স্মৃতির সাইকেল

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

সাইকেল মানে স্মৃতি। স্মৃতি মানে কবিতা। সাইকেল মানে তাই কবিতা। আল মাহমুদ লিখেছিলেন:

‘কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি।
সে তো ভেসে ওঠা ম্লান
আমার মায়ের মুখ; নিম ডালে
বসে থাকা হলুদ পাখিটি
পাতার আগুন ঘিরে রাতজাগা
ছোট্ট ভাইবোন
আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের 
ঘণ্টাধ্বনি—রাবেয়া রাবেয়া
আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট।’

আমাদের শৈশব-কৈশোরজুড়ে ছিল সাইকেল। আব্বার একটা সাইকেল ছিল, তার সামনের হাতলে ছিল সবুজ মোড়ক। সামনের হাতল বলব, নাকি বলব ডানা! সাইকেলের ডানা। আব্বার সাইকেলের ডানা দুটোর মাথায় ছিল সবুজের ছোপ।

যখন ক্লাস টু কি থ্রিতে পড়ি, সেই সাইকেলটা কিছুক্ষণের জন্য পাওয়া ছিল আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো। তারপর? সাইকেলের বাঁ দিকে রাখতে হতো নিজেকে। ডান বগলটা সিটের ওপরে। বাঁ হাত বাঁ হ্যান্ডেলে। ডান হাত মধ্যখানের রডে। বাঁ পা মাটিতে। ডান পা? সাইকেলের ত্রিভুজটার ভেতর দিয়ে চালান করো ডান প্যাডেলে। একটু একটু করে প্যাডেলে চাপ। সাইকেল চলতে শুরু করলেই বাঁ পা-ও তুলে ফেলো প্যাডেলে। চলছে চলছে। হাফ প্যাডেল।

অমনি ধপাস। সাইকেল পড়ল একদিকে, তুমি পড়লে আরেক দিকে। তাহলে বাঁচা। সাইকেলের ওপরে পড়লে তো উঠে দেখলে হাত কেটে গেছে, ঠোঁট দিয়ে রক্ত ঝরছে। আরেকটু সাবালক হলে রডের নিচে চড়েই ফুল প্যাডেল। তারপর তুমি লম্বা হচ্ছ। এইবার তুমি রডে চড়ে চালাবে। সিটে নিতম্ব ঠেকালে পদশীর্ষ প্যাডেলের নাগাল পায় না যে। তারপর একটা সময় তুমি যথেষ্ট লম্বা। এইবার তুমি সিটে বসে চালাতে শুরু করলে। 

তারপর দুই হাত ছেড়ে দিয়ে চালাচ্ছ আর বন্ধুদের বলছ, দ্যাখ দ্যাখ, হাত নাই হাত নাই।

তারপর দুই পা তুলে ধরলে শূন্যে, দ্যাখ দ্যাখ, পা নাই পা নাই। তারপর ধপাস।

উঠে পড়লে। দ্যাখ দ্যাখ, দাঁত নাই, দাঁত নাই।

নিজের একটা সাইকেল হয়েছিল। তারও আগে, মুক্তিযুদ্ধের পর এসেছিল রাশিয়ান সাইকেল। পারমিটের দোকান থেকে চার শ টাকায় সেটা কেনা যেত। খুব কাজের ছিল না। এখনকার আধুনিক সাইকেলের মতো তার হ্যান্ডেল ছিল নিচের দিকে নামানো, সবাই নিজের উদ্যোগে সেটা মডিফাই করে উঁচু করে নিতেন। আমাদের স্বপ্নের সাইকেল ছিল ফিনিক্স। চীন থেকে এসেছিল। আমরা অবশ্য বলতাম ফনিক্স। ফিনিক্স বললে দোকানদার ভাবত, কিছু জানে না, হাবা-গবেট কোথাকার! আব্বাদের আমলে নামী সাইকেল ছিল হারকিউলেস।

সাইকেলই ছিল আমাদের একমাত্র বাহন। আবুল হাসান কবিতায় লিখেছিলেন, ‘হে কবিতা, তুমি কি দেখোনি আমাদের ঘরে ঘরে তাঁতকল, সাইকেলে পথিক।’ মানে সাইকেল ছিল আমাদের অবস্থাপন্নতার প্রতীক। শামসুর রাহমান তার অতিবিখ্যাত কবিতা ‘এখানে দরজা ছিল’–তে লিখেছিলেন:

‘এখানে দরজা ছিল, দরজার ওপর 

মাধবী—

লতার একান্ত শোভা। বারান্দায় 

টব, সাইকেল

ছিল, তিন চাকা-অলা,

সবুজ কথক একজন

দ্বারবন্দী। রান্নাঘরে থেকে উঠত 

রেশমি ধোঁয়া।’

পঞ্চাশের দশকের ঢাকার স্মৃতিকথাগুলোতেও সাইকেলের কথা আসে ঘুরে-ফিরে। তাজউদ্দীন আহমদের সাইকেল ছিল। সেটা নিয়েই তিনি চষে বেড়াতেন ঢাকা। আর আনিসুজ্জামান স্যার ১৯৫১–১৯৫২ সালে সাইকেল চালাতেন, তা আনিসুজ্জামানের কাল নিরবধি বইতেই পাই। কল্পনা করতে পারি, ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির প্রেক্ষাপটে ফরিদপুর কারাগার থেকে পাঠানো শেখ মুজিবের বিবৃতিটি নিয়ে সংবাদপত্র অফিসে অফিসে যাচ্ছেন, তা-ও ওই সাইকেলে। শহীদ হবেন যিনি, শফিউর রহমান, হাইকোর্টের কেরানি,
সাইকেলে চড়েই যাচ্ছিলেন অফিস করতে, গুলি এসে লাগল, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙা হয়ে উঠল একুশে ফেব্রুয়ারি।

তারও আগে, বুদ্ধদেব বসু তাঁর আমার যৌবন–এ লেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ণনা: 

‘আমি যখন কলেজের গাড়ি বারান্দায়, ঠিক তখুনি সাইকেল থেকে নামেন আমাদের ইংরেজি বিভাগের সত্যেন্দ্রনাথ রায়, সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে যার তুল্য লাজুক অধ্যাপক আর নেই—আমাকে দেখে ঈষৎ লাল হন তিনি, মৃদু কেশে নরম আওয়াজে বলেন, “এই যে বুদ্ধ, ভালো আছ?” আমি করিডর দিয়ে যেতে যেতে শুনি ঘণ্টার শব্দ।’ ছাত্ররাও যে দল বেঁধে সাইকেল নিয়ে আসে ক্যাম্পাসে, সে বিবরণও আছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাইকেল নিয়ে কী লিখেছেন, তদন্ত করতে নেমে বদনাম অর্জন করা গেল। কবিগুরুর একটা গুপ্তপ্রায় গল্প আছে, ‘বদনাম’ নামে, তার শুরু হয় সাইকেলের ক্রিং ক্রিং আওয়াজ দিয়ে, সাইকেল থেকে নামেন ইন্সপেক্টর বিজয়বাবু। আজকের দিনে এটা থেকে খুব ভালো টেলি–সিনেমা হয়, আমাকে যথাযথ পারিশ্রমিক দিলে আমি পাণ্ডুলিপি লিখে দিতেও পারি। বদনামের ভাগি হব, ক্ষতিপূরণটা যথেষ্ট হওয়া চাই। 

আহা! আমাদের সাইকেল। প্রতিটা সিনেমা হলে, প্রতিটা বাজারে, প্রতিটা কলেজে, প্রতিটা বাসস্টপেজে থাকত সাইকেলের গ্যারেজ। আমরা আট আনা পয়সার বিনিময়ে সেখানে সাইকেল রাখতে পারতাম। আমাদের প্রত্যেকের পায়জামা কিংবা ফুলপ্যান্টের ডান পায়ে থাকত সাইকেলের চেইনের দাগ। সাইকেলের চাকা লিক করত, ‘বার্স্ট’ করত; মেকারের কাছে যেতাম আমরা, তাঁরা লাল রঙের টিউবে ঝামা ঘষে লাল রঙের রাবার দিয়ে পট্টি লাগাতেন। অতি অল্প বয়স থেকে সাইকেল চালাতে চালাতে আমাদের হার্নিয়া হতো, হাইড্রোসিল হতো।

হায়, সেই শটিবন আর নেই। নেই সেই সাইকেল। তার বদলে এসেছে আধুনিক সব সাইকেল। তাতে নাকি গিয়ারও আছে। বাংলাদেশ সাইকেল রপ্তানি করছে উন্নত দেশগুলোয়। বাহবা। উন্নত দেশের উন্নত শহরগুলো পরিবেশবান্ধব হয়ে উঠছে, সাইকেল চালানোকে সেখানে খুবই উৎসাহিত করা হচ্ছে। স্টকহোমের মতো শহরগুলোয় সাইকেলের জন্য আলাদা লেন, বাসে–ট্রেনে করে সাইকেল নেওয়ার সুব্যবস্থা, স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে সাইকেল ধার নেওয়ার সুব্যবস্থা—এসব দেখলে মনে হবে, ওখানে সাইকেলচালক সত্যিকারের ভিআইপি। 

সাইকেল প্রসঙ্গে বাইসাইকেল থিভস ছবিটার কথা না বললে লেখা অসম্পূর্ণ থাকে। ভিত্তোরিও ডি সিকা পরিচালিত ১৯৪৮ সালের এই ছবিটা ১৯৮০–এর দশকে আমাদের জন্য অবশ্যদ্রষ্টব্য ছিল। আর বিশেষভাবে বলতে হবে পাবলো পিকাসোর ‘ষাঁড়ের মাথা’ নামের ভাস্কর্যের কথা। সাইকেলের একটা হ্যান্ডেলের মধ্যে সাইকেলের সিটটা বসিয়ে দিয়ে তিনি এই অপূর্ব ভাস্কর্যটি রচনা করেন। তাঁর বাণী আছে, যদি েকউ এই ভাস্কর্যে শুধু ষাঁড়ের মাথাটাই দেখতে পায়, সাইকেলটা না দেখতে পায়, তাহলে তার দেখা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। 

শেষে উমবার্তো ইকোর এই কথাটা বলি, যতই ই-বুক আসুক, বই থাকবে, যেমন যতই মোটরগাড়ি–মোটরসাইকেল আসুক, পায়ে ঠেলা সাইকেল থাকবেই। আর বলি আইনস্টাইনের কথা, জীবন হলো বাইসাইকেল চালানোর মতো, সব সময় চালাতে হয়, তা নাহলে পড়ে যেতে হয়!