নিসর্গে মিশে থাকা এক স্থাপত্য

‘আর্কেডিয়া এডুকেশন প্রজেক্ট’ নামের এই প্রকল্পে গতানুগতিক ধারার বাইরে উভচর স্থাপনা নির্মাণ করেছেন সাইফ উল হক। ছবি: সংগৃহীত
‘আর্কেডিয়া এডুকেশন প্রজেক্ট’ নামের এই প্রকল্পে গতানুগতিক ধারার বাইরে উভচর স্থাপনা নির্মাণ করেছেন সাইফ উল হক। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকার কেরানীগঞ্জের দক্ষিণ কানারচরে একটি স্কুলের স্থাপত্যরূপ সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে। ইট, বালু, সিমেন্ট, কংক্রিট, গ্লাস আর বাহারি খোলসের গতানুগতিক ধারার বাইরেও যে এমন স্থাপনা তৈরি সম্ভব, তা দেখিয়েছেন স্কুলটির স্থপতি সাইফ উল হক। অতিসাধারণ স্কুলটি গড়ে তুলতে ব্যবহার করা হয়েছে নিতান্তই আমাদের চারপাশের দৈনন্দিন উপকরণ—বাঁশ, বাঁশের চাটাই, অব্যবহৃত ইস্পাতের পিপে। ‘আর্কেডিয়া এডুকেশন প্রজেক্ট’ নামের এ স্থাপনা কিছুদিন আগে জয় করেছে এ বছরের স্থাপত্যের অনন্য সম্মাননা ‘আগা খান অ্যাওয়ার্ড ফর আর্কিটেকচার ২০১৯’।

এটি ১৯৭৭ সালে চতুর্থ আগা খান প্রতিষ্ঠিত আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্কের স্থাপত্যবিষয়ক একটি সম্মাননা পুরস্কার। তিন বছর পরপর হাতে গোনা কিছু প্রকল্পকে পুরস্কারটি দেওয়া হয়। জাতীয় সংসদ ভবন, গ্রামীণ ব্যাংক হাউজিং প্রকল্প ও রুদ্রপুর মেটি স্কুল এর আগে এ পুরস্কার পেয়েছিল, কিন্তু তিনটিরই স্থপতি ছিলেন বিদেশি। ২০১৬ সালে প্রথম বাংলাদেশের দুজন স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম ও স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী যথাক্রমে ঢাকার বায়তুর রউফ মসজিদ ও গাইবান্ধার ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার প্রকল্পের জন্য এ সম্মাননা পান।

আর্কেডিয়া এডুকেশন প্রজেক্টের প্রতিষ্ঠাতা রাজিয়া আলম ৪০ বছর আগে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন। সেখানে দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে আসেন। এসে নিজের পেনশনের টাকায় মালেকা ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিনা মূল্যে শিক্ষাদানের লক্ষ্যে প্রথমে ভাড়া বাড়িতে স্কুলটির কার্যক্রম শুরু হয়। পরে ভাড়ার চুক্তি শেষ হলে তিনি স্কুলের নিজস্ব ভবন তৈরির জন্য স্বল্প মূল্যে জমি খোঁজ করতে গিয়ে নদীতীরে এ জায়গার সন্ধান পান। নদীর পাড়ে সবুজঘেরা জমি, দেখেই জমিটি কিনে ফেলেন তিনি। কেনার পর দেখতে পান, বছরের চার মাস এই জমি প্রায় ১০ ফুট পানিতে ডুবে থাকে।

সেই থেকে শুরু। রাজিয়া আলম কথা বলেন সাইফ উল হকের সঙ্গে। পরিকল্পনা হয়, এমনভাবে স্থাপনা করা হবে, যা বর্ষায় পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে আর শুকনা মৌসুমে বসে থাকবে মাটির ওপর। বৈশ্বিক উষ্ণতা পৃথিবীর চিরচেনা জলবায়ু পাল্টে ফেলেছে। মানুষের নতুন এ সংকটে প্রয়োজন পড়ছে স্থাপত্যে নতুন নতুন উদ্ভাবনা, যা একই সঙ্গে হবে পরিবেশবান্ধব, সহজলভ্য, ঐতিহ্যসংগত। এ ভাবনা মাথায় রেখেই সাশ্রয়ী ও স্থিতিশীল এই স্থাপনার কল্পনা করেছিলেন সাইফ উল হক। নিচু জমি ভরাট করে উঁচু বেদি বানিয়ে বা উঁচু খুঁটির ওপর ভবন নির্মাণ করা হলে শুকনা মৌসুমে ভবনটিকে দেখা যেত চারপাশ থেকে অনেকটা উঁচুতে। সমতলীয় নিসর্গে হয়ে পড়ত নিতান্ত খাপছাড়া। তাই সে পথে না গিয়ে তিনি উভচর এই স্থাপনার পরিকল্পনা করেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে বালুর বস্তার দেয়াল বানিয়ে ভেতরে সুরকি আর মাটি ফেলে জমি সমতল করা হয়। তার ওপরে বসানো হয় পুরোনো অব্যবহারযোগ্য টায়ার। এরপর মাটির দুই মিটার গভীরে বাঁশের খুঁটি গাঁথা হয়। তার সঙ্গে মূল ভবনের তলদেশের কাঠামো, অর্থাৎ বাঁশের পাটাতনটি ইস্পাতের ড্রামের ওপর এমন এক অভিনব কৌশলে বসানো হয়, যাতে তা পানির সঙ্গে ওঠানামা করতে পারে। সেই বাঁশের পাটাতনের ওপর স্থাপন করা হয় বাঁশের তৈরি ভবনের মূল কাঠামো।

ভবনের নকশা অনুভূমিকভাবে পূর্ব-পশ্চিমে প্রসারিত। এতে উত্তর-দক্ষিণমুখী লম্বা ভবনে আলো-বাতাস প্রবেশ করে পর্যাপ্ত। অবস্থানগত কারণে এই স্থিতিবোধ ভবনটিকে করে তোলে ওই নিসর্গের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেখানে আলো-ছায়া আলপনা আঁকে ঘড়ির কাঁটা ধরে।

প্রথমে অফিসকক্ষ। তারপর খোলা ছোট্ট বাগান বাঁশের পাটাতনের ওপর চারদিকের বিস্তীর্ণ সবুজকে আমন্ত্রণ করে। এর পরপর উত্তর-দক্ষিণে খোলা বারান্দার সঙ্গে যুক্ত তিনটি শ্রেণিকক্ষ। শেষ প্রান্ত আবার উন্মুক্ত। দূরে চোখে পড়ে নদীর হাতছানি। 

মূল ভবনের চাল উত্তল কাঠামোর ওপর বাঁশের চাটাইয়ে তৈরি। বেড়াও চাটাইয়ের। ভবনটিতে ব্যবহার করা হয়েছে তিন ধরনের বাঁশ। পাটাতনের নিচে স্টিলের ড্রাম। পাটাতন ও ড্রামগুলো যাতে পানির সংস্পর্শে এসে পচে না যায়, সে জন্য নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাঁশগুলো আশপাশের গ্রাম থেকে নদীতে ভাসিয়ে আনা হয়েছে। বাঁশের সহজে পচনশীল অংশগুলো আলাদা করা হয়েছে প্রথমে। তারপর রাসায়নিক দ্রবণে ভিজিয়ে ব্যবহারোপযোগী করা হয়েছে। শেষে লাগানো হয়েছে জেলেদের চিরন্তন গাবের কষের আঠা। এই আঠায় জেলেদের জাল পানিতে এত ব্যবহারের পরও সহজে পচে যায় না। ড্রামে প্রলেপ দেওয়া হয়েছে আলকাতরার।

এ ভবন তৈরিতে সবচেয়ে বলার মতো বিষয়, বিদ্যুৎ জ্বালানির স্বল্পতম ব্যবহার। সামান্য কিছু ব্যাটারিচালিত ড্রিল ছাড়া বাকি সব কাজ হয়েছে হস্তচালিত যন্ত্রপাতি দিয়ে।

পশ্চিমের তপ্ত রোদ থেকে শ্রেণিকক্ষকে শীতল রাখতে খুব পরিকল্পনা করে বসানো হয়েছে শৌচাগার। শৌচাগারের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য পলিমার সেপটিক ট্যাংক বালুর বস্তার দেয়ালের মধ্যে বাঁশের কাঠামো বানিয়ে এমনভাবে বসানো হয়েছে, যাতে বর্ষার পানি বাড়ার সঙ্গে সেপটিক ট্যাংকও ভেসে ওঠে। তা না হলে বর্ষা মৌসুমে ট্যাংক থেকে কঠিন বর্জ্য বাইরে ছড়িয়ে পরিবেশদূষণ ঘটাত। সেপটিক ট্যাংক সাধারণত দুই প্রকোষ্ঠবিশিষ্ট হয়। কঠিন বর্জ্য থিতিয়ে জলজ অংশ সোক পিটের মাধ্যমে প্রকৃতিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়। এই কঠিন পদ্ধতির খুব সহজ সমাধান করেছেন সাইফ উল হক দুটি পলিমার ট্যাংক ব্যবহার করে। ব্যবহারযোগ্য পানির চাহিদা মেটাতেও বাঁশের দুই স্তরের পাটাতন তৈরি করে চালার উচ্চতায় স্থাপন করেছেন পলিমার ট্যাংক।

বিশ্বজুড়ে এখনই স্থিতিশীল ও পরিবেশবান্ধব স্থাপত্যের প্রয়োজন আগের চেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে। অঞ্চলভেদে প্রাকৃতিক পরিবেশ, জলবায়ু ও স্থানীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ভিন্ন। বিবেচনায় রাখতে হয় জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের অর্থনৈতিক অবস্থাও। এই পটভূমিতে কেরানীগঞ্জের দক্ষিণ কানারচরের আর্কেডিয়া এডুকেশন প্রজেক্ট স্থপতি সাইফ উল হকের এক অনন্য নজির।