'শরণার্থীশিবিরে ঘুরে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল'

>বিট আন্দোলনের পুরোধা অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা ছিল আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনের। অপ্রকাশিত এই আলাপচারিতায় ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’-এর কবি বলেছেন কবিতাটি লেখার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে। জানিয়েছেন তাঁর ভারত ও কলকাতা ভ্রমণের বৃত্তান্ত। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নাসির আলী মামুন।
অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে কথোপকথনের একপর্যায়ে নিজেদের এ ছবি তুলেছিলেন নাসির আলী মামুন, সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের বয়লান হল, ১৯৯৩
অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে কথোপকথনের একপর্যায়ে নিজেদের এ ছবি তুলেছিলেন নাসির আলী মামুন, সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের বয়লান হল, ১৯৯৩

নাসির আলী মামুন: ভারতের সঙ্গে আপনার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে, যা আপনার ব্যক্তিজীবনেও প্রভাব ফেলেছে। ১৯৭১ সালে আপনি ভারত গেলেন কেন? 

অ্যালেন গিন্সবার্গ: আমরা একদল আমেরিকান কবি ও লেখক ভারতে গিয়েছিলাম। আমাদের আগে কেউ যায়নি। আমেরিকার বাইরের পৃথিবীটা কী রকম, এই চিন্তা থেকে ষাটের দশকে আমরা ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম। 

যে অভিজ্ঞতাগুলো একজন মানুষের জীবনকে পাল্টে দিতে পারে, নির্ভেজাল পরিবর্তন করে দেয়, আমার ভারতে ভ্রমণ ছিল তেমনই। মাত্র ৩৭ বছর বয়সে আমি ভারতে যাই। তখন আমি ভবঘুরে, কবি। থাকি নিউইয়র্কের পশ্চিম অঞ্চলে, যেখানে নেশাখোর, মাতালদের আড্ডাখানা। এলাকাটি আমার জন্য নিরাপদ হলেও বাইরে থেকে বসবাস করার জন্য যারা আসত, অবস্থা দেখে দু-তিন মাস থেকে বিদায় নিত তারা। কিন্তু তরুণেরা খুব পছন্দ করত লোয়ার ইস্ট সাইড। আমরা ছিলাম এর প্রহরী। 

জ্যাক কেরুয়াক, লরেন্স ফার্লিংঘেট্টি, উইলিয়াম বারোজসহ অনেকেই আমরা সংগঠিত হই সে সময়ে। আমরা বেপরোয়া উচ্ছৃঙ্খল মাদকসেবী—সব অপবাদ ঘাড়ে নিয়ে বিট আন্দেলন শুরু করি। আমরা মন্দ লোক। প্রশাসন আমাদের নানা কৌশলে আটকাতে চেষ্টা করছে। সমাজ আমাদের বিপক্ষে। কিন্তু তরুণদের বিশাল অংশ আমাদের পক্ষে। তারা আমাদের লেখা পড়তে চায়। তো তরুণ বয়সেই আমাদের মনে হলো, যুদ্ধ করে আমেরিকার রাজনীতিবিদদের লাভ হতে পারে। তখন আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে আমরা মানসিকভাবে সংগঠিত হচ্ছিলাম। মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নির্দিষ্ট একটি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াতে চেষ্টা করছিলাম। কোরিয়ার যুদ্ধ, ভিয়েতনামের যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমরা ছিলাম সোচ্চার। নেতৃত্ব দিয়েছি আমরা ভিয়েতনামের যুদ্ধের বিপক্ষে। তবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে ওই দেশের শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা স্বচক্ষে দেখতে আমি কলকাতা গিয়েছিলাম। 

মামুন: কলকাতায় গিয়ে কী দেখলেন? 

গিন্সবার্গ: সম্পূর্ণ এক নতুন সাম্রাজ্য। আমাদের সমাজ থেকে একদম ভিন্ন এক ব্যবস্থা, যারা যুদ্ধবিরোধী, শান্তিপ্রিয় কিন্তু হইচই পছন্দ করে, বস্তুবাদী বিশ্বে তারা সনাতন ধর্মকে আঁকড়ে ধরে আছে। কুসংস্কার আর ধর্মের মিশ্রণে এমন এক নিয়মে মানুষগুলো বেঁচে আছে—এসব আমার জন্য ছিল বিস্ময়কর। 

১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি আমি ও আমার বন্ধু পিটার অরলভ্স্কি যখন বোম্বে (এখন মুম্বাই) এয়ারপোর্টে নামি, আমার পকেটে মাত্র এক মার্কিন ডলার। ভাবতে পারো, কী ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণ ছিল! লেখক ও সাংবাদিক খুশবন্ত সিংয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম আমরা। অনেক কথা হলো। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, কোনো ভালো তরুণ কবিকে তিনি চেনেন কি না। পিটার ছিল আমার সঙ্গে, খুশবন্তকে সে বলল, নেশাখোরদের সঙ্গে তিনি কি পরিচয় করিয়ে দিতে পারবেন? মুহূর্তেই তাঁর হাসিমুখটা চুপসে গেল। 

মামুন: কী বলেছিলেন তিনি? 

গিন্সবার্গ: মি. সিং বলেছিলেন, এ বিষয়ে তিনি অন্ধ। কাউকে চেনেন না! হা হা হা। 

মামুন: কলকাতা গেলেন কবে? 

গিন্সবার্গ: সেখান থেকে তৃতীয় শ্রেণির টিকিট কেটে গেলাম দিল্লি। আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন গ্যারি স্লাইডার ও তাঁর নব্য স্ত্রী। ওখানে মন্দির, মসজিদ ও দর্শনীয় জায়গাগুলো ঘুরে দেখলাম। 

দিল্লি থেকে বেনারস গিয়ে নদীর ঘাটের কাছে একটা সরু গলিতে দোতলায় বাড়ি ভাড়া নিই। সেখানে কয়েক সপ্তাহ পর সিআইডির লোকেরা আমাদের সন্দেহ করে এবং ঘরে ঢুকে অনুমতি ছাড়া তল্লাশি করতে চায়। ঘরে দেশি মদের বোতল, গাঁজা এবং আরও কিছু মাদকদ্রব্য দেখে সন্দেহ আরও গাঢ় হয় তাদের। পুলিশ আসে এবং আমাদের স্পাই মনে করে। তখন চীন-ভারত উত্তপ্ত পরিস্থিতি চলছে। এর আগে কয়েক সপ্তাহ আমি কলকাতায় কাটিয়েছিলাম। সেখানে সাধুসন্তদের সঙ্গে রাত কাটিয়েছি। ঘুরে বেড়িয়েছি সারা রাত। আমাদের দেখে সবাই মনে করত, আমরাও বিদেশি সাধু। নিমতলা শ্মশানঘাটে প্রায়ই যাওয়া হতো। একদিন এক সন্ন্যাসীর কাছে বললাম, আমি একজন ‘গুরু’ চাই। তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নিতে চাই। সাধুজি তাঁর বুকে হাত রেখে আমাকে বললেন, তোমার মধ্যেই গুরু বাস করে। তোমার আত্মাই তোমার গুরু। চমকে গেলাম, নতুন পথের সন্ধান পেলাম। কিন্তু ১৯৭১ সালে কলকাতায় এসে দেখলাম ভিন্ন বাস্তবতা।

মামুন: ১৯৭১-এর কলকাতা কেমন ছিল? 

গিন্সবার্গ: যুদ্ধ। পাকিস্তানের সঙ্গে কলকাতায় টালমাটাল অবস্থা। ওই উত্তাল সময়ে প্রায় ৯ বছর আগের হোটেলটিকে খুঁজে বের করলাম মির্জা গালিব স্ট্রিট থেকে, যেখানে পিটার ও আমি ১৯৬২ সালে বসবাস করেছিলাম। দিনে মশা আর রাতে ছারপোকা আমাদের সঙ্গী ছিল। সে সময় নিউমার্কেট এলাকার ‘আমজাদিয়া’ হোটেলে পিটার কোত্থেকে নেশাখোরদের নিয়ে হাজির হতো। এতে হোটেল ম্যানেজার বিরক্ত হলো। আমি তাকে সতর্ক করলাম। কিন্তু অবস্থাটা এমন হয়েছিল যে পিটার ও আমি সপ্তাহ বা অধিক সময় কারও সঙ্গে যোগাযোগ না করলেও একদল তরুণ পুরিয়া নিয়ে হোটেলের রুমে হাজির হয়ে যেত। এ সময় বেনারস থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মি. নেহরুকে আমি চিঠি লিখেছিলাম এবং তাঁর সঙ্গে চা পান করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম! কিন্তু আমরা কোনো উত্তর পাইনি। 

১৯৭১ সালে আমি নিউইয়র্কে খণ্ডকালীন অধ্যাপনা করি। কলকাতায় এসে দেখি, বহু মানুষ আমাকে চেনে। পেঙ্গুইন প্রকাশনার আমাদের কবিতার বই এখানে পাওয়া যায়। কিছু বন্ধুবান্ধবও পাওয়া গেল। তখন পাকিস্তান বাংলাদেশে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। কলকাতার বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের শরণার্থী। আমি আমেরিকান কবি, আমার দেশের প্রশাসন পাকিস্তানের পক্ষে। কিন্তু আমি প্রতিমুহূর্তে সে দেশের নাগরিক হিসেবে নিজেকে দোষী মনে করছি। তাই ভাবলাম, আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় কীভাবে বাংলাদেশের পক্ষে থাকতে পারি। সুনীল (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) ও শক্তির (শক্তি চট্টোপাধ্যায়) সঙ্গে আলাপ করলাম। ওদের প্রস্তাব দিলাম শরণার্থীদের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখার জন্য আমি যেতে চাই সীমান্তবর্তী কোথাও, যেখানে যুদ্ধ চলছে। সুনীল বলল, আমরা বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তের কাছাকাছি বেনাপোল যেতে পারি। সেখানে বাংলাদেশ থেকে আসা লাখ লাখ শরণার্থী মানবেতর জীবনযাপন করছে। আমার সঙ্গে একটি ক্যামেরা এবং অনেক সাদাকালো ফিল্ম ছিল। খুব ভোরে ব্যাগ নিয়ে রওনা দিলাম বেনাপোল। যা দেখলাম, অবর্ণনীয়। আমরা পশ্চিমারা দুটো বিশ্বযুদ্ধ দেখেছি, কিন্তু যুদ্ধের কারণে সাধারণ মানুষের এমন মর্মস্পর্শী ও বেদনাদায়ক চিত্র আগে কখনো দেখিনি। আমি সাদা চামড়া, আমাকে দেখে শরণার্থীরা এগিয়ে এল সাহায্যের আশায়। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারছিলাম না। ক্যামেরায় সেই সময়ের বেশ কিছু দৃশ্য ধারণ করেছিলাম, যা পরে একটা নেগেটিভের বাক্সসহ হারিয়ে যায়। 

শরণার্থীশিবিরে ঘুরে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল আমার। অক্টোবরে নিউইয়র্কে ফিরে গেলাম। প্রতিদিনই ভাবতে থাকি, বাংলাদেশের জন্য আমি কী করতে পারি। হঠাৎ মাথায় এল, আমি কবিতা লিখতে তো পারি। লিখেও প্রতিবাদ করা যায়। কয়েক দিন ঘরে থেকে লিখলাম একটি দীর্ঘ কবিতা—‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। আমার বিক্সবি ক্যানিয়ন টু যশোর রোড নামের বইটিতে কবিতাটি ছাপা হয়েছে।