প্রান্তিক লোকজীবনের চাররঙা ছবি

লালনের আখড়ায় বাউলগানের আসর। ছবি: কবির হোসেন
লালনের আখড়ায় বাউলগানের আসর। ছবি: কবির হোসেন

সুমনকুমার দাশ পেশাগতভাবে মনে-প্রাণে সাংবাদিক। তবে পেশার বাইরে তাঁর গভীর গবেষণা প্রয়াসের কেন্দ্র ‘গ্রামীণ জনপদে ছড়িয়ে থাকা সাধক-বাউল-ফকির-তন্ত্রসাধক-মহাজনদের জীবনযাপন আর তাঁদের সাধনার’ বিষয়। তাঁর সেই সাধনারই একান্ত ফসল বাউলের আখড়ায় ফকিরের ডেরায় নামের আমাদের আলোচ্য এ বই।

চটি আকারের হলেও, বইটির বিষয়বস্তু সংগ্রহে যে পরিশ্রম তাঁকে করতে হয়েছে, সেই ভাষ্যটা শোনা যাক লেখক সুমনকুমার দাশের কাছে। ‘অপরূপের কত রূপদরশন’ শিরোনামের ভূমিকা মারফত তিনি আমাদের জানাচ্ছেন, ‘দেড় দশকের বেশি সময় ধরে আমি বাংলাদেশের নানা স্থানে মেলা-মচ্ছব-ওরস-শ্মশান-মাজার, ফকিরের ডেরা, বাউলের আখড়া আর গ্রামীণ জনপদ ঘুরে নানা সাধক, তান্ত্রিক-ফকির-বাউলের সাক্ষাৎ পেয়েছি। এ বইয়ের প্রতিটি কাহিনির সূত্র তাঁদের সঙ্গে কাটানো সময় আর ব্যক্তিগত আলাপচারিতা। এসব সাধকের সঙ্গে মিলেমিশে আমি যে অন্য ভুবনের সন্ধান পেয়েছি, তার কথা হয়তো যথাযথভাবে এখানে তুলে ধরতে পারিনি। সেটা আমার ব্যর্থতা।’

ভূমিকায় লেখা সুমনের এই বিনয় বইটির পাঠ শেষ করার পর আর ধোপে টেকে না। কথাটা এ কারণেই বলা যে ভ্রাম্যমাণ গবেষকের মতো অদম্য উদ্দীপনা নিয়ে তিনি চষে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চল। খুঁজে পেয়েছেন এমন সব বাউল, ফকির ও তান্ত্রিক সাধকদের, যাঁরা প্রান্তিকবাসী হওয়া সত্ত্বেও অক্ষুণ্ন রেখেছেন তাঁদের শৈল্পিক ও জীবন-দর্শনের ধারা। কী তাঁদের সেই শৈল্পিক জীবনের ধারা বা দর্শনের স্বরূপ? তারও বিবরণ তুলে ধরেছেন তিনি বাউল–ফকিরের ডেরা বা আস্তানার পর আস্তানায় ঢুঁ মেরে, তাঁদের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে কথা বলে।

শহুরে জীবনে আমরা যখন নানা সংকটের প্রাত্যহিক বেড়াজালে আবদ্ধ, তখন এ বই পড়ে জানতে পারছি বাংলাদেশের গভীর গ্রামেগঞ্জে, প্রান্তিক জনপদে বাউল, ফকিরেরা তাঁদের জীবন দর্শনের ভিত্তিতে, মূলত গানের মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন নিজেদের বৃত্ত। সেই বৃত্ত জড় কোনো বৃত্ত নয়—সদা চঞ্চল তার গতি। সেই গতি জীবনের অর্থ খোঁজার লক্ষ্যে ধাবমান। মাসের পর মাস ধরে চলে তাঁদের আস্তানা আর ডেরায় লোকগানের মাহফিল। কী ধরনের গান হয় সেখানে? গান হয় আল্লাহর গভীর সান্নিধ্য পাওয়ার। সুফিবাদে বিশ্বাসী ফকিরদের ভাষায়, ‘ফানাফিল্লার মাধ্যমে একজন সাধককে জগতের যাবতীয় মোহ-আসক্তি-বস্তু সম্পর্কে চেতনার বিলোপ ঘটাতে হয়। আর বাকাবিল্লাহ হচ্ছে চেতনার বিলোপ ঘটিয়ে পরম সত্তা, অর্থাৎ আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের আশায় নিরন্তর কাজ করে যাওয়া।’ সুমনকুমার দাশ এভাবে কেবল আখড়া ও ডেরার ফকিরদের দর্শনের সঙ্গেই আমাদের পরিচয় করাননি, বইয়ের প্রথম প্রবন্ধের ভেতর দিয়ে প্রায় ১১ শতক থেকে সিলেট জেলার বৃহত্তর অংশে তাঁদের পূর্বসুরি গুরু, পীর-দরবেশদের আগমনের ইতহাসের পটভূমিও তুলে ধরেছেন। আর এসবই তিনি করেছেন ফকিরদের ডেরা ও আস্তানায় সশরীরে হাজির হয়ে তাঁদের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে কথা বলে। জেনেছেন, তাঁদের দর্শনের সুর প্রায় এক হলেও তা পালন বা প্রচারের আছে নানা পদ্ধতি।

এ বইয়ে সুমন কোথাও থেমে থাকেননি। দুবার গিয়েছিলেন কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ার লালনধামে। প্রথমবার যখন গিয়েছিলেন, সে সময় সেখানে এত দালানকোঠা আর চাকচিক্য ছিল না। এখানে এসেও লেখক ফকিরদের কাছ থেকে অনেক কথা জানেন। জানেন লালন সাঁই সম্পর্কে নতুন করে অনেক কিছু। দুদ্দু শাহ সম্পর্কেও। জানতে পারেন, ‘প্রকৃত লালন অনুসারীরা নেশা করে না, গাঁজা খায় না।’ শোনেন লালনের কালজয়ী কিছু গান। সুমনের বর্ণনার গুণে আমরা পৌঁছে যাই ছেউড়িয়ার আখড়ায়। আবার সিলেটের ওসমানী নগর উপজেলার পশ্চিম ব্রাহ্মণ গ্রাম ও কুলাউড়ার পৃথ্বিমপাশাসহ আরও কয়েকটি জায়গায় লেখক দেখেছেন আশুরা পালনের জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে এসেও একাধিকবার দেখা পেয়েছেন কোনো না কোনো পীরের। জানতে পেরেছেন ‘পাক পাঞ্জাতনের’ মোকামের কথা। সন্ধান পেয়েছেন জারিগানের।

‘তন্ত্রসাধনার পথ ধরে’ এ বইয়ের শেষ প্রবন্ধ। এতে ধারণ করা হয়েছে বৃহত্তর সিলেটের কয়েকটি জায়গার তান্ত্রিক সাধকদের কথা। তুলে ধরা হয়েছে খুবই অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে তাঁদের তন্ত্র-মন্ত্রের বিবরণ। এরা ভণ্ড তান্ত্রিক নন। যে জীবন সনাতন ধর্মের তান্ত্রিকেরা বিগত বহু শতাব্দী ধরে পালন করে এসেছেন, সুমনের দেখা এসব তান্ত্রিক ঠিক সেই ধারাতেই অক্ষুণ্ন রেখেছেন তাঁদের জীবন।

বয়সে এখনো তরুণ সুমন দাশ। তাঁর সামনে এখনো বহু পথ পাড়ি দেওয়ার সুযোগ। আমরা চাই তাঁর কাঙ্ক্ষিত ঋদ্ধ গবেষক জীবন, বিশেষ করে প্রান্তিক লোক-জীবন নিয়ে।

এ বইয়ের পাঠ সমৃদ্ধ করবে পাঠকের মনকে।

বাউলের আখড়ায় ফকিরের ডেরায়

সুমনকুমার দাশ

প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

প্রকাশকাল: এপ্রিল ২০১৯

পৃষ্ঠা: ১১৯, দাম: ২৪০ টাকা।