শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ ও সত্যজিতের 'সিকিম' নিয়ে সামান্য

শ্রীলঙ্কার কলম্বো শহরে পাহাড়ের ওপর দিয়ে এভাবেই চলে যায় ট্রেন। ছবি: সংগৃহীত
শ্রীলঙ্কার কলম্বো শহরে পাহাড়ের ওপর দিয়ে এভাবেই চলে যায় ট্রেন। ছবি: সংগৃহীত

কয়েক বছর আগে আমি আর রাকা গিয়েছিলাম শ্রীলঙ্কায়। সে ভ্রমণের কথা এত দিন পরে হলেও লিখে রাখার ইচ্ছা হলো খুব। গত কয়েক মাস ও বছরে শ্রীলঙ্কায় কত ঘটনা ঘটে গেল—ভালো ও খারাপ মিলিয়ে। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন শ্রীলঙ্কা ছিল শান্ত ও স্বস্তির একটি দেশ। আমাদের ভাগনে পাভেল (গ্রুপ ক্যাপ্টেন মুনিম) বিমানবাহিনী থেকে প্রশিক্ষণে ছিল তখন ওই দেশে। ও-ই আমাদের খুব উৎসাহিত করেছিল যেতে। আমাদের বেড়াতে যাওয়ার খুব শখ, সে কারণে সংসার খরচ থেকে অর্থ সঞ্চয়ে রাকার ছিল দীর্ঘদিনের উৎসাহ। ব্যস, সিদ্ধান্ত হলো যাওয়ার। শ্রীলঙ্কা ভ্রমণের কথা কত মানুষ ভাবতেন, ভাবেন—আমরা জানতাম না। আমার সামান্য স্মৃতি ছিল শ্রীলঙ্কা-বন্দরের। আমার বাবা পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়েতে চাকরি করতেন, তাঁকে পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়েতে বদলি করা হয়েছিল, করাচি শহরে। আমার বয়স তখন ৮। করাচিতে আমরা ছিলাম কয়েকটি বছর। বেশ কেটেছিল ওই শহরে। ঘুড়ি ওড়ানোর শহর ছিল করাচি। ওই শহর নিয়ে লিখেছিলাম উপন্যাসমতো একটি বইতে। করাচি যাওয়ার পথে আমাদের ‘অ্যারোন্ডা’ জাহাজ এক দিন নোঙর করেছিল শ্রীলঙ্কায় (তখনকার দিনে দেশটির নাম ছিল ‘সিলোন’)। ওই স্মৃতি আমার মনজুড়ে ছিল। তখনকার সিলোন থেকে কী রঙের শাড়ি কিনেছিলেন বাবা, এখনো মনে পড়ে। এ প্রসঙ্গে রেডিও সিলোনের কথা বয়স্ক অনেক মানুষের মনে পড়বে। জনপ্রিয় হিন্দি অনেক গানের কথাও মনে পড়বে। খুব ভালো ভালো তথা বাছাই করা হিন্দি সিনেমার গান তখন প্রায় সারা দিনই আমাদের দেশের ঘরে ঘরে রেডিওতে বাজত। এসব কথা ভেবে পাভেল যখন শ্রীলঙ্কা ভ্রমণে আমাদের উৎসাহ দিচ্ছিল, যাওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করতে সময় লাগল না। দিনক্ষণ ঠিক করে একদিন শ্রীলঙ্কার মিহিন লঙ্কা বিমানে রওনা হয়ে গেলাম আমরা।

সাপুগাসকান্ডা সেনানিবাস থেকে আমাদের নিয়ে যেতে বিমানবন্দরে এল পাভেল। দিন দুই পাভেল ও তার স্ত্রী বেবির বাড়িতে কাটিয়ে ওদের পরামর্শমতো কলম্বো শহরের ভালো দু-চারটি এলাকা ও দোকানপাট দেখে, বেড়ানোর জায়গা সম্পর্কে ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে নুয়ারা এলিয়ায় যাওয়ার উদ্দেশে রওনা হয়ে গেলাম। কলম্বো রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনের অবজারভেশন সেলুনে ক্যান্ডি হয়ে ন্যানোইয়া স্টেশনে নেমে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। এখানে খুব শীত পড়েছিল, তার মধ্যে ছিল বৃষ্টি। হোটেলে থাকলাম দিন দুই। এখানকার গ্রেগরি লেকটি দারুণ, বেশ অনেকটা দীর্ঘ। ইডেন হিল হোটেলটি বেশ, তবে ভাড়াও যথেষ্ট, দুই রাত তিন দিন থাকলাম। একটি টিলার ওপর হোটেলটি।

ফিরে এসে কলম্বোর গলফেস সি-বিচ, নেগাম্বোর সি-বিচে বেশ সময় কাটানো হলো।

সাপুগাসকান্ডায় দুই দিন থেকে আমরা হিক্কাডুয়া নামের একটি সমুদ্রঘেরা জায়গার উদ্দেশে রওনা হলাম। কলম্বোর মাহারাগামা বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে এক্সপ্রেস বাসে চেপে সমুদ্রের ধার দিয়ে গেলাম গল-এ। গল-এ নেমে লোকাল বাসে আমরা গেলাম হিক্কাডুয়া। এখানে খুব চমৎকার পরিবেশে সমুদ্রের ধার ঘেঁষে থাকা সুন্দর ব্লু-নোট কটেজে থাকা হলো। সমুদ্র্রসৈকতে সকাল-বিকেল কাটালাম। কটেজের পাশেই ছিল সমুদ্র। তার আছড়ে পড়ার গর্জনের ছিল না বিরতি। বিদেশিরা সমুদ্র্রস্নানে মগ্ন হয়েছিলেন অনেক সময় ধরে।

ফেরার সময় গলে ওল্ড ডাচ সিটি ও ক্রিকেট মাঠ দেখলাম। এই ক্রিকেট মাঠটি দেখারও শখ ছিল আমার, কাছে থেকে।

কলম্বোতে ফিরে বাসস্ট্যান্ডে শ্রীলঙ্কার এক লোককে আমাদের ফেরার বাসটি কোনদিকটায় পাব জিজ্ঞেস করেছিলাম। আর কী কাণ্ড, সেই লোক নিজের বাসের সিট ছেড়ে আমাদের বাসটি খুঁজে দিতে গিয়ে নিজের বাসটিকে হারালেন। এ রকম পরোপকারী বেশ কিছু মানুষকে আমরা পেয়েছিলাম শ্রীলঙ্কায়।

সুন্দর পথ চারদিকে। ভাঙাচোরা নয়। মসৃণ। মানুষজন ভদ্র। ঘুড়ি ওড়াতে ভালোবাসেন এ দেশের লোকেরা। করাচির কথা মনে পড়ে। সেখানেও দেখেছি ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব। করাচির সঙ্গে কলম্বোর বেশ খানিকটা মিল আছে বলে মনে হলো।

কলম্বোতে ট্রেনের রাস্তা দারুণ। পাহাড়ে পাহাড়ে ট্র্রেন চলার পথ। অদূরে-দূরে দারুণ দৃশ্য। এ জীবনে বেশ অনেক দেশই দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু পাহাড়ের ওপর দিয়ে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এবারই প্রথমবার।

এবার কিছু খাবারের কথা। এগ হপার, কোত্থু রোটি, স্টিং হপার—সবকিছুর সঙ্গে চিংড়ি মাছ, নারকেল আর লাল মরিচের চাটনি চায়নিজসহ সব ধরনের খাবারে। একটি ফল খাওয়া হয়েছে: প্যাশন। প্রায় সব খাবারই বেশ সুস্বাদু।

আরও যা ভোলার নয়: রেলওয়ের একজন শিক্ষিত কর্মচারী আমাদের স্যুটকেস ট্রেনে উঠিয়ে দিলেন। সমুদ্র, পাহাড় দেখা, ঘুরে বেড়ানোয় কোনো গাইড না থাকলেও কোনো অসুবিধা হয় না। নিজেরা নিজেরা সব দেখে নেওয়া যায়।

এ দেশে শিক্ষিতের হার অনেক বেশি, সে কারণে পথের প্রায় যে কাউকে কোনো জায়গার কথা জিজ্ঞেস করলে সহজে খুঁজে পাওয়া যায়।

সত্যজিৎ রায়ের সিকিম–এর দৃশ্য
সত্যজিৎ রায়ের সিকিম–এর দৃশ্য

সত্যজিৎ রায়ের তথ্যচিত্র ‘সিকিম’

শেষ পর্যন্ত দেখা হলো ‘সিকিম’। নাম শুনেছিলাম? না, শুধু বাঁশি? বাঁশি। সেই কতকাল আগে তৈরি করা ছবি সত্যজিতের। একাত্তরে নাকি তৈরি হয়েছিল, তাই তো দেখা হলো ওয়েবে। লেখা হয়েছে, দীর্ঘ ৩৯ বছর ধরে এই ছবি আলোর মুখ দেখেনি। আহা-হা। আগে কেন দেখা হলো না এই ছবি। নিষিদ্ধ বুঝি ছিল। ফুল ও পাখির ডাক, আর ঝরনা। জলস্রোত নামছে পাহাড়ের থেকে নেমে আসা সরু পথ ধরে। পাহাড়ে মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের উৎসব, গান, বিচিত্র রান্নাবান্না।

হিমালয় এলাকার ম্যাপে ছোট একটি রাজ্য, স্বল্পদিনের। ভারতের উত্তর দিকে এর অবস্থান। হিমালয়ের উঁচু উঁচু পর্বতরাজির মধ্যে সিকিম হচ্ছে তৃতীয় সর্বোচ্চ উচ্চতায়। কাঞ্চনজঙ্ঘার গা ঘেঁষেই সিকিম, যা সহজে চোখে পড়ে না, যদি না কেউ খুব ভালো করে খুঁজে বের করে। নেপাল হচ্ছে উঁচু উঁচু পাহাড়ি এলাকার মধ্যে তৃতীয় উচ্চতায়, কাঞ্চনজঙ্ঘার সমান এলাকাটি হচ্ছে সিকিম; এর দক্ষিণে পশ্চিমবঙ্গ, তিব্বত হচ্ছে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ–পূর্বে। তিব্বত থেকে এসেছে মানুষজন। নেপাল থেকে এসেছে অনেকে।