৫-এর মাথাটা ফাঁক হয়ে গেছে

কাজী মোতাহার হোসেন (৩০ জুলাই ১৮৯৭—৯ অক্টোবর ১৯৮১)।  ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম
কাজী মোতাহার হোসেন (৩০ জুলাই ১৮৯৭—৯ অক্টোবর ১৯৮১)। ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম

খ্যাতিমান প্রাবন্ধিক কাজী মোতাহার হোসেনের মৃত্যুদিন ৯ অক্টোবর। তাঁর বর্ণিল জীবনে রয়েছে বলার মতো অনেক ঘটনা, নানা মজার ঘটনা। তার দু-একটি ধরা থাকল এ লেখায়।

সাহিত্যিক, বিজ্ঞানসাধক, দাবাড়ু ও সংগীতরসিক কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে গল্পের শেষ নেই। বর্ণাঢ্য এক জীবন কাটিয়েছেন তিনি। এতটাই আত্মমগ্ন থাকতেন যে মাঝেমধ্যে নিজের সন্তানদেরও চিনতে পারতেন না, সালাম দিতেন। এলিফেন্ট রোডের চৌরাস্তায় বিব্রত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন, বুঝতে পারতেন না কোন দিক দিয়ে যেতে হবে সেগুনবাগান। মুসলিম সাহিত্যসমাজ, তথা বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম এই কান্ডারি কর্মজীবনে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক। বহুমাত্রিক এই মানুষের মৃত্যুবার্ষিকী সমাগত বলে তাঁকে নিয়ে শোকগাথা রচনা করতে হবে, তা নয়। তাঁর দুই মেয়ে, সন্‌জীদা খাতুন ও ফাহমিদা খাতুনের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তাঁরা তাঁদের ‘আব্বু’র কথা বলার সময় মনে বেশ আনন্দ নিয়ে কথা বলেন। যেন একটি পবিত্র শিশুকে নিয়ে কথা বলছেন। তাই আমরা লেখাটিও পাঠকের আনন্দসঙ্গীই করতে চাইব।

কাজী মোতাহার হোসেন কখনো সক্রিয় রাজনীতি করেননি। নিজেকে তিনি একজন বাঙালি এবং একজন মুসলিম বলেই পরিচয় দিতেন। বাংলাদেশের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ বিষয়ে তাঁর মনোভাব জানার জন্য একটা ঘটনার উল্লেখ করা অন্যায় হবে না। অনেকেই জানেন, সে সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন ড. আই আই জুবেরী। তিনি ছিলেন অবাঙালি। তিনি বাংলা পরীক্ষা দিলেন কয়েকবার। প্রতিবারেই ফেল। তখন কর্তৃপক্ষ তাঁকে বাংলা পরীক্ষা দেওয়ার হাত থেকে রক্ষা করল এই বলে যে তাঁকে আর এ বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হবে না। সেই সময় প্রবল আপত্তি তুলেছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন। বলেছিলেন, ‘আমাদের বেলায় ইংরেজি চাপানো যেতে পারে, উর্দু চাপানো যেতে পারে আর ওদের বেলায় বাংলা মাফ কেন?’

কাজী মোতাহার হোসেন সম্পর্কে যত কথা লেখা হয়েছে, তাতে তাঁর আত্মভোলা চরিত্র আর দাবা খেলার নেশার কথাই উঠে এসেছে বেশি। কেউ কেউ সেটা শুধরে নিয়ে বলেছেন, তিনি আত্মভোলা ছিলেন না, ছিলেন আত্মমগ্ন এক মানুষ।

কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে অনেক গল্প-কথার ভিড়ে এ কথা হয়তো অনেকেই ভুলে গিয়েছেন যে ১৯৬১ সালের মে মাসে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তিনজন বিশিষ্ট মানুষ গিয়েছিলেন সিলেটে। তাঁরা হলেন কাজী মোতাহার হোসেন, গোবিন্দচন্দ্র দেব (জিসি দেব) ও বেগম সুফিয়া কামাল। মোতাহার হোসেনের দাবার নেশার কথা সেখানেও সবাই জানতেন। দাবার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন বলে তখনকার তরুণ সালেহ চৌধুরীর ওপর পড়েছিল কাজী সাহেবের দেখভালের ভার। রশিদ মঞ্জিলে হয়েছিল তাঁর থাকার ব্যবস্থা। বাসায় পৌঁছেই সালেহ চৌধুরীকে ডেকে কাজী সাহেব বললেন, ‘শুনেছি, সিলেটে ভালো দাবা খেলোয়াড় আছেন। এখনই কয়েকজন দাবা খেলোয়াড়কে নিয়ে আসেন।’

সালেহ চৌধুরী নিয়ে এলেন আজিজুর রহমান, ফণী বাবু আর আবদুল করিম চৌধুরীকে। কাজী সাহেব খুব ভালো দাবা খেলেন। সংগত কারণে কেউই তাঁর সঙ্গে দাবা খেলায় উৎসাহী ছিলেন না। সালেহ চৌধুরীরা নিজেরা সলা করে ঠিক করলেন, চারজন মিলেই কাজী সাহেবের বিরুদ্ধে খেলবেন তাঁরা। কাজী সাহেব কানে কম শোনেন, তাই দাবার চাল দেওয়ার সময় ফিসফিস আলোচনা করে নেওয়া যাবে। সেভাবেই প্রথম দান হলো এবং যা হওয়ার তা–ই হলো, কাজী সাহেব হারলেন। খেলায় জিতে চারজন তো দারুণ খুশি। কিন্তু কাজী সাহেবের কথা শুনে তাঁদের আক্কেলগুড়ুম! স্বভাসুলভ ধীরকণ্ঠে তিনি বললেন, ‘বুড়ো তো হারল, সবাই খুশি তো? ভেবেছেন, বুড়ো কানে শোনে না, কিছুই বুঝবে না! তবে বুড়োর চোখ তো আছে, ঠোঁট নড়া তো দেখতে পায়।’

খুবই লজ্জা পেলেন তাঁরা। এরপর একা একা যে কটা দান খেললেন, জিতলেন কাজী মোতাহার হোসেন।

এবার বলি মোতাহার হোসেনের রসিকতার কথা। গত শতাব্দীর উনপঞ্চাশ বা পঞ্চাশ সালে কয়েকজন ঠিক করেন পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ নামে একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাবেন। তাঁরা চাইলেন কাজী সাহেবকে তাঁদের সভাপতি করতে। কাজী সাহেব তখন ফজলুল হক হলের হাউস টিউটর ছিলেন। সরদার জয়েনউদ্দীনসহ কয়েকজন গেলেন তাঁর কাছে। সংগঠনের সভাপতি হতে রাজি হলেন কাজী সাহেব। এরপর সংগঠনটি জীবিত ছিল ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত। সভাপতি পদে কোনো পরিবর্তন কখনোই আসেনি, তবে অন্যান্য পদে আসত পরিবর্তন। একবার কোনো একটা পদে সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন আলাউদ্দিন আল আজাদ। বামাচরণ চক্রবর্তী রোডে বিকেল পাঁচটায় সভা। সবাই এসেছেন পাঁচটায়, শুধু এই সম্পাদকের পাত্তা নেই। সম্পাদক আলাউদ্দিন আল আজাদ এলেন ছয়টার সময়। কোনো সন্দেহ নেই, কাজী সাহেব বিরক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি খুব নরম করে মিষ্টি হেসে বললেন, ‘কী আজাদ, এত বিলম্ব যে?’

আজাদ হেসে জবাব দিলেন, ‘কেন স্যার, ঠিকই তো আছে। আমি তো ঠিক ছটায়ই এসেছি।’

এ কথা শুনে কাজী সাহেব একটা গল্প শোনালেন সবাইকে। গল্পটা এ রকম: এক জ্যোতিষ একজনের হাতের রেখা দেখে বলেছিল, ‘আপনার ভাগ্য সুপ্রসন্ন। কাশীতে আপনার মৃত্যু হবে।’ অতএব পাপের কোনো হিসাব হবে না, সোজা স্বর্গলাভ। এ রকম ঘটবে বলে সে ভদ্রলোক এন্তার পাপ করে যেতে থাকল। একদিন খুনের দায়ে তার ফাঁসির আদেশ হলো। জজসাহেব তার শেষ ইচ্ছা জানতে চাইলেন। হতবিহ্বল আসামি সেই জ্যোতিষের সঙ্গে দেখা করতে চাইল। জ্যোতিষ এলে বলল, ‘এই কি আমার কাশীতে মৃত্যু? আজ যে আমি ফাঁসিতে যাচ্ছি!’ জ্যোতিষ হেসে জবাব দিল, ‘সব ঠিক আছে বাবা। কেবল “ক”-এর মাথাটা একটু ফাঁক হয়ে গেছে।’

গল্প শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠলেন, শুধু আলাউদ্দিন আল আজাদের থুতনিটা গিয়ে বুকে ঠেকল।

কাজী মোতাহার হোসেন মিটিমিটি হেসে আলাউদ্দিন আল আজাদকে বললেন, ‘তোমারও সব ঠিকই আছে, কেবল ৫-এর মাথাটা একটু ফাঁক হয়ে গিয়েছে।’

সূত্র: সন্‌জীদা খাতুন সম্পাদিত কাজী মোতাহার হোসেন: আপনজনদের স্মৃতিকথা