লোকগানের শেষ সম্রাট

>তিনি গানওয়ালা। একদিন লিখেছিলেন, ‘বসন্ত বাতাসে সই গো বসন্ত বাতাসে বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে...’। শাহ আবদুল করিমের গান এখন সবার মুখে মুখে। লোককবি ও মরমী এই শিল্পীর গানের কথা ও সুর আচ্ছন্ন করেছে এ প্রজন্মকেও। ১২ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যুদিন। তাঁকে নিয়ে এই লেখা।
শাহ আবদুল করিম  (১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯১৬—১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯) প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
শাহ আবদুল করিম (১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯১৬—১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯) প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

সেপ্টেম্বর মাসে বরাম হাওর সব সময়ই উতালপাথাল করে। সিলেট থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে দিরাই বাজারে নেমে ‘ঘুণ্টিওয়ালা’ নাইয়রি নৌকা ভাড়া করে এই বরাম হাওর পার হয়ে গিয়েছিলাম ধল গ্রামে। ২০০৩ সালে। তখন আমার কাছে কিংবদন্তির মতো ছিলেন শাহ আবদুল করিম। আমার সঙ্গে নতুন কেনা ভিডিও ক্যামেরা। হাওর পেরোতে পেরোতে দেখি ঝিলমিল ঝিলমিল করা ছোট ছোট ঢেউ, খানিক দূরে দূরে নানা রঙের পালতোলা নাও। ইঞ্জিনের নৌকার চল শুরু হলেও হাতে টানা বা পালতোলা নৌকার বাহারি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়নি তখনো।

পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে টানা হাওরি যাত্রা সেরে হাজির হয়েছিলাম কতগুলো ছোট ছোট দ্বীপের মতো সাজানো একটা গ্রামে। সেখানে শাহ আবদুল করিমের বাড়ি। সেই প্রথম আমার তাঁর কাছে যাওয়া।

বিকেলবেলা ডিঙির গলুইয়ে তাঁকে বসিয়ে পছন্দের গান শুনেছিলাম তাঁরই কণ্ঠে। আর এসব ধারণ করা হচ্ছিল আমার ক্যামেরায়। সন্ধ্যায় তাঁর বাড়ির উঠানে হারিকেন জ্বালিয়ে গানের আসর বসেছিল চাটাইয়ের ওপর। তারপর থেকে নেশা লেগে গিয়েছিল ‘ভাটির পুরুষ’-এর প্রতি। শীত, বসন্ত, বর্ষা—নানা ঋতুতে কালনীপাড়ের এই মানুষটির কাছে আমি গিয়েছি বারবার—২০০৯ সাল পর্যন্ত।

বরাম হাওর দিয়ে করিমের মরদেহ নিয়েও গিয়েছিলাম একবার, ২০০৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। আবার সেই দিরাই থেকে নৌকার বহর নিয়ে ছিল আমার যাত্রা। সেই একই হাওর। অসংখ্য ইঞ্জিনের নৌকা। ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে পালতোলা নাও আর দেখি না। কদাচিৎ মাছ ধরার কিছু ছোট নাও। সেই হাওর, সেই হাওরের জল, উতালপাথাল করা ঢেউ, মাঝি, গাছগাছালি—সবই ছিল, শুধু শাহ আবদুল করিমের দেহে প্রাণ ছিল না। আগের দিন শেষ রাতে সিলেটের এক হাসপাতালে মারা গিয়েছিলেন তিনি।

১০ বছর হয়ে গেল। শাহ আবদুল করিম আমাদের মধ্যে সশরীর নেই। কিন্তু তিনি কি আসলে নেই?

আমার মাঝেমধ্যেই মনে হয়, লালন-হাসনের এই বাংলার সবচেয়ে ভাগ্যবান লোকগানের সাধক ছিলেন করিম। তাঁর জন্ম যদিও ১০০ বছর আগে, কিন্তু ৯৩ বছরের মোটামুটি দীর্ঘ জীবন লাভের কারণে বৈশ্বিক কারিগরি প্রযুক্তির সূচনাপর্বের স্বাদটুকু পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর আগের কারও তো বটেই, তাঁর সমসাময়িক কোনো বাউলকবি, লোককবিও এই সুযোগ পাননি।

ভাটি অঞ্চলের প্রকৃতিটাই এমন যে এখানকার সাগরসমান হাওর, ঢেউয়ের কলকল তান, মাঝিমাল্লার আনাগোনা—এসব দেখে দেখে আর বাড়ির পাশের পানির কিনারে বসে বসে ধ্যান করতে করতে কিংবা লিলুয়া বাতাসে নৌকায় চড়তে চড়তে কতভাবেই না এ অঞ্চলের মানুষ দরাজ গলায় প্রকাশ করে গান। সে কারণেই হয়তো দেশের বারো আনা লোককবির জন্মই এই বিস্তীর্ণ ভাটিবাংলার জলজ অঞ্চলে। কিন্তু তাঁদের কজনকেই-বা তাঁদের কালের পরে মানুষ চিনতে পেরেছে, দেখতে পেরেছে, বা তাঁদের কণ্ঠের গান শুনতে পেরেছে? প্রযুক্তির কাছাকাছি থাকার সুযোগও তাঁদের হয়নি।

শাহ আবদুল করিম রেডিও পেয়েছিলেন। সিলেট বেতারে ‘আবদুল করিম ও তাঁর সঙ্গীরা’র গাওয়া ছয়-সাতটি গান ধারণ হয়েছিল। অশীতিপর করিম জীবনে কয়েকবার টেলিভিশন দেখেছিলেন বটে, কিন্তু তিনি নিজেও টেলিভিশনের ভেতর থেকে কথা বলে উঠবেন, এমনটি কখনো ভাবেননি। টেলিভিশন কী জিনিস, ভালো
ধারণাও তাঁর ছিল না। শুধু তা-ই নয়, ৯৩ বছর বয়সে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে কোটি কোটি দর্শকের সঙ্গে তাঁর নিজেকেও ‘ভাটির পুরুষ’রূপে দেখার সুযোগ তিনি পেয়ে
গিয়েছিলেন।

মাঝেমধ্যেই আমার এমনটি মনে হয় যে শাহ আবদুল করিম আমাদের লোককবিদের শেষ প্রজন্ম। এরপর হয়তো আমরা আর লোকগান পাব না, লোককবিও না। কারণ, সময় বদলেছে, পরিবেশ বদলাচ্ছে। লেখাপড়া করা শিক্ষিত ‘ডিজিটাল প্রজন্ম’ এসে এখন ‘লোক আঙ্গিক’-এর গান ধরছে। করিমের বাড়িতে যাওয়ার জন্য নৌকা ছাড়া গতি ছিল না। এখন সেখানে রাস্তা হয়েছে। বর্ষাকালেও গাড়ি চালিয়ে যাওয়া যায় তাঁর বাড়ি।

আমাদের খাল-বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। ইঞ্জিনের নৌকার কারণে ফুরিয়েছে মাঝিমাল্লাদের দরকার। বাঁশের সাঁকো, খেয়া পারাপারের দিন—সব শেষ। এখন ব্রিজ হয়ে গেছে, দীর্ঘ সেতু হয়ে যাচ্ছে বড় বড় নদীতে। লোক আঙ্গিকের গানের নতুন নতুন যেসব মেটাফর আমরা আগের আমলের লোককবিদের কাছে পেতাম, সেসব এখন আর পাব না। গ্রামীণ সমাজ থেকে নৌকা করে নাইয়র যাওয়ার জন্য গ্রাম্য বধূর কাতরতার কাহিনি হয়তো নতুন করে শুনব না আর। যা কিছু শুনব, যাঁদেরটা শুনব, তাঁদের মধ্যকার শেষ মানুষটি ছিলেন শাহ আবদুল করিম। তবে যাওয়ার আগে প্রায় শ পাঁচেক লোকগান রেখে গেছেন লোকগানের এই সম্রাট। আমরা এখন সেসব শুনছি নানা আঙ্গিকে।

শাহ আবদুল করিম নামের কালনীপাড়ের সাদাসিধে হতদরিদ্র বাউলকে সুরমার সীমানা পার করিয়ে প্রথমে বড় আকারে মানুষের সঙ্গে পরিচিত করান হাবিব ওয়াহিদ। টেমসের পাড়ে বসে সুরমাপাড়ের কিছু গানকে নতুন আঙ্গিকে প্রকাশ করেন তিনি। সেই গানগুলো প্রাণভরে উপভোগ করতে থাকে দেশ-বিদেশের তরুণ প্রজন্ম। নতুন করে করিম-কাহিনির শুরু এখান থেকেই। তারপর ঘটল নানা ঘটনা—প্রামাণ্যচিত্র, আজীবন পুরস্কার, সম্মাননা—এসব। বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান করিমকে সম্মাননা দিতে পেরে নিজেরাই সম্মানিত হতে থাকল।

করিমের মৃত্যুর পরের বছর তাঁর জীবন ও দর্শন নিয়ে লেখা হলো মঞ্চনাটক। দীর্ঘ ৯ বছর ধরে মহাজনের নাও নামের নাটকটি যেভাবে দর্শকদের ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছে, তা তো কেবল শাহ আবদুল করিমের জন্যই। তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও হয়েছে—রঙের দুনিয়া। জীবনের শেষ বছরে তাঁর লেখা সব গানের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে এবং অসুস্থ শরীর নিয়ে মৃত্যুর কয়েক মাস আগে নিজে মঞ্চে বসে বইটির প্রকাশনা উৎসবও তিনি দেখেছেন।

এসব লিখতে লিখতেই মনে হলো কতটা বৈচিত্র্যময় তাঁর জীবন! আরও মনে হলো, শাহ আবদুল করিমের চেয়ে আমিও তো কম ভাগ্যবান নই। লালনকে দেখিনি, হাসনকে দেখিনি, রশিদউদ্দিন, জালাল খাঁ, উকিল মুন্সী, আবদুস সাত্তার, কামালউদ্দিন, দুর্বিন শাহ—এঁদের কাউকে আমি দেখিনি, কিন্তু শাহ আবদুল করিমকে আমি দেখতে পেয়েছিলাম, যিনি নিজের কণ্ঠে আমার সামনে গেয়েছেন, ‘বাউল আবদুল করিম বলে’—এটা কী কম ভাগ্যের ব্যাপার! 

ভেতরে ও বাইরে আবদুল করিমের ধল গ্রামের সেই বাড়ির রূপ বদলে গেছে এখন। করিমের জীবদ্দশায় যেসব বাউল বা লোকগানের শিল্পী, অনুসারী, ভক্তকুলের সমাবেশ সেখানে হতো, এখন আর তা নেই। এর মধ্যে চলে গেছেন তাঁর সবচেয়ে বড় অনুরাগী শিষ্য রুহী ঠাকুর। পাশের বাড়ির ব্রাহ্মণ দুই সহোদরের মধ্যে বড় ছিলেন তিনি। তবে ওই গ্রামে এখনো আছেন রুহী ঠাকুরের ছোট ভাই রনেশ ঠাকুর। রুহী ঠাকুর নিজেও গান লিখতেন, সুর করতেন। আবদুল করিমের অনেক গান ছিল তাঁর সুর করা। ওস্তাদের প্রতি সম্মান দেখাতে গিয়ে নিজের গান খুব গাওয়া হতো না তাঁর। করিমের অন্য বড় শিষ্য ছিলেন বাউল আবদুর রহমান, যাঁর জীবনের ৩৫ বছর ছিল বাউল করিমের সঙ্গে। অসুখ-বিসুখ থেকে গানের আসর পর্যন্ত তিনিই ছিলেন তাঁর প্রধান সহকারী। কিন্তু তিনিও এখন আর ধলমুখী হন না। হবেন কেন? যাবেন কোথায়? কে তাঁকে সমাদরে গ্রহণ করবে?

২০০৯ সালের পর ২০১৪ ও ২০১৭—আরও দুবার গিয়েছিলাম শাহ আবদুল করিমের বাড়িতে। তখন দারিদ্র্যের সঙ্গে অবহেলার সংযোগও দেখেছিলাম। শা’ করিম ও সরলার যুগল কবরের পাশে তাঁর নামফলকটিও পড়ে ছিল ভাঙাচোরা অবস্থায়। সম্প্রতি দুটি বেসরকারি সংস্থার বিনিয়োগে একটা ছোট স্মৃতি জাদুঘর হয়েছে করিমের বাড়িতে। সেখানে কিছুটা গুছিয়ে রাখা আছে করিম-স্মৃতির কিছু স্মারক।

আর সেই জাদুঘরের পাশের ‘শা’ করিম জাহানের সরলা মহল’-এ পাশাপাশি শুয়ে আছেন আমাদের লোকগানের শেষ সম্রাট শাহ আবদুল করিম।