একনজরে 'ডাস ক্যাপিটাল'

কার্ল মার্ক্সের লেখা ডাস ক্যাপিটাল-এর প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ
কার্ল মার্ক্সের লেখা ডাস ক্যাপিটাল-এর প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ

কার্ল মার্ক্সের যুগান্তকারী বই ডাস ক্যাপিটাল এই সেপ্টেম্বর মাসেই পাড়ি দিল ১৫২ বছর। পৃথিবীকে প্রবলভাবে ঝাঁকুনি দিয়েছে যে বই, সেই গ্রন্থ কি এখনো প্রাসঙ্গিক, নাকি বাতিল হয়ে গেছে তার তত্ত্ব? উইকিপিডিয়া বলছে, সমাজবিজ্ঞানের গবেষণায় সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃত বই হলো ডাস ক্যাপিটাল। অন্তর্জাল ঘাঁটলে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি মানুষ নাম শুনেছে কিন্তু পড়েনি, এমন বইয়ের তালিকা করলেও ওপরের দিকেই থাকবে ডাস ক্যাপিটাল।

উনিশ শতকের জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্ক্স ডাস ক্যাপিটাল লিখতে শুরু করেছিলেন ১৮৫৭ সালে। যে বছর বইটি লিখতে শুরু করেন তিনি, ওই বছরই মারা যায় তাঁর এক সন্তান। বইটি লিখতে তাঁর সময় লেগেছিল ১০ বছর। এই ১০ বছরই দারিদ্র্যের তীব্র কশাঘাতে জর্জরিত হয়েছেন তিনি।

মার্ক্সের জীবৎকালে কেবল ডাস ক্যাপিটাল-এর প্রথম খণ্ডই প্রকাশিত হয় ১৮৬৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। ১৮৮৩ সালে মার্ক্সের মৃত্যুর পর তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় বাকি দুই খণ্ড, দ্বিতীয় খণ্ড ১৮৮৫ সালে এবং তৃতীয় খণ্ড ১৮৯৪ সালে। তবে তিন খণ্ডের ডাস ক্যাপিটাল-এর শেষ খণ্ডের অনেক অংশকে আক্ষরিক অর্থেই অসম্পূর্ণ কিংবা কোনো একটি ধারণার অপরিণত লেখ্য রূপ বলে মনে করেন অনেকে। সবকিছুর পরও পুঁজি, পুঁজির চরিত্র ও বিকাশসংক্রান্ত আলোচনায় দেড় শ বছর ধরে অবিরাম উচ্চারিত হয়ে আসছে বইটির নাম। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক জয়তী ঘোষও বলেছেন একই কথা। দেড় শ বছরে বিরামহীনভাবে অসংখ্যবার এই বইয়ের মুদ্রণ হতে থাকা রীতিমতো বিস্ময়কর। ছোট হরফেও দুই হাজার পৃষ্ঠার তিন খণ্ডের বইটি এত দিন ধরে পড়া হয়ে আসছে। সাধারণ পাঠক না পড়লেও অর্থনীতির গবেষকদের জন্য এটি অবশ্যপাঠ্য। জয়তী ঘোষের মতে, এই বই অনেকবার অপ্রাসঙ্গিক বা অদরকারি বিবেচিত হওয়ার পরও আলোচনায় ফিরে এসেছে। কেননা, পুঁজি ও পুঁজির চরিত্র বোঝার জন্য এই গ্রন্থের বিকল্প নেই। উপরন্তু এখানে (এবং কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতেও) এমন অনেক অংশ আছে, যার মধ্যে বৈশ্বিক পুঁজিবাদের উত্থান ছাড়াও সামন্ত প্রথার বিলোপসম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন মার্ক্স। সেই হিসেবে বলা যায়, মার্ক্সই প্রথম তাত্ত্বিক, যিনি বিশ্বায়নসম্পর্কিত ধারণা দিয়েছেন। ‘বিশ্ববাজার’ ধারণাটিও তাঁর উদ্ভাবিত। বর্তমানে আলোচিত বিভিন্ন প্রকরণ বা প্রকরণের বীজ পাওয়া যাবে এই বইয়ে। যেমন ‘কমোডিটি ফেটিশিজম’ (পণ্যপূজা) বলতে যা বোঝায়, মানুষের সব কার্যক্রম ও লেনদেনকে মূল্যায়ন করা বা বিক্রয়যোগ্য করে তোলার মাধ্যমে যেভাবে কাজ করে পুঁজিবাদ, সেটিও দেখিয়েছেন মার্ক্স। আবার ‘এলিয়েনেশন’ বা বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বের কথাও এখানে প্রথম বলেছেন মার্ক্স। কাজেই পুঁজির চরিত্রের বিভিন্ন দিক আলোকপাত করার সময় বেশ কয়েকটি দিক বাদ থেকে গেলেও এই মহাগ্রন্থই মূলত পুঁজিকে বুঝতে সাহায্য করে।

২০১২ সালে সাধারণ পাঠকের বোধগম্য করে অর্থনীতির তত্ত্ব ছাপার উদ্যোগ নেয় জার্মানির সংবাদপত্র ও প্রকাশনা সংস্থা ফ্রাঙ্কফুটাল অ্যালজেইমেইন ৎসাইটুং, সংক্ষেপে যারা এফএজেড নামে পরিচিত। জার্মান লেখক ও সাংবাদিক বার্ন্ড জিসারমার, যিনি এই সিরিজে মার্ক্সকে নিয়ে লিখেছেন এবং নিজেকে দাবি করেছেন জার্মানির গুটিকয় মানুষের মধ্যে একজন হিসেবে, যাঁরা কিনা মার্ক্সের আসল কাজ দুবার পড়েছেন, সেই জিসারমারের মতে, ডাস ক্যাপিটাল-এর মূল আলাপ দুটি। এক. শ্রমিকেরা শোষিত হন, দুই. বিপ্লব ছাড়া পথ নেই। 

নিজের জীবদ্দশায় পুঁজিবাদের বিলুপ্তি দেখে যেতে চেয়েছিলেন মার্ক্স। বলেছিলেন, সমাজতন্ত্র, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবেই।

আফসোস, দুটির কোনোটিই হয়নি। কিন্তু কেন? প্রশ্নের জবাবে জিসারমার বলেছেন, মার্ক্স শ্রমকেই মূল্য উৎপাদনের একমাত্র উৎস হিসেবে দেখেছিলেন। সম্পদের অন্যান্য উৎস, যেমন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ইত্যাদিকে আমলে নেননি।

মজার ব্যাপার হলো জিসারমার নিজেই বলেছেন, সাধারণ পাঠককে তিনি ডাস ক্যাপিটাল পড়তে উৎসাহ দেন না। কেননা, তাঁর বিচারে এর প্রথম বেশ কয়েকটি অধ্যায় বেশ নীরস ও বিরক্তিকর। বরং মার্ক্সকে পড়তে চাইলে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো পড়া ভালো বলে মত দিয়েছেন এই মার্ক্স বিশেষজ্ঞ।

বিখ্যাত মনীষীদের কাজকর্ম নিয়ে প্রচলিত থাকে অনেক গল্প ও জনশ্রুতি। অনেক সময় দেখা যায়, সেসব গল্প ও জনশ্রুতির অনেক কিছুই ঠিক নয়, আদতে মিথ্যা। কিন্তু ডাস ক্যাপিটাল লেখার সময় কার্ল মার্ক্স যে গলা পর্যন্ত ঋণে ডুবে ছিলেন, এই তথ্যটি মিথ্যা নয়। এমনকি পাণ্ডুলিপি প্রকাশকের কাছে পাঠানোর জন্য ডাক খরচ দেওয়ার সামর্থ্য পর্যন্ত তখন ছিল না তাঁর। এঙ্গেলসকে লেখা চিঠিতে বারবার টাকা পাঠানোর জন্য তাগাদা দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, পাওনাদারেরা সব কড়া নাড়ছে, টাকা না পাঠালে তাঁকে জেলে যেতে হতে পারে।

না, জেলে যেতে হয়নি মার্ক্সকে। মূলত ডাস ক্যাপিটাল-এর কারণে দেড় শ বছরের বেশি সময় ধরে দার্শনিক ও সমাজতাত্ত্বিক হিসেবে মানুষের মনের মণিকোঠায় স্থান নিয়েছেন তিনি। ফলে ভালো অর্থনীতিবিদ হওয়ার জন্য যেমন নন্দিত ডাস ক্যাপিটাল পড়ার প্রয়োজন রয়েছে, একইভাবে বইপ্রেমী হিসেবে আপনি যদি বিখ্যাত ও আলোচিত এই গ্রন্থটি পাঠ না করেন, তবে বিশ্বের প্রভাবশালী একটি বইয়ের পাঠ থেকে আপনি বঞ্চিতই হবেন।

সূত্র: সোশ্যাল হিস্ট্রি পোর্টাল ওআরজি ও আলজাজিরাডটকম