সময়ের অন্তরাত্মায় পৌঁছানোর প্রয়াস

আলাপে ঝালাতে: শিল্পের সাহিত্যের আলাপন
সাজ্জাদ শরিফ

প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২১৩ পৃষ্ঠা, দাম: ৪২০ টাকা।

সাজ্জাদ শরিফ যখন প্রখ্যাত তবলাশিল্পী জাকির হোসেনের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘নিজেকে কি আপনার খুব তুচ্ছ বা ভঙ্গুর মনে হয় সংগীতের সামনে?’ প্রশ্নটি শুনে বুঝতে পারি একজন কবি মুখোমুখি হয়েছেন এক সংগীতজ্ঞের। মাধ্যম যা-ই হোক না কেন, শিল্প-সাহিত্যের সৃজনপ্রক্রিয়ায় এক গভীর নাজুকতা থাকে, অনিশ্চিতি থাকে, থাকে অপ্রত্যাশিত বাঁক। আলাপে ঝালাতে: শিল্পের সাহিত্যের আলাপন বইয়ে শিল্প-সাহিত্যের পৃথিবীর এই সংবেদনশীলতা নিয়েই সাজ্জাদ শরিফ আলাপে ঝালিয়ে নিয়েছেন সাহিত্য, চিত্রকলা, অভিনয়, সংগীত, সাংবাদিকতা, গবেষণাজগতের ১৯ জন স্বনামধন্য মানুষের ভাবনার ভুবন।

তেমন সাক্ষাৎকারের আমি বরাবরের আগ্রহী পাঠক, যেখানে সৃজনশীল মানুষটির গভীর মানসজগতে ঢুকে পড়া যাবে, আলো পড়বে তাঁর জীবনের অচেনা প্রান্তে। সৃজনপ্রক্রিয়ার কৌতূহলে আমার লেখকজীবনের শুরুর দিকে শিল্পের নানা শাখায় আমার প্রিয় কিছু মানুষের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, যা সংকলিত হয়েছে আমার কথা পরম্পরা শিরোনামের বইয়ে। সাক্ষাৎকার বা ইন্টারভিউ আমার কাছে ‘ইন্টার-এক্সচেঞ্জ অব ভিউজ’, সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী ও প্রদানকারী উভয়ের মধ্যে প্রাজ্ঞ ভাবনা বিনিময়ের উপলক্ষ। সাক্ষাৎকারের বই আলাপে ঝালাতে সেই ভাবনা বিনিময়ের এক উজ্জ্বল স্বাক্ষর।

আমি মনে করি, একটি ভালো সাক্ষাৎকারের প্রথম শর্ত অনুপুঙ্খ প্রস্তুতি। সাজ্জাদ শরিফের নেওয়া প্রতিটি সাক্ষাৎকারে সেই প্রস্তুতির চমৎকার নমুনা আছে। সিরীয় কবি আদোনিস যে ১৯৭১ সালে ‘নিউইয়র্কের জন্য একটি কবর’ লিখেছেন, বরিশালে জন্ম নেওয়া ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী বরিশালের বিস্তৃত স্মৃতিচারণা লিখলেও যে এ কে ফজলুল হক বিষয়ে বিশেষ কিছু লেখেননি, বোনের অসুস্থতার সূত্রে এ আর রহমানের যে ধর্মানুভূতির পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে—এমনভাবে প্রত্যেকের বিষয়ে নানা খুঁটিনাটি তথ্য হাতে নিয়েই আলাপ করতে বসেছেন তিনি। ভালো হোমওয়ার্ক করা থাকলে, যাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে, তিনি সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর ওপর আস্থা স্থাপন করে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই নিজেকে খুলতে শুরু করেন। আর এভাবেই সাক্ষাৎকারটি হয়ে ওঠে উঁচু মানের।

বলা দরকার, এখানে যাঁদের সাক্ষাৎকার সাজ্জাদ শরিফ নিয়েছেন, তাঁরা সবাই সংস্কৃতিজগতের তারকা। ফলে, খুবই স্বাভাবিক যে তাঁরা জীবনে বহুবার এমন সাক্ষাৎকারের মুখোমুখি হয়েছেন। সেই কাণ্ডজ্ঞানকে বিবেচনায় রেখেই সাজ্জাদ দুয়েকজনের কাছে বরং জানতে চেয়েছেন, এমন কোনো প্রশ্ন আছে কি না, যা আগে কেউ তাঁকে জিজ্ঞাসা করেননি। এ কারণেই আলাপ হয়ে উঠেছে প্রাণবন্ত।

সাজ্জাদ যখন কবির সুমনকে বলেন, কলকাতার বাবুসমাজ গানকে কী করে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে খেউরগানকে গালিতে পর্যবসিত করেছিল, তখন তাঁর এই পর্যবেক্ষণে সুমনও মুগ্ধ হন। তাঁর আলাপের সূত্রে জানা যায় বিভিন্ন অজানা তথ্য। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আলাপের সূত্রে জানতে পারি, শক্তি চট্টোপাধ্যায় কীভাবে কফি হাউসের টেবিল বদল করে গদ্যকার থেকে হয়ে গেলেন কবি। কাইয়ুম চৌধুরীর বয়ানে জানা গেল পরীক্ষায় ফেল করা রশিদ চৌধুরীর কান্নায় ভেঙে পড়ে চিত্রকর হওয়ার আকুতি। জানতে পারি, প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক মার্ক টালির বাংলাদেশের আখাউড়ায় জন্মের ইতিবৃত্ত।

সিরীয় কবি আদোনিসের সঙ্গে সাক্ষাৎ পাওয়ার দুর্লভ সুযোগকে সাজ্জাদ মোক্ষমভাবে কাজে লাগানোতেই আমরা জানতে পারি বিশ্ব পরাশক্তির হাতে মুসলিম বিশ্বের ব্যবহৃত হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর ক্ষোভের কথা। জানা যায়, আমেরিকান গবেষক ক্লিনটন বি সিলির বিচিত্রভাবে বরিশালের জীবনানন্দকে ভালোবেসে ফেলার গল্প। রবীন্দ্রনাথ কেন সব সময় কাউন্টার-কালচার হিসেবে রয়ে যাবেন, উইলিয়াম রাদিচের কাছে শোনা যায় সেই বয়ান।

উপভোগ করি রাজনীতিসচেতন ও মননশীল অভিনেত্রী শাবানা আজমি ও নন্দিতা দাসের সঙ্গে সাজ্জাদ শরিফের কথোপকথন। ভালো লেগেছে বাংলাদেশি অভিনেত্রী জয়া আহসানের বুদ্ধিদীপ্ত আলাপ। দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি উচ্চারণ করেন কী করে রূপের চেয়ে বরাবর নজর দিয়েছেন অভিনয়ের মননশীলতার দিকে। বাঙালি মুসলমান প্রশ্নে আনিসুজ্জামান ও আহমদ ছফার সঙ্গে জরুরি কিছু প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন সাজ্জাদ।

সব আলাপ যে গভীরতায় পৌঁছেছে, তা হয়তো বলা যাবে না—যেমন সুফিয়া কামালের সঙ্গে আলাপটি। আলাপগুলোর খানিকটা বিস্তারিত প্রেক্ষাপট, ইংরেজিতে নেওয়া সাক্ষাৎকারগুলোর অনুবাদের প্রক্রিয়া ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সংযুক্ত হলে এর প্রামাণ্য মূল্যের অসম্পূর্ণতা ঘুচত বলে মনে করি। তবে সার্বিকভাবে এই দাবির সঙ্গে একমত হতে হয় যে এ বই নানা কণ্ঠস্বরের ভেতর দিয়ে আমাদের সময়ের অন্তরাত্মাকে বোঝার জন্য চমৎকার একটি উদ্যোগ।