বুড়ো বিউটি বোর্ডিং, তারকের তারুণ্য ও অন্যান্য

বিউটি বোর্ডিংয়ের তারক সাহা
বিউটি বোর্ডিংয়ের তারক সাহা

‘তারকদা, আমার স্কুলবন্ধুদের নিয়ে আজ বিউটিতে আসব, একটু দেরি হতে পারে। আপনি আমাদের জন্য অবশ্যই ইলিশ আর ভর্তা তুলে রাখবেন।’

‘আরে আসেন আসেন। শেখ আবদুল হাকিম, বুলবুল চৌধুরী ভাই আর ধ্রুব এষ দাদাও আসবেন আজ। কোনো চিন্তা নেই, খাবার তোলাই থাকবে।’ 

এই সেদিন রৌদ্রতপ্ত শুক্রবার দুপুরে বিউটি বোর্ডিংয়ে বন্ধু সৌরভ, সৌমিত্র আর মানিককে নিয়ে ঢুঁ মারার আগে এই ছিল তারক সাহার সঙ্গে আমার শেষ কথা। পৌঁছানোর পর আন্তরিক আপ্যায়নের সঙ্গে সঙ্গে অনুযোগের স্বর, ‘পিয়াস ভাই, বিউটিতে আজকাল এত কম আসেন কেন?’ 

আমি তো কারণে-অকারণে পুরান ঢাকায় যাই। তারও বেশি কারণে-অকারণে যাই বিউটি বোর্ডিংয়ে। এই তো কয়েক মাস আগে বন্ধু নাহিয়ান ফাহিম বিউটি বোর্ডিং নিয়ে একটা প্রামাণ্যচিত্রের কাজ শুরু করলে সেখানে ইতিহাসবিবরণী দিতে বারকয়েক সদলবলে হানা দিয়েছে তারকদার উদার দরবারে। ভালোবাসেন বলেই হয়তো আরও বেশি দেখতে চাইতেন। এমনটা শুধু আমার বেলায় নয়, বিউটি বোর্ডিংয়ে আসতেন-যেতেন যেসব কবি-লেখক-প্রকাশক; সবার সঙ্গেই এটা ছিল তারকদার সাধারণ আচরণ; নিরঙ্কুশ ব্যবসাবৃত্তির যুগে যা সুদুর্লভ।

কে এই তারকচন্দ্র সাহা? পুরান ঢাকার ১ শ্রীশ দাস লেনের নলিনী মোহন সাহা আর প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা—এই দুই ভাই িমলে সত্তর বছর আগে নলিনী মোহন সাহার কন্যা বিউটির নামে চালু করেন আবাসিক হোটেল ও রেস্তোরাঁ। প্রহ্লাদ সাহারই সন্তান তারক সাহা। সব সময় ঐতিহ্য-ঘোরগ্রস্ত থাকতেন। বলতেন, এই জায়গাতেই ছিল সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার অফিস, ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত সে পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা। তারপর বিউটি প্রতিষ্ঠিত হলে শহীদ কাদরী এখানে শুরু করেন সাহিত্যিক আড্ডা। 

এই ফাঁকে একটা সুখস্মৃতি চারণ করে নেওয়া যাক। ২০১৭ সালে সৈয়দ শামসুল হক স্মরণগ্রন্থের কাজ করছিলাম, বইয়ের প্রকাশক চারুলিপির হুমায়ূন কবীর ভাই আর আমি কাজের অবসরে খেয়ে আসতাম বিউটি থেকে। বইয়ের কাজ যখন প্রেসমুখী, ঠিক তখনই মাথায় এল তারক সাহাকে ফোন করলে ওয়েলকাম টিউনে বেজে উঠে শিমুল মুস্তাফার কণ্ঠে সৈয়দ হকের ‘আমার পরিচয়’–এর পঙ্​ক্তিগুচ্ছ ‘আমি জন্মেছি বাংলায়...।’ তো, বিউটি বোর্ডিংয়ের আদি আড্ডাধারীদের একজন সম্পর্কে সেখানকার অন্যতম স্বত্বাধিকারীর একটা লেখা নিলে কেমন হয়! হুমায়ূন ভাইও সায় দিলেন আমার ভাবনায়। তারকদাকে দুপুরে বলতেই সন্ধ্যার মধ্যে দিলেন নাতিদীর্ঘ একটি লেখা; ইতিহাস ও স্মৃতিঘন। শুরুটা এ রকম:

বিউটি বোর্ডিং ও সৈয়দ শামসুল হক একে অপরের সম্পূরক। বিউটি বোর্ডিং ছাড়া যেমন সৈয়দ হককে ভাবা যায় না, তেমনি সৈয়দ হক ছাড়া বিউটি বোর্ডিংকে ভাবা যায় না। বিউটি বোর্ডিং-এর খুব কাছে থাকতেন শহীদ কাদরী। শহীদ কাদরীই এই জায়গাটা আবিষ্কার করেন। তিনি আসতেন সবার আগে আর যেতেন সবার পরে। সৈয়দ হক থাকতেন লক্ষ্মীবাজার, বর্তমানে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের পাশে, শামসুর রাহমান থাকতেন আশেক লেন, ইসলামপুরে আর বেলাল চৌধুরী থাকতেন প্যারীদাস রোডে। এই তিনজনকে নিয়ে শহীদ কাদরী শুরু করেন বিউটি বোর্ডিংয়ের আড্ডা। তাই শহীদ কাদরীকে বলা হয় বিউটির আড্ডার জনক।

ইতিহাস-ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থান সব সময় তার উত্তরাধিকারীদের কাছে মধুর হয়ে ধরা দেয় না। দখলদারত্বের ভয়, মানুষের অযাচিত কৌতূহল ইত্যাদি নানা কারণে দুর্বহ ভার হয়েও দেখা দেয় তাদের কাছে। তারক সাহা বিরুদ্ধস্রোতের যাত্রী। তিনি তো সেই প্রহ্লাদ সাহার পুত্র, যিনি এখানে আরও সতেরোজনের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন। ১৯৭১ সালে এই বোর্ডিংয়ের সবকিছু তছনছ হয়ে গেলে স্বাধীনতার পর তারকদার মা প্রতিভা সাহা শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহায়তায় পুনরায় চালু করেন বিউটি বোর্ডিং। আর নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় তারকদা উদ্যোগ নেন পুরোনো বিউটিয়ানদের পুনর্মিলনীর। প্রতিষ্ঠিত হয় বিউটি বোর্ডিং সুধী সংঘ। তিনি ছিলেন এই সুধী সংঘ ট্রােস্টর সম্পাদক এবং িবউটি বোর্ডিংয়ের অন্যতম সত্ত্বাধীকারী। তো এরপর থেকে সুধী সংঘের উদ্যোগে বিউটি প্রাঙ্গণে প্রায় বসেছে সৃজনশীল আড্ডা। তারক সাহা এভাবে বিউটি বোর্ডিংয়ের হারানো ‘বিউটি’ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। 

সত্তর বছরের বিউটি বোর্ডিং। ছবি: সংগৃহীত
সত্তর বছরের বিউটি বোর্ডিং। ছবি: সংগৃহীত

এখানে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, এমনকি কলকাতা থেকেও উৎসাহী লোকজন আসত বিউটির ইতিহাস জানতে। ভরদুপুরে খাবারের ব্যস্ত আয়োজনের সময় কোনো ব্যবসায়ীরই এ নিয়ে উৎসাহী হওয়ার কথা না, কিন্তু তারকদা ছিলেন ব্যবসায়ীর ঊর্ধ্বে কিছু; তাই সবাইকে ধীরমধুর স্বরে বলতেন, ‘ওই যে ওই ঘরটাতে আবদুল জব্বার খানের মুখ ও মুখোশ-এর চিত্রনাট্য লেখা, পাশেরটাতে লেখা হয়েছে জহির রায়হানের কাচের দেয়াল-এর চিত্রনাট্য।’ 

আর খাবারের সময় আমাদের কারও কারও পাতে অর্ডারের অতিরিক্ত একটি মেনু তুলে দিয়ে বলতেন, এমন অনেক কিছু: 

‘শহীদ কাদরী ভাই কি ফোন করেন আমেরিকা থেকে? করলে বলবেন বিউটি বোর্ডিং তাঁকে মিস করে।’ 

‘টিয়া আপার সাথে কি দেখা হয়? বলবেন, শামসুর রাহমানের উদ্বোধন করা বাবার স্মৃতিফলক দেখতে অনেক লোক আসেন প্রতিদিন।’ 

‘আল মাহমুদ সাহেব মারাই গেলেন!’ 

‘আনোয়ারা সৈয়দ হক দিদিকে বলবেন, সৈয়দ শামসুল হক দাদার একটা ভালো ছবি দিতে। আমরা অফিসে সংরক্ষণ করব।’ 

‘বেলাল চৌধুরীর বিউটি বোর্ডিং নিয়ে লেখাটা খুব ভালো লেগেছে আমার।’

‘খালেদ চৌধুরীর পরিবারের কাউকে কি চেনেন? তিনি এখানে খুব আড্ডা দিতেন।’ 

‘অ্যারোমা দত্ত সংসদ সদস্য হওয়ায় খুব খুশি হয়েছি। তাঁর বাবা সঞ্জীব দত্ত এখানে নিয়মিত আসতেন।’

তারকদা লিখতেন না কিন্তু পড়তেন অনেক কিছু। শামসুর রাহমানের কালের ধুলোয় লেখা, সৈয়দ হকের তিন পয়সার জ্যোছনা, বেলাল চৌধুরীর নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায়—এসব বইয়ের পাতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে কথা বলতেন প্রায়ই; যেসব বইয়ের অক্ষর-রৌদ্রে বিউটি বোর্ডিং জেগে আছে বিস্মৃতির ছায়া উজিয়ে। 

বেলাল ভাইয়ের লেখায় তারকদা উঠে এসেছেন এভাবে:

প্রহ্লাদবাবুর ছেলে তরুণ তারক এখন বিউটির কর্ণধার। বড্ড লাজুক আর বিনয়ী।

সাতদশকি বয়সের ভারে বিউটি বোর্ডিং বুড়ো হয়ে আসে আর পঞ্চাশ পূর্ণ না হতে বিউটির হৃদয়বান তরুণ তারককে হৃদ্​রোগে চলে যেতে হয়। ২০০৩-এ লেখা মহাদেব সাহার কবিতার পঙ্​ক্তিতেই যেন এভাবে আগাম স্মরণ করা হয়েছে তারক সাহাকে: 

‘সেই পাখি উড়ে গেছে, ঝরে 

গেছে ফুল

সারাদিন বৃষ্টিভেজা বিউটি 

বোর্ডিং...’।