বাগিচায় বুলবুলি তুই

>

দ্বিজেন শর্মা (২৯ মে ১৯২৯—১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭)। ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম
দ্বিজেন শর্মা (২৯ মে ১৯২৯—১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭)। ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম

১৫ সেপ্টেম্বর দ্বিজেন শর্মার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁকে শ্রদ্ধা।

অনেক দিন পর বাড়ি গিয়ে দেখি রক্তকরবীর ঝাড়ে একটি তেলাকুচা লতা জাঁকিয়ে বসেছে। সাদা ফুল, সিঁদুররাঙা ফল। সবুজের সঙ্গে সাদা-লালের বর্ণবৈগুণ্যে দৃষ্টিনন্দন। কিন্তু ওকে তো রাখা চলে না। বনলতা মাত্রই ত্যাঁদড়, রক্তকরবীকে একসময় গিলে ফেলবে। কিছুক্ষণ পর দুটি বুলবুলি তেলাকুচার ফল খুঁটতে শুরু করল। চলল অনেকক্ষণ। তারপর এল দুটি বসন্তবাউরি, সবুজ রঙের, মাথায় লাল টোপর, ঝগড়া বাধাল বুলবুলির সঙ্গে। তেলাকুচা তাহলে পাখিবান্ধব লতা? কিন্তু লালিত বাগানের কুলীন উদ্ভিদকুলে কি ব্রাত্য তেলাকুচার ঠাঁই হবে? হওয়া উচিত, কেননা, লতাটি একাধারে ঔষধি ও সবজি। তা ছাড়া বনের গাছপালা এখন উজাড় হতে চলেছে, তাদের সুরক্ষা প্রয়োজন। তাই বড় বাগান ও পার্কে মাকাল-গিলালতা, জলাশয় সজ্জায় কাশ-নলখাগড়া ও হোগলা লাগানোর কথা ভাবা যেতে পারে।

একসময় স্থানীয় বনফুল দিয়েই আমাদের বাগান সাজানো হতো। পরে জুটেছে বিদেশি ফুল। তাতে বাগান থেকে কিছু দেশি ফুল বিদায় হয়েছে (মাধবীলতা) এবং কিছু বিদেশি ফুল বনজঙ্গলেও ছড়িয়ে পড়েছে। এগুলোরই একটি কাঠকরবী, কাঠমল্লিকা বা বুনো টগর। মাধবীকে হটিয়েছে ব্রহ্মলতা, রেঙ্গুনক্রিপার বা মধুমঞ্জরি (মধুমালতী)। এখন আমরা এই বিদেশিনীকেই মাধবী নামে চিনি। কিন্তু এটা মাধবী নয়। আমার ভিষক পিতার বাগানে ছিল লবঙ্গলতা, সাদা ফুল, সুগন্ধি। এখন নেই, কোনো বাগানেই নেই। কিছুদিন আগে সৌরভ মাহমুদ একটি খুঁজে পেয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের বনে। তারও তো পুনর্বাসন প্রয়োজন। আমাদের বাড়িতে ছিল সব রঙের ঝিন্টি সাদা, হলুদ, বেগুনি ও লাল কুরুবক, এখন দুষ্প্রাপ্য। এত দিন দাঁতরাঙা হালকা বেগুনি ফুলে বন আলো করে রাখত, ইদানীং বাগানে ঠাঁই পেয়েছে। থানবার্জিয়া গ্রান্ডিফ্লোরা একটি চমৎকার বনলতা, সাদা বা হালকা বেগুনি বড় বড় ফুল, শহরে দৈবাৎ চোখে পড়ে। এই বর্গের আরেকটি থানবার্জিয়া ফ্রাগরেন্স, সাদা নির্গন্ধ ফুল, আমার বারান্দায় প্রায় সারা বছর ফুল ফোটায়। অনেকেই চারা চান। লতাটি আমার ছাত্র শেখর রায় দিয়েছিল। সে আর বেঁচে নেই, তাই নাম দিয়েছি শেখর লতা। বনে এখনো অনেক নয়নশোভন বৃক্ষ ও লতাগুল্ম রয়েছে। এগুলোর পুনর্বাসনের দায় বোটানিক্যাল গার্ডেনের। আশা করি জাতীয় হার্বেরিয়ামের সহায়তায় তারা কাজটি সম্পন্ন করবে।

অনেক বছর আগে নেত্রকোনা শহর লাগোয়া এক শণখলায় একটি খুদে গুল্ম পেয়েছিলাম। থোকা থোকা বেগুনি ফুলে ঝলমলে, সম্ভবত দাঁতরাঙা গোত্রীয়, শনাক্ত করতে পারিনি। তারপর অনেক হেঁটেও আর খুঁজে পাইনি। ওসবেকিয়ার কয়েকটি প্রজাতির ফুলও চমৎকার, বাগানে নেই, প্রকৃতিতেও দুষ্প্রাপ্য, হতে পারে বিপন্ন। দুলিচাঁপারও একই অবস্থা।

আমার কথা ফুরল। এবার আমাদের বাগানের কিছু দেশি ও বিদেশি ফুল। দেশি: স্বর্ণচাঁপা, হিজল, করঞ্জা বা করচ, নাগেশ্বর, মুচকুন্দ, শিমুল, লালসোনাইল, অশোক, বান্দরলাঠি (সোনালু, সোঁদাল), কামিনী, পলাশ, মান্দার, শিরীষ, শেফালি, ছাতিম, কুরচি, কদম, মোরগফুল, দোলনচাঁপা, অপরাজিতা, জুঁই, বেলি, কাঞ্চন, অতসী, জয়ন্তী, ঝিন্টি বা ঝাঁটি (সাদা ও নীল), ধুতরা, উলটচণ্ডাল, রঙ্গন, পদ্ম (এশীয়), শাপলা, রক্তকমল, ফুরুস ও লেডিস আমব্রেলা। পরদেশি, কিন্তু বাংলায় প্রতিষ্ঠিত: রক্তজবা (চীন ও মহাসাগরীয় দ্বীপাঞ্চল), নীল জবা (কোরিয়া), লঙ্কা জবা (গ্রিস), ঝুমকো জবা (আফ্রিকা), স্থলপদ্ম (চীন), টগর (দক্ষিণ আমেরিকা), বকুল (মিয়ানমার-ওয়েস্ট ইন্ডিজ), কৃষ্ণচূড়া (পূর্ব আফ্রিকা), রাধাচূড়া (গুল্ম, লাল ও হলুদ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ), গাঁদা (মেক্সিকো), হাসনাহেনা (ওয়েস্ট ইন্ডিজ), নয়নতারা (ওয়েস্ট ইন্ডিজ), গন্ধরাজ (চীন ও জাপান), কলাবতী/সর্বজয়া (দক্ষিণ আমেরিকা), সূর্যমুখী (উত্তর আমেরিকা), চন্দ্রমল্লিকা/ক্রিসেনথিমাম (চীন), সন্ধ্যামণি (দক্ষিণ আমেরিকা), বাগানবিলাস (ব্রাজিল), গোলাপ (বাংলাদেশ ও হিমালয়ে একটি করে বুনো প্রজাতি)।

সংগ্রহ ও ভূমিকা: মোকারম হোসেন

প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক সংগঠন তরুপল্লবের মুখপত্র প্রকৃতিপত্রর লেখার সংকট নৈমিত্তিক বিষয়। সংকট চরম হলে দ্বিজেন শর্মার কাছে লেখা চাই। দাদা আশ্বস্ত না করলেও একেবারে নিরাশ করেন না। অপেক্ষা করি। মাঝেমধ্যে পেয়েও যাই। আমাকে চমকে দিয়ে ফোন করতেন, ‘তোমার লেখা হয়ে গেছে, নিয়া যাও।’ তাঁর কাছ থেকে লেখা পাওয়া সহজ ছিল না। তিনি লিখেছেন কম। যেটুকু লিখেছেন, তা নিখাদ। দীর্ঘদিন পর ২০১৭ সালে তিনি গ্রামের বাড়ি বড়লেখায় গেলেন। শৈশব কাটানো পাথারিয়া পাহাড় নিয়ে স্মৃতিকাতরতায় ভুগতেন তিনি। ফিরে আসার পর সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় দেখা হলো। ফের জন্মস্থানের গল্প। ছেলেবেলায় দেখা অনেক সুদর্শন ফুল খুঁজে না পাওয়ার হাহাকার। বললেন, ‘এইবার তুমি লেখা পাইবা।’ সে লেখাই ২০১৭ সালে প্রকৃতিপত্রর ১৫তম সংখ্যায় ছাপা হলো। ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ শিরোনামে এ লেখা দ্বিজেন শর্মার কোনো বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।