শামসুর রাহমানকে যেমন দেখেছি

>২৩ অক্টোবর বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানের জন্মদিন। জন্মদিনের প্রাক্কালে তাঁর সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করেছেন আরেক কবি।
শামসুর রাহমান  (২৩ অক্টোবর ১৯২৯–১৭ আগস্ট ২০০৬)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম, ২০০৪
শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯–১৭ আগস্ট ২০০৬)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম, ২০০৪

সে বছর শীতে কবিতা উৎসব জমে উঠেছিল কলকাতায়। ১৯৮৫ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে ‘আবৃত্তিলোক’–এর আয়োজনে উদ্​যাপিত হয়েছিল এই কবিতা উৎসব। বাংলাদেশ থেকে নবীন-প্রবীণ কবি–সাহিত্যিক, আলোকচিত্রীদের বড় একটি দল উপস্থিত হয়েছিল সেই উৎসবে। ওই দলে ছিলেন একদল কবি—শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, আল মুজাহিদী, আবু হাসান শাহরিয়ার, সৈয়দ আল ফারুক, ছিলেন কথাশিল্পী মুনিরা কায়েস ও আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন। সেবার আমিও ছিলাম তাঁদের সঙ্গে। গিয়ে দেখি হইহই রইরই ব্যাপার। পশ্চিমবঙ্গের কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর শক্তি চট্টোপাধ্যায় রীতিমতো কোমরে গামছা বেঁধে বড় কর্তার মতো উৎসবের দেখভাল করছেন। শামসুর রাহমানকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল এই উৎসবে। বয়োজ্যেষ্ঠ বলে কিছু কিছু দায়িত্ব দলের বড়দের ওপর এসে পড়ে। কবির নির্লিপ্তি নিয়ে দায়িত্ব পালনের এক অনন্য ভূমিকায় দেখেছিলাম সে সময় রাহমান ভাইকে। পশ্চিম বাংলার কোনো কোনো কবির উচ্ছ্বাসের অতিরেক থেকে বাংলাদেশের কোনো কোনো কবিকে নিষ্ক্রমণের পথ বাতলে দিয়েছেন কখনোবা। শান্তিনিকেতনে এক বাংলাদেশি কবি দম্পত্তির রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করেছেন নিজে কষ্ট স্বীকার করে। 

শান্তিনিকেতন থেকে ফেরার পথে ল্যাংচা মহলে ল্যাংচা খাওয়ারও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাহমান ভাই। বলেছিলেন, ‘ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে এখন ল্যাংচা খেতে যাব’—কথাটা মনে পড়ছে। নিজেকে এবং আশপাশের অন্যদের নিয়ে নির্মল পরিহাস করার প্রবণতা ছিল শামসুর ভাইয়ের। কখনো কখনো তা যথেষ্ট কর্কশ হলেও অপরকে আহত করার মতো তেমন তীক্ষ্ণ হতো না। এতে কবির সূক্ষ্ম কৌতুকবোধ ও প্রগাঢ় ‘ড্রামাটিক আয়রনি’ বোধের প্রকাশ ছিল। সেবার বাংলাদেশি কবি-সাহিত্যিকদের দলে ‘আল’ নামটির আধিক্য ছিল। এ সম্পর্কেও তিনি একটি কৌতুকপ্রদ মন্তব্য করেছিলেন, যা উপস্থিত সবাইকে নির্মল হাসির খোরাক জুগিয়েছিল। 

একটি অনুষ্ঠানে শামসুর রাহমানের থালায় খাবার তুলে দিচ্ছেন রুবী রহমান, ১৯৮৫। ছবি: রুবী রহমানের সৌজন্যে
একটি অনুষ্ঠানে শামসুর রাহমানের থালায় খাবার তুলে দিচ্ছেন রুবী রহমান, ১৯৮৫। ছবি: রুবী রহমানের সৌজন্যে

রাহমান ভাইকে নিয়ে লিখতে বসে আরেকটি ছবি ভেসে উঠছে মনের চোখে। একদিন দুপুর ১২টার দিকে গিয়েছি তাঁর শ্যামলীর বাসায়। রাহমান ভাই সকালে লেখেন, তাই একটু বেলা করেই গিয়েছি। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে দেখি, সামনের ডাইনিং স্পেসে খাবার টেবিলে বসে জোহরা ভাবি চাল বাছছেন আর রাহমান ভাই পাশে বসে আছেন। আমিও সেই টেবিলেই বসলাম। এটা-সেটা নানা প্রসঙ্গে কথা হলো। একপর্যায়ে রাহমান ভাই বললেন, ‘দুপুরে খেয়ে যাবে কিন্তু।’ ভাবি লোভ দেখালেন কাবাব আর শুঁটকি মাছের। রাহমান ভাইয়ের বাড়িতে বিনা নিমন্ত্রণের খাবারেও ছিল একটা শাহি ঘরানার ধাঁচ। দু-তিন প্রস্থ খাবার তো থাকতই। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার আর নবাববাড়ির খাবারের মিশেল ছিল রেসিপিতে, রন্ধনপ্রক্রিয়ায়। কতবার যে খেয়েছি রাহমান ভাইয়ের বাড়িতে এমন বিনা নিমন্ত্রণে! বাঙালির সংস্কৃতিতে ‘অতিথি নারায়ণ’কে যখন-তখন খাওয়ানোর যে রেওয়াজ ছিল, তারই ধারাবাহিকতা ছিল শামসুর রাহমানের বাড়িতে। এর ভেতর একটা আভিজাত্য, ঐতিহ্যময়তা ও উঠতি আধুনিক সৌজন্যেরও প্রকাশ ছিল। আসলে আমাদের প্রধান কবি দেখিয়ে দিয়ে গেছেন অনুজ কবিকে আপ্যায়ন করার উদার, দরাজদিল রকম-সকম। অনুজ কবিতাকর্মী বা সাহিত্যকর্মীর প্রতি এই সৌহার্দ্য ও আন্তরিকতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কবিতাকে যে কবিতাকর্মী আপাদমস্তক বহন করে ফিরছে, অন্তত কবির কাছে এই বার্তাটুকু মূল্যহীন নয়—তা কবিতাকর্মীর জানা প্রয়োজন। অনুজ কবিকে এই বার্তা জানিয়ে গেছেন শামসুর রাহমান। 

কত দিন কবি শামসুর রাহমান তাঁর সদ্য লেখা কবিতা হাতে নিয়ে অপার কৌতূহলে জানতে চেয়েছেন, সেটি কবিতা হয়েছে কি না! বাংলাদেশের প্রধান কবির কবিতা মূল্যায়ন করার আমি কে! নিশ্চয় সমসাময়িক আরও অনেকের কাছেই এই সরল ও আন্তরিক প্রশ্নটি করেছেন তিনি। লেখা নিষ্পন্ন হওয়ার পর নিজের লেখা নিয়ে এই সংশয় হয়তো সব লেখকেরই থাকতে পারে। লেখকমাত্রেরই এটি একটি আন্তরিক ও সৎ প্রশ্ন। 

রাহমান ভাইয়ের কবিতা কত দূর বুঝে উঠতে পেরেছি, তা আমি এখনো জানি না। কিন্তু আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি এ কারণে যে বাংলা ভাষার এই শ্রেষ্ঠ কবিকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল।