জরায়ু

এৎগার কেরেত
এৎগার কেরেত

আমার পঞ্চম জন্মদিনে মায়ের ক্যানসার ধরা পড়ল। ডাক্তাররা বলল, জরায়ু কেটে ফেলে দিতে হবে। দিনটা বাজে ছিল। আমরা সবাই বাবার সুবারু গাড়িতে চড়ে হাসপাতালে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। একসময় ডাক্তার অপারেশন রুম থেকে বেরিয়ে এল, তার চোখে পানি, মুখ থেকে সার্জিক্যাল মাস্ক খুলতে খুলতে বলল, ‘জীবনে কখনো এত সুন্দর জরায়ু দেখি নাই। মনে হচ্ছে আমি একটা খুনি।’

মায়ের জরায়ুটা আসলেই খুব সুন্দর ছিল। এত সুন্দর যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওটা জাদুঘরে দান করেছিল। তারপর শনিবারে আমরা ঘটা করে জাদুঘরে গিয়েছিলাম, মায়ের জরায়ুর পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের ছবি তুলেছিল আমার মামা। বাবা তখন আর দেশেই ছিল না, মায়ের অপারেশনের পরদিনই ডিভোর্স দিয়েছিল।

আলাস্কা যাওয়ার প্লেনে ওঠার আগে বাবা আমাকে আর আমার বড় ভাইকে বলেছিল, ‘যে মেয়েমানুষের জরায়ু নাই, সে কোনো মেয়েমানুষই না। আর যে পুরুষলোক এমন মেয়েমানুষের সাথে থাকে যে মেয়েমানুষই না, সেই পুরুষলোক নিজেও কোনো পুরুষ না। তোমরা বড় হলে বুঝবা।’

জাদুঘরের যে ঘরটাতে মায়ের জরায়ু ডিসপ্লের জন্য রাখা হয়েছিল, সেটা পুরাই অন্ধকার। একমাত্র আলো যেটা ছিল, সেটা আসছিল জরায়ুটা থেকেই। খুব কোমল আলোর আভা, রাতের ফ্লাইটে প্লেনের ভেতরটা যে রকম হয়। ছবিতে অবশ্য ওটাকে বিশেষ কিছু মনে হচ্ছিল না, ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আলোর কারণে। কিন্তু আমি যখন খুব কাছে গিয়ে ভালো করে দেখলাম, তখন বুঝতে পারলাম কেন ওটা ডাক্তারের চোখে পানি এনে দিয়েছিল।

‘তোমরা ওইখান থেকে বেরিয়ে এসেছ’, মামা জরায়ুটা দেখিয়ে বলল, ‘ওখানে তোমরা ছিলে রাজপুত্রদের মতো। কী মা-ই না তোমরা পেয়েছ! কী দারুণ একটা মা!’

শেষে মা মারা গেল। শেষমেশ সব মা-ই মারা যায়। বাবা হয়ে উঠল বিখ্যাত মেরু-পরিব্রাজক ও তিমিশিকারি।

আমি যে মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করতাম, চোরা চোখে তাদের জরায়ুর দিকে তাকাতাম। তারা আমাকে ভুল বুঝত। ভাবত, আমি হয়তো মেয়েলি কোনো অসুখের ভয় পাচ্ছি। ফলে ওদের উত্তেজনা নিভে যেত। কিন্তু ওদেরই একজন আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলো; খুব ভালো একটা মেয়ে। আমাদের বাচ্চাদের পাছায় আমি খুব থাবড়াতাম, একদম গেদা বাচ্চা অবস্থায়। কারণ ওদের কান্না একদমই সহ্য হতো না। আর সত্যিই ওরা খুব জলদি শিক্ষা পেয়ে যেত; বয়স নয় মাস হতেই, কিংবা তারও আগেই কান্নাকাটি ছেড়ে দিত। ওদের জন্মদিনে দাদির জরায়ু দেখানোর জন্য আমি ওদের জাদুঘরে নিয়ে যেতাম। কিন্তু ওরা ব্যাপারটা বুঝত না, আমার বউও বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে আসত। তাই আর জাদুঘরে না গিয়ে আমি ওদের ওয়াল্ট ডিজনির ছবি দেখাতে নিয়ে যাওয়া শুরু করলাম।

একদিন পুলিশ আমার গাড়িটা জব্দ করে নিয়ে গেল। জাদুঘরটা যে মহল্লায়, পুলিশের জব্দ করা গাড়িগুলো রাখার জায়গাও সেখানে। তাই গাড়িটা নিতে গিয়ে আমি জাদুঘরে ঢুকলাম। জরায়ুটা যেখানে রাখা ছিল, সেখানে দেখতে পেলাম না। ওটা পাশের একটা ঘরে সরিয়ে ফেলা হয়েছে, সে ঘরে রাজ্যের সব পুরোনো ছবি। জরায়ুটার কাছে গিয়ে ভালো করে দেখতে লাগলাম: ছোট্ট ছোট্ট সবুজ বিন্দুতে ভরে গেছে। গার্ডকে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন ওটা পরিষ্কার করা হয় না। লোকটা ভ্রুক্ষেপই করল না। যে লোকটা ওই প্রদর্শনীর দায়িত্বে ছিল, তাকে অনুরোধ করে বললাম, তাদের লোকবলের অভাব থাকলে আমাকেই যেন জরায়ুটা পরিষ্কার করতে দেওয়া হয়। কিন্তু লোকটা জঘন্য। বলল, ওটা স্পর্শ করার অনুমতি আমার নেই, কারণ, আমি জাদুঘরের কর্মীদের কেউ নই। আমার বউ বলল, জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কথা এক শ ভাগ ঠিক। আর সে মনে করে, জনসমক্ষে একটা জরায়ু প্রদর্শন করা জঘন্য ব্যাপার, বিশেষ করে যে জায়গা প্রচুর শিশু-কিশোরে ভরা থাকে।

কিন্তু আমি জাদুঘর কর্তৃপক্ষের নিয়মটা মানতে পারছিলাম না। অন্য কিছুই আর আমার পক্ষে ভাবা সম্ভব হচ্ছিল না। আমি খুব গভীরভাবে অনুভব করছিলাম, জাদুঘর থেকে ওটা চুরি করে নিজের কাছে নিয়ে আসতে না পারলে আমি আর আমি থাকব না। সেই রাতে আমার বাবা প্লেনের সিঁড়িতে পা রেখে যেমন বুঝেছিল, ঠিক সেইভাবে আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমাকে কী করতে হবে। 

দুদিন পর আমি আমার অফিসের একটা ভ্যান নিয়ে জাদুঘরে গেলাম, সেদিনের মতো জাদুঘর বন্ধ হওয়ার ঠিক আগে আগে। ঘরগুলো ততক্ষণে ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু তবু যদি কারও মুখোমুখি পড়ে যেতাম, তাতে আমার চিন্তিত হওয়ার কিছু ছিল না। এবার আমার সঙ্গে অস্ত্র ছিল; তা ছাড়া মাথায় ছিল খুব ভালো একটা প্ল্যান।

কিন্তু সমস্যা হলো, খোদ জরায়ুটাই গায়েব। প্রদর্শনীর দায়িত্বে থাকা সেই লোকটা আমাকে দেখতে পেয়ে একটু অবাক হলো। কিন্তু আমি যখন ঝট করে আমার নতুন জেরিকো পিস্তলের বাটটা ওর গলার ভিতরে ঢুকিয়ে দিলাম, ও তক্ষুনি কাশতে কাশতে বলে দিল কী ঘটনা। এক দিন আগে এক ইহুদি সমাজসেবকের কাছে জরায়ুটা বিক্রি করা হয়েছে। তাকে শর্ত বেঁধে দেওয়া হয়েছে, সেটা সে পাঠাবে আলাস্কার এক কমিউনিটি সেন্টারে।

আলাস্কা যাওয়ার পথে ইকোলজিক্যাল ফ্রন্টের লোকাল চ্যাপ্টারের কিছু লোকের দ্বারা জরায়ুটা ছিনতাই হয়ে যায়। তারপর ইকোলজিক্যাল ফ্রন্ট একটা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। তারা বলে, কোনো জরায়ু বন্দিদশায় থাকার জিনিস নয়, তাই তারা সেটাকে প্রাকৃতিক পরিবেশে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

রয়টারের ভাষ্য হলো, এই ইকোলজিক্যাল ফ্রন্ট উগ্রপন্থী আর বিপজ্জনক। এর সমস্ত তৎপরতা পরিচালিত হয় জলদস্যুদের একটা জাহাজ থেকে, সেটার সরদার একসময় তিমিশিকারি ছিল। 

আমি জাদুঘরের লোকটাকে ধন্যবাদ দিয়ে পিস্তল সরিয়ে নিলাম।

বাসায় ফেরার পথে সব কটি বাতি জ্বলছিল লাল হয়ে। আমি শুধু এক লেইন থেকে আরেক লেইন করছিলাম, মিররের দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই ছিল না; শুধু চেষ্টা করছিলাম গলার মধ্যে আটকে থাকা দলাটা থেকে মুক্তি পেতে। কল্পনায় দেখার চেষ্টা করছিলাম, শিশিরঢাকা সবুজ এক মাঠের মাঝখানে আমার মায়ের জরায়ু, মাঠটা ভাসছে ডলফিন আর টুনায় ভরা সাগরে।

>৬ সেপ্টেম্বরের ‘অন্য আলো’তে ‘যে গল্পকার সৈন্যদের আদেশ মানে না’ শিরোনামে ফিলিস্তিনি কথাসাহিত্যিক জিয়াদ খাদাশের একটি গল্প ছাপা হয়। ওই গল্পে জিয়াদ খাদাশ তাঁর পছন্দের লেখক হিসেবে একাধিকবার ইসরায়েলি কথাশিল্পী এৎগার কেরেতের কথা উল্লেখ করেন। তাই প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এবার এৎগার কেরেতের ছোটগল্পটি ছাপা হলো। পোলিশ বংশোদ্ভূত মা-বাবার সন্তান এৎগার কেরেতের আদি বাড়ি পোল্যান্ডে। তাঁর মা-বাবা হলোকাস্ট থেকে বেঁচে যাওয়া পোলিশ ইহুদি, একসময় ইসরায়েলের রাজধানী তেলআবিবের রামাত গান শহরে থিতু হন। সেখানেই ১৯৬৭ সালে কেরেতের জন্ম। লেখক হিসেবে তাঁর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৯২ সালে, প্রথম ছোটগল্প সংকলন ‘পাইপলাইন’-এর মাধ্যমে। এরপর ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ৫০টি অণুগল্পের বই মিসিং কিসিঞ্জার। ইসরায়েল ও পোল্যান্ডের দ্বৈত নাগরিক কেরেত হিব্রু ভাষাতেই লেখেন। শিশুদের জন্যও তাঁর বেশ কয়েকটি বই রয়েছে। তেলআবিব বিশ্ববিদ্যালয়সহ দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর পাশাপাশি তিনি টেলিভিশন অভিনেতা ও স্ক্রিপ্ট লেখক হিসেবেও জনপ্রিয়।

অনুবাদ: মশিউল আলম

● হিব্রু ভাষায় লেখা গল্পটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন মিরিয়াম শ্লেসিঙ্গার। সেই ইংরেজি ভাষ্যের অনুসরণে করা হয়েছে এই বঙ্গানুবাদ।