যখন বিজয় এল

দক্ষিণ এশিয়ার সুদীর্ঘ ইতিহাসে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের একমাত্র উদাহরণ বাংলাদেশ। রক্তসরোবর পেরিয়ে স্বাধীনতার স্বর্ণকমল প্রাপ্তির মাহেন্দ্রক্ষণে গোটা বাঙালি জাতি এক অভূতপূর্ব আবেগের সাক্ষী হলো। অরুণোদয়ের কয়েকজন অগ্নিসাক্ষীর বয়ানে সেই অসামান্য ক্ষণের বহুবর্ণিল প্রকাশ ঘটেছে বিজয়ের মুহূর্ত ১৯৭১ বইয়ে। মতিউর রহমানের কুশলী সম্পাদনায় এই বইয়ে ১৬ ডিসেম্বর সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করেছেন বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা, বয়সের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।

‘বিজয়ের সোনালি গল্প’ শীর্ষক মুখবন্ধে বলা হয়েছে, ‘আন্তরিক আবেগে যাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে চিহ্নিত করি, তাতে একাকার হয়ে আছে গণতন্ত্র, সাম্য, অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তি, মানবাধিকার ও বাঙালিত্বের ধারণা। রাষ্ট্রে ও সমাজে এসব চেতনা প্রতিষ্ঠা করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে একাত্ম হয়েছিল সব স্তরের মানুষ। অনেক ত্যাগ ও তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আসে বাঙালির আকাঙ্ক্ষিত বিজয়।’ সংকলিত স্মৃতিচারণমালায় মুক্তিযুদ্ধে সব স্তরের মানুষের একাত্ম হওয়ার প্রতিফলন স্পষ্ট। 

শহীদজননী জাহানারা ইমাম পুত্র রুমীকে রণাঙ্গনে পাঠিয়েছিলেন। বিজয় অর্জনের মাত্র তিন দিন আগে স্বামী শরীফ ইমাম হৃদ্​রোগে মৃত্যুবরণ করেন। দ্বৈত বিসর্জনকে বুকে চেপে তিনি স্বাগত জানিয়েছিলেন ষোলোই ডিসেম্বরকে, ‘একাত্তরের সেই বিজয় দিবসে আমার অনুভূতি-উপলব্ধির কথা আমি কখনোই অন্যদের মতো গুছিয়ে, জুতসই শব্দাবলি সাজিয়ে লিখতে পারব না।...বিরাট একটা শূন্যতার মধ্যে যেন বোধশূন্যহীন হয়ে ছিলাম। সন্ধ্যার পর যখন রুমীর কয়েকজন সহযোদ্ধা ২ নম্বর সেক্টরের মেঘলার ক্যাম্পের দুর্ধর্ষ বীর মেজর হায়দারের সঙ্গে আমাদের বাড়িতে এল আমার সঙ্গে দেখা করতে, কেবল তখনই যেন প্রাণ পেয়ে আমি জেগে উঠলাম। ওদের হাত ধরে ঘরের মাঝখানে টেনে এনে বললাম, “এসো বাবারা, বসো।”’

কবি শামসুর রাহমানের কাছে ১৬ ডিসেম্বর যুগপৎ আনন্দের ও বেদনার। বিজয়ের প্রাক্কালে ১৪ ডিসেম্বর নরঘাতকের দল হত্যা করে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। তাঁর অনুভূতি, ‘একই দিনে দুই ধরনের অভিজ্ঞতা। একটি অনির্বচনীয় আনন্দের, অন্যটি অব্যক্ত বেদনা। যখনই ১৬ ডিসেম্বর আসবে, তখনই আমার মনে পড়বে মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য অর্জনের কথা, আমার প্রিয়জনদের হত্যাকাণ্ডের কথা। আমি যুগপৎ আনন্দিত এবং বিষণ্ন হব।’

সম্মুখযোদ্ধা শামসুদ্দীন আহমদের স্মৃতিচারণায় বাঙ্​ময় হয়ে উঠেছে আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্য। বিজয়ের মুহূর্তে তাঁর আশাবাদ,‘আজ দেশ স্বাধীন। আর হারানোর কোনো ভয় নেই। আর কেউ ধর্মের পরিচয়ে, ভাষার পরিচয়ে, জাতিগত বৈশিষ্ট্যের পরিচয়ে নির্যাতিত-নিপীড়িত হবে না। উদ্বাস্তুদের দৃঢ় পদক্ষেপ ও আনন্দোল্লাস দেখে আমি আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ সম্বন্ধে অনেক আশাবাদী হয়েছিলাম।’

শহীদজায়া পান্না কায়সারের স্মৃতির ডালি আমাদের আক্ষেপকে শতগুণ বাড়িয়ে দেয়। সংবাদ–এর কৃতী সাংবাদিক, সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সার ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে উত্তেজনায় ছটফট করছিলেন সম্ভাব্য বিজয়ের আঁচ পেয়ে। স্বাধীনতা লাভের পর সংবাদ–এর হেডলাইনের জন্য কথা লিখে রেখেছিলেন। ফলে পান্না কায়সারের রক্তক্ষরণ আমাদের হৃদয়কেও দ্রবীভূত করে, ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেশ স্বাধীন হবে বলে যে মানুষটিকে সে রাতে রোমাঞ্চিত হতে দেখেছি, সেই মানুষটিই বুকের রক্ত দিয়ে স্বাধীন দেশের মাটি রাঙিয়ে গেল। উহ্, আমি এসব কথা ভাবতে চাই না। বড্ড কষ্ট হয়। ১৪ তারিখে কেন কারফিউ উঠল না। কারফিউ উঠলে তো সেদিন ও বাসা থেকে সরে যেত। আর সরে গেলে বিজয় দিবসের প্রথম প্রভাতকে স্বাগত জানাতে পারত। সংবাদ–এর হেডলাইন ওর মনের মতো করে সাজাতে পারত। কী আশ্চর্য! সংবাদ-এর হেডলাইন ওর করুণ পরিণতির খবর নিয়ে বের হলো।’

 ১৯৭১ সালে আবুল মাল আবদুল মুহিত ছিলেন আমেরিকায়। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে বহির্বিশ্বের আলোড়ন প্রত্যক্ষ করেছেন। মুজিবনগর সরকারের দূরদর্শিতা বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করে। স্বাধীনতাযুদ্ধে মুজিবনগর সরকার বিজয় নিয়েই শুধু ব্যস্ত ছিল না, তারা দেশ গঠনের বিষয়েও ছিল সচেতন। মুহিতের ভাষ্য, ‘এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পেছনে এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার উদ্যমে বঙ্গবন্ধুর পর যাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি তাজউদ্দীন আহমদ।’

তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা সিমিন হোসেন রিমি সেই উত্তাল মুহূর্তকে বাক্যবন্দী করেছেন এভাবে, ‘১৫ তারিখ সন্ধ্যায় শুনলাম পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ হবে ঢাকায়, আগামীকাল। সেই আগামীকাল এল। চরম পরাজয় মেনে নিল পাকিস্তান সরকার ও তার নরখাদক বাহিনী। পৃথিবীর সর্বোচ্চ গৌরবের বিজয়মুকুটে সজ্জিত হলো বাংলাদেশ।’

বইটির সম্পাদক মতিউর রহমানকে ধন্যবাদ, মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনাকে এক মলাটে উপস্থাপনের জন্য। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। আপামর জনসাধারণের ইস্পাতদৃঢ় ঐক্যে আমরা অর্জন করেছিলাম কাঙ্ক্ষিত বিজয়মুকুট। বিজয়ের মুহূর্ত ১৯৭১ এই সত্যেরই উজ্জ্বল স্মারক।