কথা বলার ছবি

দৃষ্টি দূরে কোথাও, মাথায় ব্যারেট টুপি পরে চিন্তামগ্ন অবস্থায় চে গুয়েভারা। ছবি: সংগৃহীত
দৃষ্টি দূরে কোথাও, মাথায় ব্যারেট টুপি পরে চিন্তামগ্ন অবস্থায় চে গুয়েভারা। ছবি: সংগৃহীত

কিছু কিছু ছবি খুব সহজেই অনেক কথা বলে দেয়। সেই সব কথার সবই যে আনন্দ–অনুভূতির বার্তা তুলে ধরা ঘটনার বর্ণনা, তা তো নয়। মাথায় ব্যারেট টুপি শোভা পাওয়া লাতিন আমেরিকার বিপ্লবী নায়ক চে গুয়েভারার একটি ছবি আমাদের অনেকের কাছেই খুবই পরিচিত—দূরে কোথাও দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে চিন্তামগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। সেই ছবিতে চের চোখে যে দ্যুতি দেখতে পাই, তা যেন আমাদের বলে আগামীর সম্ভাবনা নিয়ে একই সঙ্গে কতটা আশাবাদী এবং উদ্বিগ্ন তিনি। এই ছবি তোলা হয়েছিল বিপ্লব-পরবর্তী কিউবায় যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট প্রতিবিপ্লবীদের অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চলতে থাকার সময়।

অন্যদিকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় হাত বাঁধা অবস্থায় ধরে নিয়ে আসা ভিয়েতকং গেরিলা যোদ্ধার মাথা তাক করে দাম্ভিক এক সমরনায়কের পিস্তলের গুলি ছোড়ার আগমুহূর্তের ছবিতে বন্দীর যে মুখাবয়ব আমরা দেখি, ভয়ের চিহ্ন সেখানে তেমন একটা নেই। বরং চোখ বন্ধ করে রাখা তাঁর সেই অনেকটা শান্ত অনুভূতি আমাদের বলে দেয় অসহায় যোদ্ধার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার পূর্বমুহূর্তের ভাবনার কথা। যেন তিনি বলছেন, এটাই শেষ নয়, জয় আমাদের হবেই।

প্যাট্রিস লুমুম্বার অসহায় চোখ। তবে লুমুম্বা কি আসলে অসহায়? ছবি: সংগৃহীত
প্যাট্রিস লুমুম্বার অসহায় চোখ। তবে লুমুম্বা কি আসলে অসহায়? ছবি: সংগৃহীত

পাশাপাশি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের দলিলে মাত্র স্বাক্ষর করে উঠে দাঁড়ানো পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজির সেই ছবির কথা ভাবুন। জেনারেলের চোখে কোনো স্ফুলিঙ্গ নেই। নেই সেই দাম্ভিকতা। বরং যা আছে, তা হলো অপমানিত হওয়ার জ্বালা। কিন্তু সেটি যে নিজের কর্মফলের মাশুল, তা নিয়ে তিনি মনে হয় তেমন উদ্বিগ্ন নন, যতটা উদ্বিগ্ন অপমানিত হওয়ার জ্বালা নিয়ে।

আবার সেই একই দিনে উৎসবমুখর বাংলাদেশিদের ছবির কথা মনে করুন এবার। কী আছে সেখানে? সেখানে আছে অনাবিল আনন্দের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া মানুষের মনের নির্মল অনুভূতির প্রকাশ। এসব ছবি—সাদাকালো কিংবা রঙিন—যা–ই হোক না কেন—আমাদের সামনে তুলে ধরে জলজ্যান্ত ইতিহাস। এমনকি ঝাপসা হয়ে যাওয়ার পরও কিছু কিছু ছবি আছে, যা সত্যকে আড়াল করে রাখতে একেবারেই অক্ষম। আর ওই আড়াল করার চেষ্টা যাঁরা করে যান, ছবি যেন তাঁদের দিকেই ছুঁড়ে দেয় নিজের অভিশাপ।

ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ির সিঁড়িতে শায়িত রক্তাক্ত বঙ্গবন্ধুর ছবি তো ঠিক সেই রকমই একটি আলোকচিত্র। এর ফোকাল পয়েন্ট কিছুটা আউট অব ফোকাস হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও অভিশাপ কিন্তু সে দিয়ে যাচ্ছে সেই সব নরপশুদের, আমাদের চারপাশে যাদের অবাধ বিচরণ।

কিছুদিন আগে বিলেতের গার্ডিয়ান পত্রিকায় সাদা-কালো একটি ছবিতে চোখ পড়তেই দৃষ্টি আটকে গেল সেখানে। মনের পর্দায় ভেসে উঠল বঞ্চনা আর বিশ্বাসঘাতকতায় পূর্ণ মানব ইতিহাসের সাম্প্রতিক আরও একটি করুণ অধ্যায়। কঙ্গোর মুক্তি আন্দোলনের নেতা ছিলেন প্যাট্রিস লুমুম্বা। দেশটিকে ঔপনিবেশিক শাসনের কব্জা থেকে মুক্ত করতে দীর্ঘ সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত সফলও হয়েছিলেন।

কঙ্গোর স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর লুমুম্বা স্বপ্ন দেখেছিলেন বঞ্চনা আর প্রতারণার হাত থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করার। কিন্তু অল্প দিনেই তিনি বুঝতে পারলেন, ঔপনিবেশিক শাসক শ্রেণি রাজনৈতিক স্বাধীনতা কঙ্গোবাসীদের হাতে তুলে দিলেও অন্যভাবে নানা উছিলায় তাদের পদানত রাখতে বদ্ধ পরিকর। এর পেছনের কারণ হলো দেশটির সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদ। ফলে ওই সম্পদের ওপর নিজেদের দখলি–কব্জা যেন ফসকে না যায়, তা নিশ্চিত করতে পাতা হয় ষড়যন্ত্রের জাল। এবং ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে সঙ্গী হিসেবে তারা পেয়ে গেল সমাজের বিশ্বাসঘাতক একটি শ্রেণিকে।

ভিয়েতকং গেরিলা যোদ্ধার মাথা তাক করে দাম্ভিক এক সমরনায়কের পিস্তলের গুলি ছোড়ার আগমুহূর্তের ছবি। ছবি: সংগৃহীত
ভিয়েতকং গেরিলা যোদ্ধার মাথা তাক করে দাম্ভিক এক সমরনায়কের পিস্তলের গুলি ছোড়ার আগমুহূর্তের ছবি। ছবি: সংগৃহীত

ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী কঙ্গোর দায়িত্ব সে দেশের মানুষের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হওয়ার পর থেকে বিদেশি ওই শাসকগোষ্ঠীর একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে থেকে গিয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসকদের নিজ হাতে গড়ে তোলা আগের সেই একই সামরিক বাহিনী। লুমুম্বার নতুন স্বাধীন সরকারের প্রতি বাইরে থেকে আনুগত্য প্রকাশ করলেও শেষ অব্দি তারাই কিন্তু নতুন নেতৃত্বের পেছনে ছুরিকাঘাত করে দেশটিকে করে দিয়েছিল নেতৃত্বশূন্য। ফলে তখন থেকেই দেশটির পেছনের পথে যাত্রার শুরু, সেই গোলকধাঁধা থেকে আজও বের হয়ে আসতে পারেনি গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো। মোশে শোম্বের দেখিয়ে দেওয়া পথে প্রভুকে বিতাড়িত করে ক্ষমতায় বসেছিলেন মোবুতু সেসে-সুকে।
কিন্তু তাঁকেও একসময় যেতে হয়েছে গৃহযুদ্ধে পরাজিত হয়ে পলায়নের মধ্য দিয়ে।

যা হোক, ছবিতে মাত্র যৌবন পার হয়ে মধ্যবয়সে পৌঁছানো যে ব্যক্তিকে আপনারা দেখছেন অসহায় চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকতে, তিনি হলেন প্যাট্রিস লুমুম্বা, দেশকে বিদেশি প্রতারকদের হাত থেকে মুক্ত করার স্বপ্নে যিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তির যুদ্ধে। সেই যুদ্ধে তাঁর বিজয়ও এসেছিল। কিন্তু আগেই বলেছি, দেশের একশ্রেণির মানুষের বিশ্বাসঘাতকতায় সেই জয় তিনি ধরে রাখতে পারেননি। আর ছবিতে যে সিপাহি হাত বাঁধা, এই বীরের চুল নিজের মুঠোর ভেতরে ধরে নিয়ে মুখটা জোর করে ক্যামেরার দিকে ফিরিয়ে রাখার মতো ঘৃণিত কাজে ব্যস্ত, সে-ও কঙ্গোরই মানুষ, যে অন্যের কথায় অসহায়ভাবে পরিচালিত হয় এবং যার হৃদয়ে ভালোবাসার কোনো আলোড়ন নেই। এ ছবিতে সেই সিপাহির চেহারাটি আমরা দেখতে পারি না। অবশ্য দেখার যে খুব প্রযোজন আছে, তা-ও নয়।

ছবিতে আমরা কেবল প্যাট্রিস লুমুম্বাকে দেখি; যে লুমুম্বা আমাদের চোখের সামনে, তাঁকে আমাদের মোটেই অসহায় মনে হচ্ছে না। কিন্তু আমাদের মনে করুণার ভাব জেগে ওঠে ওই সিপাহির জন্য, আসলেই যারা অসহায়, তাদের জন্য। কেননা, আমরা সহজেই ধরে নিতে পারি ঈশ্বর এদের মানুষের চেহারা দিয়ে জগৎ–সংসারে পাঠালেও মানুষের হৃদয় দেননি। আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের অর্ধশতকের ইতিহাস হাতড়ালে আমরাও কিন্তু চেহারায় মানুষ হওয়া সত্ত্বেও বুকে পশুর হৃদয় ধারণ করা এ রকম অনেকের দেখা পেয়ে যেতে পারি সহজেই। আমি নিশ্চিত, পাঠক চাইলে অনায়াসে নিজের মনের আয়নায় এদের চেহারা দেখে নিতে সক্ষম হবেন।