নুন-পূর্ণিমা
>এই কাহিনিকাব্য লেখা হয়েছিল অনেক আগে, ২০০২-২০০৩ সালে। ছাপা হলো অপ্রকাশিত সেই কাহিনিকাব্যের সূচনাপর্ব।
মেয়েদের স্তনে আছে পূর্ণিমার দুধ আর সাগরের নুন,
চিকন লিকলিকে একটা সাপ যেমন ছিদ্রপথ গলিয়ে
টুক করে খসে পড়ে ঘরের মেঝেয়,
ওই পঙ্ক্তিটি হঠাৎ
হাসান চৌধুরীর করোটিতে হিলহিল করে ওঠে।
গভীর রাতের রাজপথ, জনমানুষ বলতে পথে একমাত্র,
রাতের এমন একটি নিশীথ আসে যখন মানুষের চেয়ে
আলোর ভিড় শতগুণ অধিক বলে মনে হয় রাজপথে;
হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল সে,
কবি ও সাংবাদিক বলেই তার মাথার ভেতরে
কাল ভোরের সংবাদপত্রের হেডলাইনগুলো—
সন্ত্রাস, ধর্ষণ, খুন, গ্রেফতার—
হঠাৎ সব প্লাবিত করে বহে গেল অবিশ্বাস্য নুন আর দুধ।
এই হাসানকে আমরা এক্ষুনি দেখতে পাব
বিজন খাঁ খাঁ ঘরে একা দাঁড়িয়ে,
অপেক্ষায়—
এই বুঝি ফিরে আসবে মায়মুনা। প্রতিরাতে এমন সে দাঁড়ায়।
ফেরে না মায়মুনা।
ফিরবে কি?
অপেক্ষা তবু।
অচিরেই তাকে দেখব তার বালক পুত্রের কাছে দাঁড়াতে।
তার চুলে সে রাখবে হাত।
ঠান্ডা ভাত রেখে গেছে বুয়া।
কোনো কোনো রাতে সেই ঠান্ডা ভাত চটকাতে চটকাতে
তার মনে হয় জীবনই এমত, একদা রন্ধিত,
এখন কড়কড়ে হিম, দলা দলা,
ছেনে ছেনে গ্রাসযোগ্য করে তোলা।
থেকে থেকে, বুকের ভেতরে ডাক—মায়মুনা! মায়মুনা!
শব্দ করে ডেকে উঠেছে কি? পাশ ফেরে মোহিত,
ঘুমের ভেতর থেকে মজ্জমান মানুষের মতো মাথা তোলে,
অস্পষ্ট জড়িত স্বরে সাড়া দেয়, বাবা।
খেয়েছিস? সাড়া নেই।
মা ফোন করেছিল?
ঘুমের ভেতরে আরও ডুবে যায় বালক মোহিত।
হাসান টেবিলে বসে, দ্রুত হাতে লিখে রাখে পঙ্ক্তিটি—
হারিয়ে যাবার আগেই,
মেয়েদের স্তনে আছে পূর্ণিমার দুধ আর সাগরের নুন।
তারপর স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে কতকাল, দিন পরে দিন,
অক্ষর আসে না আর, শব্দ নেচে ওঠে না আঙুলে,
অভিধান বসে পড়ে যায়, দুধের নহর বহে, নুন উঠে আসে জিহ্বায়।
হাহাকার করে ওঠে কবিতার খাতা।
মায়মুনার মতো কবিতাও ত্যাগ করে চলে গেল তাকে?
ওই একটি পঙ্ক্তির দিকে দিন পরে দিন আর রাত পরে রাত
বিস্ফারিত চোখ মেলে বসে থাকে হাসান চৌধুরী।
আমরা আবার তার দেখা পাব হরিষাল গ্রামে।
না জমিতে না পানিতে,
না সৌরমণ্ডলে না কৃষ্ণগহ্বরে,
না পাথরে না পলিতে,
না গোলাপে না কণ্টিকারিতে,
না পোশাকে না নগ্নতায়,
না গার্হস্থ্যে না লাম্পট্যে,
না আলোয় না অন্ধকারে,
না পাপে না পুণ্যে!
আমরা এসব যুগলের প্রতিটির মধ্যভাগে আছি
এক ধূসর দেশে বস্তুত
এবং আমাদের প্রামাণ্য জীবনকাহিনি বলতে এটাই।
রচনা করা যাবে না প্রশংসাগাথা,
কিংবা বর্ষণও করা যাবে না অভিশাপ—।
গত বছরের সংবাদপত্রে যেমন—
পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় পাশাপাশি
নববর্ষে মানুষের উৎফুল্ল মিছিলের রঙিন ছবি
আর বটতলায় বোমা বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন লাশ
সেটিও রঙিন।
যেন দুটোই উৎসব,
যেন দুটো নিয়েই উৎসব;
যেন উৎসব একটিই, তার আবশ্যিক অঙ্গ ওই দুটি।
এখন এই। এই আমাদের বাস্তবতা। এই আমাদের বিন্যাস।
কেউ যদি আমাদের কথা লিখতেই চায়,
সে যেন অবশ্যই অবহিত সতর্ক থাকে এই বিষয়ে।
এই অবধান ও সতর্কতা এ কাহিনির বর্ণনায়
ধারণ করে রাখতে হবে সারাক্ষণ—
লিখতে বসে বানান ও ব্যাকরণকে যেমন আমরা রাখি
ওপরস্তরে একেবারেই সচেতন না থেকে,
চোখ ফেলে রাখতে হবে পাথারে যেমন প্রাচীন বটের দিকে
পথের নির্দেশক রূপে অমাবস্যায় তো বটেই
ভরা জোছনায়, এমনকি খর দুপুরেও।
অন্ধকারেই কেবল পা ভুল পথে যায় কি? আমাদের
অধিকাংশ পতন ও স্খলন ঘটে আলোকিত মঞ্চেই।
আমরা এখন এসে যাই হরিষাল গ্রামে;
গ্রামটিতে আমরা প্রবেশ করি সতর্ক পায়ে।
না জমিতে না পানিতে, না সৌরমণ্ডলে না কৃষ্ণগহ্বরে।
প্রীতি, প্রমোদ, সুখ, আহ্লাদ, আনন্দ
যখন পূরিত করা যায় এক শব্দে
সে হয় হর্ষ।
আর এই হর্ষ থেকেই হর্ষিত বা প্রাচীন পদ্যে যেমন—হরষিত;
আর এই হরষিত-ই আঞ্চলিক রূপে বুঝি হরিষাল।
বাস্তব ও বাস্তবের বর্ণনা থাকে পরস্পর মুখ ফিরিয়ে
জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই।
ইতিহাসের মূল খেলাটিই হবে বাস্তব ও বর্ণনার বৈপরীত্যে—
এবং তেমনটিই দেখি হরিষালে।
হরষিত বা হর্ষিত সে নয় মোটেই—
এক বিষাদিত খর্বতা তার চারিত্র্য ও ধূসরতা তার অঙ্কনের রং।
তামাটে প্রান্তর মিশেছে ইস্পাতের মতো ধারালো আকাশে।