বাস্তবতা মানতে সমস্যা কোথায়? 

লেখার আরেকটি স্থানে বাঙালি বাঙালি নারীর দৈহিক গড়ন নিয়ে মন্তব্যের পাশাপাশি অন্য অঞ্চলের নারীদের সঙ্গে তাদের তুলনাও টেনেছেন তিনি, ‘বাঙালি মেয়েদের দেহ গঠন উপমহাদেশের উত্তরাংশের মেয়েদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অসম। যেকোনো অসমতাকে আড়ালে রেখে মানসম্মত দেহসৌষ্ঠব নিয়ে দাঁড়ানোর পথ একটাই—ইংরেজিতে যাকে বলে মেকআপ—যার গভীরতর মানে মেকআপ দ্য লস। শারীরিক অসমতার এত ঘাটতি থাকার পরও অন্যান্য মেকআপের মতো রূপকে নিটোলতা দেওয়ার মতো এক অনন্য সাধারণ মেকআপ রয়েছে বাঙালি মেয়েদের ভাঁড়ারে। আমার মতে, এর নাম “শাড়ি”।’ 

গোটা নিবন্ধে পৃথিবীর অন্য দেশের নারীদের শারীরিক আকার, আকৃতি ও দেহাবয়বকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন প্রাচ্যের গৎবাঁধা ধারণা দিয়ে। যেখানে তাঁর কাণ্ডজ্ঞানে আফ্রিকান নারীমাত্রই ‘বিশালদেহী’ এবং ইংরেজ ও জার্মান নারীদের শরীরমাত্রই ‘উদ্ধত’। ফলে এই দুই মহাদেশের নারীদের প্রতি একপ্রকার সিদ্ধান্তের মতো করেই তাঁর বলা, শাড়িতে ওদের ঠিক ‘খাপ খাবে না’। 

পোশাক নিয়ে কথা বলতে গিয়ে নারীর পোশাক চয়নের স্বাধীনতাকেও ভয়ংকরভাবে কটাক্ষ করেছেন সায়ীদ। এমনকি নারীর বহির্মুখী কর্মচাঞ্চল্যের জীবনকে উপস্থাপন করেছেন তাচ্ছিল্যভরে, ‘আজকাল শাড়ি ছাড়া অনেক রকম কাপড় পরছে তারা, সালোয়ার-কামিজ তো আছেই, পাশ্চাত্য ফ্যাশনের কাপড়ও কম পরছে না এবং পরার পর ইউরোপ বা ভারতের ওই সব পোশাক পরা সুন্দরীদের সমকক্ষ ভেবে হয়তো কিছুটা হাস্যকর আত্মতৃপ্তিও পাচ্ছে।’ লক্ষ করুন, কেবল নিজের ব্যক্তিগত রুচি-পছন্দের সঙ্গে না মেলার কারণে বিপুলসংখ্যক নারীর নিজস্ব চয়ন বা পরিচয় নির্মাণের চেষ্টাকে তিনি ‘হাস্যকর’ বলে তাচ্ছিল্য করছেন। কী ভয়াবহ দৃষ্টিভঙ্গি! 

কর্মজীবী নারীর ‘ফাংশনাল পোশাক’ পরার যে প্রয়োজন বা চাহিদা আজকের সমাজে তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘কর্মব্যস্ত ঊর্ধ্বশ্বাস যুগের অকর্ষিত রুচি চাহিদা।’ এর মানে কী? তাহলে কি নারী বাইরে যাবে না? দৌড়াবে না? ফুটবল খেলবে না? তিনি কি মনে করেন, বাইরে না গিয়ে শাড়ি পরে পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য ঘরে বসে থাকলে সেটিই বিবেচিত হবে ‘কর্ষিত রুচি’ বলে? 

এবার লেখায় সায়ীদের কয়েকটি শব্দবন্ধের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক, ‘তন্বীদের’ ‘দেহবল্লরীতে’, ‘চিরস্থায়ী হাইহিল’, ‘ললিত-মধুর ও দীর্ঘাঙ্গী’, ‘কমনীয় শরীর’, ‘শারীরিক কমনীয়তা’, ‘নারী শরীর’, ‘রমণীয় এলাকা’, ‘নারীর উঁচু-নিচু ঢেউগুলো’, ‘রূপের শরীরে’, ‘অলৌকিক বিদ্যুৎ হিল্লোল’, ‘মানসম্মত দেহসৌষ্ঠব’, ‘দৈহিক অসমতা’, শারীরিক ত্রুটি’, ‘নারীজনিত গীতিময়তা’, ‘শারীরিক মোহ’, ‘জাদুকরি রহস্য’, ‘বাঙালি নারীর সৌন্দর্যের ঘাটতি’, প্রভৃতি। এই শব্দবন্ধগুলোকেও ‘মেইলগেজ’-এর দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা যেতে পারে। 

নারীর প্রশ্নে আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এখনো উনিশ শতকের মান্ধাতা ধারণা পোষণ করেন, যা তাঁর লেখার ছত্রে ছত্রে তিনি নিজেই প্রকাশ করেছেন। তাঁর এই ধারণা শুধু তাঁর নিজের ভেতরে অপ্রকাশিত অবস্থায় থাকলে আমাদের আপত্তি ছিল না। কিন্তু তিনি নিজের ব্যক্তিগত রুচিকেই স্ট্যান্ডার্ড বা আদর্শ মেনে ‘শাড়ি’ শীর্ষক লেখায় অন্যদের বিচার এবং হেয় করেছেন। পৃথিবী এগিয়ে গেছে। সংগত কারণেই নারী ও নারীর অধিকার প্রশ্নে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের চিন্তাগুলো যে প্রাচীন ও পরিত্যাজ্য এবং সমাজের জন্যও ক্ষতিকর, সেটি তুলে ধরার তাগিদেই আমাদের এ লেখা। তাঁকে বলব, শাড়ির আবরণে নারীদের ভাঁজ না খুঁজে তার ঘর্মাক্ত চেহারার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন। 

রোবায়েত ফেরদৌস, আফরোজা সোমা, নাসরিন আক্তার: লেখকেরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক।