প্রতিক্রিয়া: 'বিস্ময়বস্ত্র' নিয়ে আমার কথা

>

৬ সেপ্টেম্বর শেখ সাইফুর রহমানের ‘বিস্ময়বস্ত্র’ নিবন্ধটির পরিপ্রেক্ষিতে একটি প্রতিক্রিয়া লিখেছেন শাওন আকন্দ। এখানে ছাপা হলো লেখকের জবাব। 

প্রতিক্রিয়া পাঠানোর ঠিকানা: অন্য আলো, প্রথম আলো ভবন, ১৯ কারওয়ান বাজার, ঢাকা–১২১৫। ই–মেইল: [email protected] 

প্রথম আলোর ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯-এর ‘অন্য আলো’তে ‘বিস্ময়বস্ত্র’ শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধ পড়ে কিছু বিষয়ের অবতারণা করেছেন বয়নগবেষক এবং শিল্পী শাওন আকন্দ। এ জন্য তিনি অবশ্যই ধন্যবাদার্হ হবেন।

শাওন আকন্দের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দু–চার কথা জানানোর প্রয়াসেই এ লেখার অবতারণা। 

প্রথমেই বলতে চাই ‘বিস্ময়বস্ত্র’ লেখাটি কেবল মসলিন আর জামদানিতে সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি। এই দুটো বস্ত্র পুরো লেখার একটি অংশ ছিল মাত্র। তবে বাংলাদেশের বয়ন ইতিহাসে এর গুরুত্ব সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই।

বাংলা বা এই ভূখণ্ড প্রাচীনকাল থেকেই পারঙ্গম ছিল বস্ত্রবয়নে। বিভিন্ন ধরনের বস্ত্র বোনা হতো হস্তচালিত তাঁতে। সূক্ষ্ম বস্ত্রে আবার সূচিকর্মও করা হতো। এখানে ইতিহাসবিদ ও গবেষকেরা ইংরেজি ‘এমব্রয়ডারি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সেই সময়ে বয়নকালে তাঁতে নকশা করা হতো কি না, তার উল্লেখ নেই। তবে এমব্রয়ডারি করা এ ধরনের বস্ত্রের বর্ণনা আমরা মেগাস্থিনিসের লেখায় পাই। সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজসভার সভাসদদের এই বস্ত্র পরিহিত দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন মেগাস্থিনিস। এ ক্ষেত্রে তাই ধন্দ থেকে যায়, এই কাপড় বোনার সময় নকশা করা নাকি পরে সূচিকর্ম করা। তবে মসলিনের ক্ষেত্রে সন্দেহের কোনো কারণ নেই। কেননা, একমাত্র জামদানি বোনার সময়েই তাঁতে হাতে নকশা করা হতো। আর অন্য সব ধরনের মসলিনের ক্ষেত্রে বোনার পরে সেই থান কাপড়ে সূচিকর্ম করা হতো। মসলিনে এই সূচিকর্ম বিখ্যাত ছিল। বিশেষ করে চিক্কনকারি ছিল অতীব জনপ্রিয়। ইংরেজ দুহিতারা তাদের বিয়ের গাউনের জন্য এই কাপড়ের প্রতীক্ষায় থাকত বলে জানা যায়। ঢাকা তখন চিক্কনকারির জন্য বিখ্যাত ছিল। মসলিনের একটি ধরন হিসেবে বর্তমানে জামদানিই তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। এই কাপড় বোনার সময় ফুল তোলার বিশেষ পদ্ধতি যে পারস্যের বয়নশিল্পীদের কাছ থেকে রপ্ত করা, সে কথাও পাওয়া যায় ইতিহাসবিদের ভাষ্যে। (সূত্র: কমার্শিয়াল হিস্ট্রি অব ঢাকা, ডিসিসিআই, পৃ. ৪২১-৪২২)। 

জামদান শব্দটি ফারসি। নিশ্চয়ই এ নিয়ে জনাব শাওন আকন্দ দ্বিমত পোষণ করবেন না। জামদানি শব্দটির উদ্ভবের ব্যাখ্যা করা হয়েছে তিনভাবে। ফারসি জামদার মানে বাটিক। আবার জামা মানে কাপড় আর দানা মানে বাটিক। আরেক ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, জাম মানে পানীয় আর দানি মানে আধার। সব শব্দই ফারসি। এমনকি এটা অনুকল্প হলেও জামদানি শব্দের উদ্ভবে যে ফারসি সংযোগ রয়েছে, সে বিষয়ে ওয়াট ও পার্সি ব্রাউন অভিমত দিয়েছেন। (সূত্র: কমার্শিয়াল হিস্ট্রি অব ঢাকা, ডিসিসিআই, পৃ. ৪২১-৪২২)। 

জামদানি বিষয়ে নানা তথ্য-উপাত্ত দেখার আলোকেই বলা হয়েছে, সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়েই জামদানির উৎপত্তি। কারণ, পারস্যের বয়নশিল্পীরা ওই সময়েই এসেছিলেন। এ প্রসঙ্গেই মন্ত্রিকন্যা ও সম্রাজ্ঞী হিসেবে মসলিন আর জামদানিপ্রীতি নুরজাহানের থাকতেই পারে। সেই উল্লেখই আমার নিবন্ধে রয়েছে। 

এরপর বিভিন্ন পর্যটকের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি সোনারগাঁয়ের প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। এটিতেও সন্দেহ পোষণের কোনো কারণ নেই। কেন না, এত দিনে সোনারগাঁ বা সুবর্ণগ্রামের কথা সবাই জানেন।

আর জামদানি প্রসঙ্গে ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে এর উদ্ভবকাল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শাওন, কেবল তা–ই নয়, পারস্য ছাড়াও তুরস্ক এবং অন্য দেশের প্রভাব জামদানিতে থাকতে পারে বলে তিনি মনে করছেন। তবে এমন কোনো তথ্য আমার জানা নেই। কিংবা জামদানি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমার চোখে পড়েনি। তবে পারস্যের প্রভাব যে আছে, আর সেখানকার বয়নশিল্পীদের ভূমিকা যে রয়েছে, সেটি আমার নিবন্ধে স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে আরও একটি বিষয় বলা প্রয়োজন, সেটি হলো, জামদানি বস্তুত একটি বয়নকৌশল, যা পারস্যের বয়নশিল্পীদের কাছ থেকে স্থানীয় বয়নশিল্পীরা রপ্ত করেছেন। 

মিসরের মমির গায়ে মসলিনের উল্লেখ নিয়েও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। মমির গায়ে লিনেন ছিল, সেটা অস্বীকার করা হচ্ছে না। কিন্তু প্রাকৃতিক নীল বা ইন্ডিগো রঞ্জিত সুতি কাপড়ও সেখানে পাওয়া গেছে। এই প্রসঙ্গে পল ক্ল্যামার ও অনির্বাণ মহাপাত্রের লোনলি প্ল্যানেট বাংলাদেশ বইয়ের ‘বাংলাদেশ’স গোল্ডেন সিটি’ অংশে লেখা হয়েছে: ইন ১৫৮৫, র​্যালফ ফিচ নোটেড দ্যাট ইট ওয়াজ অ্যান ইমপর্ট্যান্ট সেন্টার ফর দ্য ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড এক্সপোর্ট কানথা (ট্র্যাডিশনাল ইন্ডিগো ডায়েড মাসলিন), দ্য ফাইনেস্ট ইন অল অব ইন্ডিয়া। এনশেন্ট ইজিপশিয়ান মামিজ ওয়্যার রিপোর্টেডলি র​্যাপড ইন দিস কানথা একপোর্টেড ফ্রম বেঙ্গল।’ 

আর ভ্রম নিয়ে তিনি যেটা বলেছেন, তার প্রথমটি অর্থাৎ ‘পেরিপ্লাস’-এর পরিবর্তে ‘পেরিপেরাস’ আসলে অনবধানতাবশত হয়ে থাকবে। আর এই উপমহাদেশের বস্ত্রের টানেই যে ইউরোপীয় বণিকেরা এসেছিলেন, সেটা অনস্বীকার্য। পাশাপাশি তাঁরা অন্য ব্যবসা যে করেননি, সেটা বলা হয়নি।