প্রত্যাখ্যাত নোবেল সাহিত্য পুরস্কার

>নোবেল সাহিত্য পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন দুই সাহিত্যিক। কেন, কোন প্রেক্ষাপটে তাঁদের এই প্রত্যাখ্যান? অন্তর্জালের বিভিন্ন সূত্র ঘেঁটে সেই গল্প জানাচ্ছেন আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির।
বরিস পাস্তের্নাক
বরিস পাস্তের্নাক

বরিস পাস্তের্নাক

সাহিত্য আর পুরস্কারের মধ্যেকার সম্পর্ক আদতে খুব জটিল। এ কথা সত্য যে সাহিত্য রচনার উদ্দেশ্য কোনো দিন কখনোই পুরস্কারপ্রাপ্তি হতে পারে না। সাহিত্যের আসল মহিমা অন্যখানে, এর নিজস্ব দ্যুতি। কিন্তু তাই বলে পুরস্কারের গুরুত্বকে খাটো করে দেখাও অসম্ভব। বিশেষত পুলিৎজার, ম্যান বুকার বা নোবেল পুরস্কারের ভূমিকা সাহিত্য, সাহিত্যিক বা পাঠকদের কাছে সব সময়ই প্রচণ্ড গুরুত্ব বহন করে। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তিকে এই পৃথিবীর মানুষ অসম্ভব সমীহের চোখে দেখে। কিছু কিছু সমালোচনা বা বিরূপ প্রতিক্রিয়া থাকলেও এই পুরস্কার এখন পর্যন্ত এই গ্রহের যেকোনো সাহিত্যিকের জন্য সর্বোচ্চ সম্মাননা বলে বিবেচিত। অথচ এমন দামি পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের মতো অবাক করা ঘটনাও ঘটেছে দুই দুইবার—১৯৫৮ আর ১৯৬৪ সালে। 

রাশিয়ার জনপ্রিয় কবি, ঔপন্যাসিক ও অনুবাদক বরিস পাস্তের্নাকের জন্ম মস্কোতে, ১৮৯০ সালে। মাই সিস্টার, লাইফ (১৯১৭) তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। তাঁর করা শেকস্​পিয়ারের অনুবাদ রুশ ভাষায় এখন পর্যন্ত অন্যতম শ্রেষ্ঠ। জীবনের শেষ ভাগে এসে লেখা উপন্যাস ডক্টর জিভাগো (১৯৫৭) রাশিয়ার সর্বকালের সর্বাধিক পঠিত বইগুলোর মধ্যে একটি। বইটি প্রকাশের পরের বছর ২৩ অক্টোবর তাঁকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করে সুইডিশ একাডেমি। পুরস্কারের সাইটেশনে লেখা হয় রুশ গীতিকাব্যে অবদান এবং রাশিয়ার মহাকাব্যিক ঐতিহ্যকে জারি রাখার কারণে তাঁকে এই পুরস্কার দ্বারা সম্মানিত করা হচ্ছে। 

এ ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই বেশ পুলকিত হন পাস্তের্নাক। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যথারীতি ২৫ অক্টোবর তিনি টেলিগ্রাম করেন সুইডিশ একাডেমিকে। কিন্তু এই পুরস্কারে তখনকার সোভিয়েত সরকার মোটেও খুশি ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধের সময় তখন। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঠান্ডা দ্বন্দ্ব চলছে ইউরোপ, আমেরিকার অধিকাংশ পুঁজিবাদী দেশগুলোর। আর নোবেল পুরস্কারকে সমাজতান্ত্রিক শাসকেরা বরাবরই দেখে এসেছেন পুঁজিবাদের প্রকাশ হিসেবে। ফলে ২৫ তারিখেই পাস্তের্নাকের পুরস্কারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়। ‘মস্কো লিটারেরি সোসাইটি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের দাবি তুলে স্বাক্ষর গ্রহণ কর্মসূচি শুরু করে। পাস্তের্নাক–বিরোধী আন্দোলন ও প্রচারণাও জমে ওঠে অতি দ্রুত; একপর্যায়ে তা অতিরিক্ত তিক্ততায় গিয়ে পৌঁছায়। পাস্তের্নাককে ‘রাষ্ট্রদোহী’, ‘শত্রুর সঙ্গে আঁতাতকারী’ ইত্যাদি বলে আক্রমণ করতে থাকেন উত্তপ্ত ছাত্র-জনতাসহ সোভিয়েতের বেশ কিছু বিশিষ্ট নাগরিক। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকে পরোক্ষভাবে তাঁকে জানানো হয়, একবার স্টকহোমে পুরস্কার আনতে গেলে আর কোনো দিন নিজ দেশে ফিরতে পারবেন না তিনি। এই বাস্তবতায় শেষমেশ হার মানেন রুশ লেখক, নোবেল কমিটিকে পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে তিনি চিঠি লিখতে বাধ্য হন একাডেমি বরাবর। বরিস পাস্তের্নাকের নোবেল–কাণ্ডের এখানেই ইতি।

জ্যঁ পল সার্ত্র । ছবি: সংগৃহীত
জ্যঁ পল সার্ত্র । ছবি: সংগৃহীত

জ্যঁ পল সার্ত্র 

এই ঘটনার কয়েক বছর পর ফ্রান্সে জন্ম নেওয়া জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক জ্যঁ পল সার্ত্র ১৯৬৪ সালে সাহিত্যে নোবেল প্রত্যাখ্যান করেন সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে এবং অন্য কারণে। সার্ত্র মূলত দার্শনিক হলেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নাটক, উপন্যাস ও ছোটগল্প লিখেছেন। আত্মজৈবনিক রচনা ও চিত্রনাট্যের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তাই তাঁকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান সাহিত্যিকদের একজন বলে বিবেচনা করা হয়। ১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাসে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার আগেই সার্ত্র জানতে পারেন ওই বছরের মনোনীত সাহিত্যিকদের তালিকায় তাঁর নাম আছে। জানার পরপরই চিঠি লিখে তিনি যোগাযোগের চেষ্টা করেন সুইডিশ একাডেমির সঙ্গে। কিন্তু তাঁর চিঠি গিয়ে পৌঁছানোর আগেই ঘোষিত হয় পুরস্কার। পুরস্কারপ্রাপ্তি ঠেকাতে না পেরে প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত নেন সার্ত্র। কমিটিকে নিজের অপারগতা জানান তিনি বেশ বিনয়ের সঙ্গে। নোবেল কমিটি বা পুরস্কারকে কোনোরূপ দোষারোপ না করে এই প্রত্যাখ্যানকে একেবারেই ‘ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত’ বলে দাবি করেন তিনি। কিন্তু অনেকে এমন বলেন যে সার্ত্রর এই প্রত্যাখ্যানের নেপথ্যে আছে তাঁর আগে আলবেয়ার কামুর নোবেল পুরস্কার লাভ। কামু পুরস্কারটি পেয়েছিলেন ১৯৫৭ সালে এবং খবরটি পাওয়ার পর খুব উচ্ছসিত হয়ে নোবেল কমিটিকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন তিনি। সার্ত্র আর কামুর মধ্যে সম্পর্ক তত দিনে বেশ তিক্ত ও প্রতিদ্বন্দ্বীসুলভ। আগে পুরস্কার পেয়ে কামু​ এগিয়ে গেলেও কয়েক বছর পর ওই একই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে সার্ত্র হয়তো বোঝাতে চেয়েছিলেন নোবেল প্রাপ্তি আদতে তেমন মহান কিছু নয়। 

২২ অক্টোবর সুইডিশ ও ২৩ অক্টোবর ফরাসি পত্রিকায় ছাপা হয় তাঁর প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা। এখানে দীর্ঘ বিবৃতিতে তিনি ব্যাখ্যা করেন পুরস্কার গ্রহণে নিজের অনীহার কারণ: 

 ‘আমি ১৯৪৫ সালের পর থেকে সব ধরনের অফিশিয়াল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে আসছি…আমি জ্যঁ পল সার্ত্র লিখে স্বাক্ষর করা আর নোবেলজয়ী জ্যঁ পল সার্ত্র লিখে স্বাক্ষর করা এক নয়। একজন লেখক যখন এই ধরনের কোনো পুরস্কার গ্রহণ করেন, তিনি আদতে পুরস্কার প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।’ 

গত শতাব্দীর সাহিত্য আর পুরস্কারের ইতিহাসের এই দুই বিস্ময়কর ঘটনা পুরস্কার আর সাহিত্যের জটিল সম্পর্ককে আরও জটিলভাবে দেখতে শেখায়। ‘মহান সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি মহান পুরস্কার’—এই ধরনের সহজ, চিরাচরিত সমীকরণ অনেক ক্ষেত্রেই খাটে না। পাস্তের্নাকের পুরস্কার নিয়ে রাষ্ট্র্, সরকার বা গোষ্ঠীর অস্বস্তি আর ক্ষোভ প্রমাণ করে অনেক সময় পুরস্কারের রং হয় রাজনৈতিক। আবার সার্ত্রর ঘটনা প্রমাণ করে লেখকের ইচ্ছা, অনিচ্ছারও গুরুত্ব প্রবল। হয়তো সার্ত্রও মতাদর্শের ভিন্নতার কারণেই প্রত্যাখ্যান করেছেন নোবেল পুরস্কার, হয়তো সার্ত্র এই ব্যক্তিগত মতামতকে আসলে বৈশ্বিক প্রতিবাদ হিসেবেই তুলে ধরতে চেয়েছেন। তারপরেও পুরস্কার গ্রহণে অনীহার এই উদাহরণ মূলত ব্যক্তিস্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠান, সমাজ আর স্বীকৃতির ঊর্ধ্বে তুলে ধরে অপূর্ব মহিমায়। এর ফলে এত বড় পুরস্কার হয়তো গুরুত্ব হারায় না, কিন্তু ব্যক্তিস্বকীয়তার গুরুত্ব বাড়ে বৈকি। 

পুরস্কার গ্রহণ আর বর্জনের এই দ্বান্দ্বিক আলোচনা অবশেষে একটা বড় প্রশ্নের জন্ম দিল—পুরস্কার বর্জন কি শুধুই প্রতিবাদ বা অপারগতা, নাকি অনেক সময় গ্রহণের চেয়ে বর্জনে সম্মান বা খ্যাতি বাড়ে? উত্তর যা–ই হোক, গ্রহণের অজস্র গল্পের মধ্যে বর্জনের গল্প সংখ্যায় অনেক অনেক কম। অন্তত এই কারণেই সাধারণ মানুষ ও পুরস্কারপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বর্জনকারী ব্যক্তিকে মনে রাখতে বাধ্য হয়। পাস্তের্নাক আর সার্ত্রর সঙ্গে নোবেল পুরস্কারের সম্পর্ক তাই হয়তো গ্রহণকারী লেখকদের চেয়েও বেশি গভীর আর দীর্ঘস্থায়ী। 

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, নিউইয়র্ক রিভিউ, স্পিগল অনলাইন ও নোবেল প্রাইজডটঅর্গ