সোহানা খানের সুইসাইড

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

চিত্রনায়িকা সোহানা খানের মৃত্যুর পর তিন দিন কেটে গেলে আমরা বুঝতে পারি, সে আসলে আত্মহত্যাই করেছে। অন্তত টিভি রিপোর্ট আর পত্রিকা মারফত যেসব খবর আসে, তা সবই আত্মহত্যার দিকেই আমাদের চিন্তাকে ধাবিত করে। একটা অতি উৎসাহী পত্রিকা শুধু লেখে, যেহেতু এখনো কোনো সুইসাইড নোট পাওয়া যায়নি, সেহেতু এ বিষয়ে আরও কিছুদিন নিশ্চয়ই পুলিশ ভেবে দেখবে। রুনা সেই খবরের লিংক আমার ফেসবুকে পাঠায় এবং তার নিচে লেখে, ‘দেখো, তোমাদের নায়িকা কিন্তু সুইসাইড নোট লিখে যায়নি। তোমার বিপদ এখনো কাটেনি, বুঝলে?’

আমি একটা শুটিংয়ের ভেতর ছিলাম বলে এবং ঘটনাটিকে নিছক রসিকতা ভেবে মৃদু হাসির একটা ইমো পাঠিয়ে আবার স্ক্রিপ্টে মন দিই। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যাতেই আমাদের শুটিংপাড়ায় হাজির হয় পুলিশ। আমাকে জানায়, আমার সঙ্গেই নাকি তাদের কিছু কথা আছে!

ভেবেছিলাম, আমাকে থানায় যেতে হবে, কিন্তু তা না করে ওরা আমাকে একটা ফ্ল্যাট বাসায় ওঠায়। সেখানে কেউ বাস করে বলে আমার মনে হয় না। আমি বারবার জানতে চাই, কী হয়েছে? কী নিয়ে কথা বলতে হবে, কিন্তু তারা অযথা রহস্য করে এবং রুনাকে ফোন দিয়ে জানাতে বলে যে আজকে রাতে আমি ফিরব না, সে যেন দুশ্চিন্তা না করে!

আমার দুশ্চিন্তা বাড়ে। কিন্তু ভয় না পাওয়ার ভাব করে রুনাকে ফোন দিয়ে বলি শুটিংয়ের কাজে ঝামেলা হওয়ায় আমার ফেরা হবে না। সে যেন চিন্তা না করে। অবশ্য রুনা চিন্তা করবে বলে আমার মনে হয় না। আমার এমন রাত-কাবারে তার অভ্যস্ততা আছে।

একটু বেশি রাতে ওরা আমাকে খেতে দেয়। পাশের কোনো রেস্তোরাঁ থেকে আনানো বিরিয়ানি। খেতে খুব স্বাদ। সরিষার তেল দিয়ে রান্না। আমার খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই একজন প্রশ্ন করে, ‘সোহানা খানকে আপনি কীভাবে চেনেন?’

আমিও মনে করার চেষ্টা করি সোহানা খানকে আমি কীভাবে চিনি, প্রথম কখন দেখা হয়েছিল ইত্যাদি। কিন্তু আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ করি, আমার কিছুই মনে আসছে না। সোহানা খানের ফ্ল্যাটে আমি বেশ কয়েকবার গিয়েছি, এটুকু শুধু মনে আছে। গুলশানের দামি একটা ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটের বাইরে নিয়মিত যত্ন করা গাছ। বাসার সাততলায় থাকত সোহানা খান। বলত, ‘লাকি সেভেনে থাকি!’

তবে আমার এ যাওয়াও তো আসলে পেশাগত কারণেই। তাকে গল্প শুনিয়ে, স্ক্রিপ্ট শুনিয়ে, চরিত্র বুঝিয়ে সিনেমার উপযুক্ত করে তোলাও তো আমারই দায়িত্ব ছিল। আমরা একটা সাপের ছবি বানাতে যাচ্ছিলাম...সোহানা খান সেই সিনেমার নায়িকা ছিল। নাগরাজের কন্যা। নাগিন ধরনের সিনেমা। খুব হিট হওয়ার চান্স ছিল। এখন তো সোহানা খানই নেই।

ওদের আমি এসব বলি না, বা বলিও কিছু কিছু।

ওদের মুখ দেখে মনে হয় না ওরা এসব কথা বিশ্বাস করেছে। একজন বলে, ‘সাপের সিনেমা এখন চলে নাকি? দুনিয়া সিনেমা নিয়ে মঙ্গলে যাচ্ছে আর এই ব্যাটারা আছে সাপ নিয়ে! বাংলা সিনেমার কিছু হয় না এসব রাইটারদের জন্যই!’

আমি বলি, ‘রাইটারের কিছু করার থাকে না রে ভাই! রাইটারদের যা লিখতে বলা হয়, তা–ই লেখে!’

তখন আচমকা আরেকজন ধমক দেয়, ‘ফেসবুক কত দিন ধরে চালাও তুমি?’

আমি মনে করার চেষ্টা করি...কিন্তু মনে আসে না কিছু। শুধু মনে আসে, রুনা আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘নিজের লেখা সিনেমার প্রচারণা চালাবা এখানে!’

পরে আমার তেমন কোনো সিনেমা লেখাও হয়নি আসলে। প্রচারণাও চালানো হয়নি। মাঝেমধ্যে কবিতা আপ করতাম। খুবই খারাপ কবিতা। তবে কেউ কেউ খুব ভালো বলত। ফেসবুকে ওইটুকু প্রশংসা নিয়েই আমি খুশি ছিলাম!

ওদের আমি এসব বলি না, বা বলিও কিছু কিছু।

একজন বলে, ‘তোমার না বউ আছে, তা-ও সোহানা খানের দিকে নজর দিছো মিয়া? ভালোবাসছ তারে? পরকীয়া করছ না?’

সোহানা খান হেসে বলেছিল, ‘আমার কাউকে নিয়েই কোনো ভুল ধারণা নেই। এই যে তুমি...চোখের খিদা নিয়ে বসে থাকো সারা দিন বিড়ালের মতো...কিন্তু মুখে কোনো ম্যাঁও নেই! যা চাও, কোনো দিনও তা বলতে পারবে না...তোমার সেই সাহসই নেই। তোমরা হলে আজন্মের ভিতু!’

সোহানা খান সুন্দর ছিল। ছিল নাচের মেয়ে। দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে ছিল একটা অদ্ভুত টান টান ব্যাপার। ঘাড়টা বাঁকিয়ে যখন সে তাকাত, সুচিত্রা সেনের মতো আবেদন ফুটে উঠত। তার কটাক্ষ ছিল খুবই উপাদেয়। সোহানা খানের ড্রয়িংরুমে বসে একদিন এসব বলায় সে খুব করে হেসেছিল। তারপর বলেছিল, ‘রাইটারদের এই এক সমস্যা জানেন তো! খুব প্রশংসা করে...কিন্তু অন্য আর কিছুই করতে পারে না!’

আমি রাইটার জাতির পক্ষ থেকে কিছু বলা উচিত ভেবে বলেছিলাম, ‘রাইটারদের নিয়ে তাহলে তোমার খুব ভুল ধারণা সোহানা...’

সোহানা খান হেসে বলেছিল, ‘আমার কাউকে নিয়েই কোনো ভুল ধারণা নেই। এই যে তুমি...চোখের খিদা নিয়ে বসে থাকো সারা দিন বিড়ালের মতো...কিন্তু মুখে কোনো ম্যাঁও নেই! যা চাও, কোনো দিনও তা বলতে পারবে না...তোমার সেই সাহসই নেই। তোমরা হলে আজন্মের ভিতু!’

আমি সেদিন গল্প বলায় মন দিয়েছিলাম। আমার কাজ তো ছিল গল্প বুঝিয়ে দেওয়া। বিড়াল হয়ে বসে থেকেই বুঝিয়ে দেওয়া।

ওদের আমি এসব বলি না, বা বলিও কিছু কিছু।

ওরা হাসে। আবার রাগও করে। জানতে চায়, ‘তোমার মনের মধ্যে তাহলে আসলে কী ছিল? সোহানা খান তোমার ফ্যান্টাসি ছিল, ছিল না?’

আমি বলি, ‘সোহানা খান সারা বাংলাদেশের ফ্যান্টাসি ছিল। আপনাদেরও ছিল হয়তো। আমারও হয়তো ছিল।’

একজন বলে ওঠে, ‘শালা পারভার্ট!’

আরেকজন এসে আমাকে থাপ্পড় মারে। গালটা চিনচিনিয়ে ওঠে। সোহানা খানের জন্য মার খেতে হবে ভাবিনি কোনো দিন। রুনার কথা মনে আসে আমার। সে ভাবছে, আমি এখন প্রোডিউসারের রুমের সোফায় এসির হাওয়ায় কম্বল গায়ে দিয়ে মরার মতো ঘুমাচ্ছি! অথচ আমি মরে যাওয়া সোহানা খানের জন্য জেগে আছি। কতক্ষণ থাকব, তা-ও জানি না। হয়তো এরা আমাকে মেরে ফেলবে।

পরের ভোরে ওরা আমাকে একটা চরে নিয়ে যায়। চরটা দেখেই মনে হয় দারুণ লোকেশন। এখানে শুটিংয়ে আসা যেত সোহানা খানকে নিয়ে। ওরা আমাকে দৌড়াতে বলে। আমি দৌড় দিই। লম্বা একটা দৌড়। আমি দৌড়াতেই থাকি। দৌড়াতে দৌড়াতে আমি গুলির আওয়াজের অপেক্ষা করতে থাকি। কোনো আওয়াজ আসে না। অনন্তকাল ধরে আমি দৌড়াই। অনন্তকাল ধরে গুলির অপেক্ষা করি। কোনো আওয়াজ হয় না। আমাকে কোনো গুলি বিদ্ধ করে না। কিন্তু আমি দৌড়াতে থাকি। দৌড়াতে দৌড়াতে আমি নিজেকে আমার ফ্ল্যাটে আবিষ্কার করি।

রুনা বলে, ‘ভয় নেই। সোহানা খানের সুইসাইড নোট পাওয়া গেছে। সবাই জেনেছে সোহানা খান আত্মহত্যা করেছে।’

আমি ঘুমিয়ে পড়ি। আমার মনে হয়, আমি অনেক অনেক দিন ঘুমিয়ে থাকি। ঘুমাতে আমার ভালো লাগে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমার মনে হয়, আমি বেঁচে আছি। রুনা আমার পাশে বসে থাকে। তার শরীরের ঘ্রাণ আমি টের পাই। রুনা নিজের মতো করেই কথা বলতে থাকে, ‘তুমি নাকি এবার সাপের ছবি বানাচ্ছিলে?’

আমি ঘুমের মধ্যে হাসি।

রুনা বলে, ‘কিন্তু তুমি তো কোনো সাপের ছবি লেখোনি?’

আমি ঘুমের মধ্যে হাসি।

রুনা বলে, ‘ক্যারেক্টারের সঙ্গে একাত্ম হতে স্ক্রিপ্ট মিলিয়ে সুইসাইড নোটটা কি সোহানা খানকে দিয়ে তুমিই লিখিয়েছিলে?’

আমি হাসি না। হাসতে আর ইচ্ছা করে না।

রুনা বলে, ‘সোহানা খান কি তোমাকে খুব অপমান করেছিল?’

নিজেকে আমার খুব শক্তিমান ভাবতে ইচ্ছা করে। মনে হয়, আমিই সবচেয়ে শক্তিধর। আমার হাসি আসে, কিন্তু আমি হাসি না। শক্তিধরেরা সব সময় হাসেন না।

রুনা বলে, এবার তাহলে কাকে নেবে সিনেমায়?

আমি চোখ খুলে বলি, ‘কেন, মিতামণিকে!’