আমি, শওকত আর কাজল

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ঘুমের মধ্যে শওকত আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ডাক দিল, ‘কাজল, কাজল।’ সে কোনো ভয়ের স্বপ্ন দেখছে। চিটচিটে গরম। তার হাত ঘামে ভেজা। যদিও রাতে বৃষ্টি ছিল। রাতটা ঠান্ডা।

আজই প্রথম নয়। কয়েক সপ্তাহ ধরেই শওকত এমন করছে। তার অফিসে কিছু হয়েছে?

তার হাত আলগোছে সরিয়ে দিই। তবু আবার সে আমার হাত আঁকড়ে ধরে। যাহ্, ঘুমটা এবার পুরোপুরি গেল আমার!

উঠে এসে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে বারান্দায় বসলাম। ‘কুঁউ, কুঁউ’ করে একটা কুকুর কাঁদছে। একটা সাদা টয়োটা মসৃণভাবে এগোল গলি ধরে। এত দূর থেকে ওটাকে একটা ধূর্ত পোকার মতো লাগে। বারান্দায় বাতাস।

আগেরবার শওকত যখন এমন করেছিল, আমি বললাম, ‘আমি কাজল নই,’ ঘুমের মধ্যে সে নড়ে উঠে বলেছিল, ‘উঁহু, উঁহু, কা...জ...ল’, না বুঝেই হয়তো।

কাজল শওকতের প্রথম স্ত্রী। বেশ কয়েক বছর হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে। তবু শওকত কাজলকে ভুলতে পারে না।

আবার বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে করতে পুরোনো একটা খারাপ লাগা আমাকে ঘিরে ধরে থাকে। ভাঙা ভাঙা স্বপ্নে দেখি, শওকত একটা মেয়ের হাত ধরে দৌড়াচ্ছে। মেয়েটার পেট ভারী। দৌড়াতে দৌড়াতে মেয়েটা একসময় একটা গর্তে পড়ে গেল। শওকত তার হাত ধরে খুব চেষ্টা করছে টেনে তোলার। পারছে না। তখন অদৃশ্য একজন মোটা গলায় আমাকে খুব ধমকাচ্ছে। একটা কালো তেলাপোকা আমার গায়ে উঠে পড়েছে। সেটাকে যতই তাড়াতে চেষ্টা করি, যায় না। ঘুম ভালো হয় না।

সকালে অফিসে যাওয়ার আগে শওকত জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার কি শরীর খারাপ?’

আমি বলি, ‘না, ঠিক আছি।’

সে ভ্রু উঁচিয়ে চিন্তিত গলায় বলে, ‘ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না, তাই না?’

তার আর্দ্র গলা। আমার কেমন যেন লাগে। ছোট করে বলি, ‘না।’ তারপর ওর দিকে চেয়ে আবার বলি, ‘চিন্তা কোরো না, ঠিক আছি।’ আর কথা বাড়াতে ইচ্ছা করে না। তবু বলি, ‘অফিসে খুব চাপ, না?’ ও  খুশি হলো। আমি তো ওকে অফিসের কথা তেমন জিজ্ঞেস করি না।

‘না!’ একটু থেমে বলল, ‘তুমি রেস্ট নাও। আজ বাইরে কোথাও খাব।’

আমার বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা নেই।

অফিসের জন্য বেরিয়ে যাওয়ার পরও সে বারবার আমাকে সারা দিন ফোন করবে। আর প্রতিবারই আমার নাম ভুলে যাবে। ‘কাজল’ বলতে গিয়ে মনে মনে কয়েক মিনিট হাতড়ে অবশেষে ডাকবে ‘রিনি’। আমিও এতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি।

বসার ঘরে শওকত আর কাজলের ছেলে অয়নের ছবি। অয়ন এখন হাতিরপুলে। তার খালার বাসায়। মাঝেমধ্যেই শওকত তাকে সেখানে পাঠায়। সেই সময়টা সে খুব অস্থির থাকে। বারবার মুঠোফোনে ছেলের ছবি বের করে দেখে, ফোন দেয়।

ইদানীং আমি বুঝতে পারছি, ওদের জীবনে আসলে আমার কোনো প্রয়োজন নেই। সবকিছুই পূর্ণ। আমার জন্য খালি নেই কিছুই। আবার আমারও ওদের ছাড়া চলছে তো, এটা জানি—তবু এভাবে ভালো লাগে না।

শওকত সাবধানী। কাজলের ছবি বাড়িতে কোথাও নেই। জানি না দেখতে কেমন ছিল। হয়তো সে চেষ্টা করছে ছেলেটার জন্য সংসারটা গুছিয়ে রাখতে। যে স্ত্রী তাকে আর তার সন্তানকে ফেলে গেছে, তার স্মৃতি মুছে ফেলেছে। সে কি চলে গেছে, নাকি মরে গেছে? তা-ও জানি না। কী বলেছিল আমাকে?

সেদিন বারান্দায় অপরাজিতার লতায় বসা ছিল একটা চড়ুই। অয়ন পাখিটাকে দেখে খুশি হয়। একবার সে এখানে, এই বারান্দাতে বসেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মাম্মা, তুমি কি পাগল?’ আমি অবাক। পরে শান্তভাবে জিজ্ঞেস করেছি, ‘কে বলেছে?’

‘আনিস আঙ্কেল। বৃষ্টি আর মন্টিও বলে।’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি পাগল।’

সে বলল, ‘পাগল হতে কেমন লাগে?’

‘খারাপ না।’

‘যা ইচ্ছা তা-ই করা যায়?’

‘হ্যাঁ,’ সে দূর থেকে বড় বড় চোখ মেলে আমাকে লক্ষ করে।

টুংটাং টুংটাং সুন্দর বাজনা শোনা যাচ্ছে। শওকত ফোন করেছে, ‘কী করছ?’

‘ঘুমাচ্ছিলাম’।

‘খুব ভালো, ঘুমাও। তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছিল। অয়ন ফোন করেছিল?’

‘করেছিল। নৌকায় চড়েছে, ফড়িং ধরেছে।’ এগুলো বললাম বানিয়ে। যেন সে খুশি হয়। এই লোকটি, যে কিনা ঘুমিয়ে আমাকে ডাকে, ‘কাজল’, তাকে সামান্য কয়েকটা মিথ্যা বলে শান্তি দিয়ে কেমন যেন প্রতিশোধের মতো সুখ লাগে!

মিথ্যাগুলো শুনে শওকত আনন্দিত। বলল, ‘আজ তাড়াতাড়ি ফিরব। তোমার নিশ্চয়ই একা একা খারাপ লাগছে।’

সে দেরি করলেই আমি খুশি। তবু বললাম, ‘হুঁ।’

টিভি চালিয়ে দেখার মতো কিছু পেলাম না। কোথায় যেন অনেক মানুষ মরে গেছে। আরেক জায়গায় পুরোনো দিনের হিন্দি ছবি চলছে। এক জায়গায় অকারণে কিছু লোক কাদার মধ্যে লাফালাফি করছে। কাদা না টমেটো! দাঁত বের করে হাসছে।

‘মুরগিয়া, মুরগিয়া’ বলতে বলতে মোটা গলার কে একজন গলা ফাটাচ্ছে। একজন সাদা জামার ভিক্ষুক থু থু করছে। তাকে শনি আর মঙ্গলবারে দেখা যায়। একজন ডাবওয়ালা একটা ডাব কেটে ফেলল। নীল-সাদা স্কুলড্রেস পরা বাচ্চা দৌড়ে যাচ্ছে। তার কালো চুলে সাদা ফিতে উড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, আজই শওকতকে কথাগুলো বলব। আর না বলার মানে হয় না।

বিকেলে আকাশ ফাটিয়ে বিদ্যুচ্চমক আর বৃষ্টি। রাস্তার কামিনীগাছগুলো থেকে বেশুমার ঘ্রাণ আসতে লাগল। কিন্তু আমার খুব অস্বস্তি লাগছে। গন্ধটা এমন তীব্র! মনে হচ্ছে আমার সারা শরীর কাঁপছে। গন্ধ শুধু নাক নয়, সারা শরীর দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। এত সুবাসে অস্বস্তি লাগছে।

দুই

আশ্চর্য!

শওকত একটুও অপ্রস্তুত হলো না। মনে হলো, বিষয়টা সে জানত।

মোমবাতির শিখা জানালা দিয়ে আসা বাতাসে একটু একটু কাঁপছিল। সেদিকে তাকিয়ে আমি বললাম, ‘মনে হয়, আমার চলে যাওয়া উচিত।’ তাকিয়ে দেখলাম, আমার কাঁধের দিকে তাকিয়ে আছে সে। কাঁধের ওপর দিয়ে ওপাশে জানালা দেখা যায়, সেখানে অন্ধকার। তার চোখ সেদিকে। আমি তাকে সব বললাম। সে ঘুমিয়ে আমাকে তার সাবেক স্ত্রীর নামে ডাকে। আমাকে ছাড়াই তার জীবন পূর্ণ।

সে শুনল। নিজের পায়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর মাথা তুলে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘কাজল, তোমার কি কিছুই মনে নেই?’

আমি শক্ত গলায় বললাম, ‘প্লিজ, কল মি রিনি।’

শওকত বলল, ‘না, তুমিই  কাজল।’

একটু থেমে বলল, ‘তোমার মনে নেই রিনি নামটা তোমাকে দিয়েছিল লিটু? আজকাল তুমি ওই নামটা ছাড়া জবাব দিতেই চাও না।’

আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে যাই। কারণ, লিটু নামটা চেনা চেনা লাগে।

‘এমন তোমার প্রায়ই হয়। ডাক্তারও বলেছেন, হবে। আশা ছাড়িনি।’

‘আমার আর কোনো স্ত্রী ছিল না। তোমাকে ছাড়া আর কাউকে…। শোনো, তোমার হয়তো মনে করতে কষ্ট হচ্ছে। মাঝেমধ্যেই হয়।’

‘কী?’ আমার অধৈর্য লাগে, তার এমন নাটক করা!

ও বলে চলে, ‘লিটু আরেকজনকে বিয়ে করেছিল। তুমি এত শকড হয়েছিলে, মেনে নিতে পারোনি কোনো দিন। বরং মাঝেমধ্যে আমাকেই লিটুর মতো ভেবে বসো। যেন আমি অন্য কাউকে বিয়ে করেছি। অন্য কাউকে ভালোবাসি। তুমি খুব অসহায় হয়ে যাও। সব তোমার মন থেকে হারিয়ে যায়। আসলে তুমি ওকে এত ভালোবাসতে!’

শওকত চুপ করে থাকে। একনিশ্বাসে অনেক কথা বলে সে এখন খানিকটা জবুথবু। যদিও তার গলার স্বরে একটু আগেও ছিল প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস। কিন্তু আমার কিছুই মনে পড়ছে না। কেবল লিটু নামটা চেনা চেনা মনে হয়। আর মনে হয়, সব একটা পাতলা মসলিন-ওড়নায় ঢাকা। হয়তো কোনো স্বপ্ন। বহুদিন আগে দেখা।

শওকত বলে, ‘লিটু আর তুমি কলেজে পড়তে। প্রেমে পড়েছিলে তোমরা। তুমি সবটুকু দিয়েই...। বিয়ে করবে কথা ছিল। হয়নি। সে পালিয়েছিল। কিন্তু তত দিনে তোমার গর্ভে সন্তান। লিটু বিয়ে করে ফেলল আরেকজনকে। তোমার মা হওয়ার বিষয়টি বুঝে ফেললেন তোমার মা।’

শওকত কথা বলছে। আমি নির্বাক, চারপাশের অন্ধকারের মতো।

‘তখনই আমি চেয়েছিলাম তোমাকে। এমনি এমনি নয়, ভালোবাসতাম । আমরা বড় হয়েছি একসঙ্গে। তুমি বুঝতে না, তোমাকে ছাড়া আমি কিছুই ভাবিনি।’ শওকতের এই সব কথার পরও আমার অন্ধকার কাটে না। আমার কিছু মনে পড়ে না। মনে থাকে না কিছুই।

অস্থিরভাবে আমি বলি, ‘অয়ন কোথায়, অয়ন?’

‘ও শেফার কাছে আছে। সকালে চলে আসবে।’

‘চা খাবে, কাজল?’

‘হ্যাঁ।’

শওকত চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হয়, সে একটা জটিল মানুষ। এত নিখুঁতভাবে গল্পটা সে সাজিয়েছে! একটু পর চায়ের কাপ হাতে ঘরে এল শওকত। বিদ্যুৎ চলে এসেছে। তাকে অবিশ্বাস করলেও মনে হয় না আজই তাকে ছেড়ে যাব আমি। আরেকটু দেখা যাক, আমি কি আসলেই কাজল?

মনে নেই, আমার কিছুই মনে নেই। চায়ের কাপ হাতে ওই তো শওকত এগিয়ে আসছে...।