ফ্যাসিবাদ, সাহিত্য, নোবেল

>সাহিত্যে নোবেলজয়ীদের নাম ঘোষিত হয়েছে ১০ অক্টোবর। গত বছর নানা বিতর্কের জেরে সুইডিশ একাডেমি শেষমেশ পুরস্কারই ঘোষণা করেনি। এ বছরের ঘোষণা থেকে আবার জন্ম নিয়েছে নতুন বিতর্ক। অভিযোগ গুরুতর—এবারের বিজয়ী পিটার হান্ডকে ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করেছেন! একই অভিযোগ নানা সময়ে উঠেছিল আরও কয়েকজন বড় সাহিত্যিকের বিরুদ্ধে। কী আশ্চর্য, তাঁদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের নামটাও! 
‘বলকান কসাই’ স্লোবোদান মিলোসেভিচের শেষকৃত্যে এ বছরের নোবেলজয়ী সাহিত্যিক পিটার হান্ডকে, ২০০৬
‘বলকান কসাই’ স্লোবোদান মিলোসেভিচের শেষকৃত্যে এ বছরের নোবেলজয়ী সাহিত্যিক পিটার হান্ডকে, ২০০৬

পিটার হান্ডকে

বছর পাঁচেক আগে অস্ট্রিয়ার সাহিত্যিক পিটার হান্ডকে বলেছিলেন, নোবেল তাঁর কাছে একেবারেই ‘মূল্যহীন’। এই পুরস্কার দেওয়া আসলে বন্ধ করা উচিত। আর সুইডিশ একাডেমি কিনা এবার তাঁকেই নোবেল দিল! নতুন বিতর্কের কারণ অবশ্য ২০১৪ সালের মন্তব্যটি নয়। হান্ডকের সাহিত্যিক যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। উঠেছে বসনিয়ার গণহত্যা নিয়ে তাঁর ঘোলাটে পূর্ব-অবস্থান নিয়ে। হান্ডকে অভিযুক্ত হয়েছিলেন ‘জেনোসাইড ডিনায়ার’ হিসেবে।

বলকান রাষ্ট্রগুলোর রক্তাক্ত সেই অধ্যায়ের সূত্রপাত আরও আগে। ১৯৮০ সালে যুগোস্লাভিয়ার নেতা মার্শাল টিটোর মৃত্যুর পর দেশটি কয়েক ভাগ হয়ে যায়। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে জন্ম নেয় সার্বিয়া, বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া, মেসেডোনিয়া নামের দেশগুলো। 

সার্বিয়া ছাড়া ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়ায় সার্ব জাতিগোষ্ঠীর কিছু মানুষ ছিল। সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট স্লোবোদান মিলোসেভিচের উদ্দেশ্য ছিল বৃহত্তর সার্ব রাষ্ট্র গঠন করা। তিনি দুই দেশের সার্ব বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ দিতে থাকেন। রক্তক্ষয়ী সংঘাতে মারা যায় হাজার হাজার মানুষ। মিলোসেভিচ পরিচিতি পান ‘বলকান কসাই’ হিসেবে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপে এত রক্ত আর কখনো ঝরেনি। বসনিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল সারায়েভো ও স্রেব্রেনিৎসায় সার্ব-বাহিনী ১৮ হাজার নিরীহ মুসলিমকে হত্যা করে। মিলোসেভিচ এবং গণহত্যার অন্য দুই নেতা রাদোভান কারাদজিচ ও রাতকো ম্লাদিচের পক্ষে মুখ খোলেন হান্ডকে। বলেন, গণহত্যা নয়, মুসলিমরাই নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করেছে! পরে হান্ডকে বলেছেন, কথাটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল। 

মিলোসেভিচের পক্ষ নিয়ে হান্ডকে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে সাক্ষ্য দিতে চেয়েছিলেন। ২০০৬ সালে মিলোসেভিচের মৃত্যুর পর শেষকৃত্যে তিনি বক্তৃতাও দেন। হান্ডকের এমন অবস্থানে প্রতিবাদ করেছিলেন স্লাভয় জিজেক, সুজান সনটাগ, সালমান রুশদির মতো পণ্ডিত ও সাহিত্যিকেরা। এবার তাঁকে নোবেল দেওয়ার পর সাহিত্যসমাজের সঙ্গে প্রতিবাদ করছেন গণহত্যায় বেঁচে যাওয়া মানুষেরা। 

সুইডিশ একাডেমি বলছে, হান্ডকে একসময় উল্টোপাল্টা বক্তব্য দিলেও তাঁর দুটি বই (দ্য গোলি’স এনজাইটি অ্যাট দ্য পেনাল্টি কিক ও স্লো হোমকামিং) স্রেব্রেনিকা গণহত্যার নিন্দা করেছে। মানুষের সাম্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, এমন কিছু একাডেমি তাঁর লেখালেখিতে পায়নি। 

তা বলে প্রতিবাদ থামছে না। পিটার হান্ডকে প্রথম নন। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে কয়েকজন বড় সাহিত্যিক নানা সময়ে ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠীর প্রশংসা করেছিলেন। কেউ কেউ সরাসরি পক্ষ নিয়েছিলেন। এও িঠক, তাঁদের অবদানের কথা বিশ্বসাহিত্য অস্বীকার করতে পারে না। তাঁদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নোবেল সাহিত্য পুরস্কারও। 

ফরাসি সাহিত্যিক রোম্যাঁ রোল্যাঁই রবীন্দ্রনাথকে মুসোলিনির ইতালির সত্যটা জানান, ১৯২৬
ফরাসি সাহিত্যিক রোম্যাঁ রোল্যাঁই রবীন্দ্রনাথকে মুসোলিনির ইতালির সত্যটা জানান, ১৯২৬

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৯১৩ সালের সাহিত্যে নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথের জীবনে এ এক বিব্রতকর অধ্যায়। পরবর্তীকালে তিনি ইতালির ফ্যাসিবাদী শাসক বেনিতো মুসোলিনির প্রশংসা করেছিলেন। এটা কী করে সম্ভব হয়েছিল? 

১৯২৫ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রথম ইতালিতে যান। মিলানে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় সংস্কৃত ভাষা-সাহিত্যের পণ্ডিত কার্লো ফরমিচির সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আমন্ত্রণ জানান। ফরমিচি কথা দেন, তিনি ইতালির শিল্প-সাহিত্যবিষয়ক বইপত্র নিয়ে আসবেন। কিন্তু সাংস্কৃতিক বিনিময়টির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে ব্যর্থ হন ফরমিচি। রবীন্দ্রনাথকে দেওয়া কথা রাখতে অতঃপর তিনি সরাসরি চিঠি লেখেন মুসোলিনিকে। তখনই রবীন্দ্রনাথের বৈশ্বিক সুনাম কাজে লাগানোর কথা মাথায় আসে মুসোলিনির। এক বছরের খরচসহ ফরমিচি, আরেক পণ্ডিত জুসেপ্পে তুচ্চির সঙ্গে মুসোলিনি পাঠিয়ে দেন জাহাজভর্তি বই! 

মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ মুসোলিনির টোপ গিলে ফেলেন। ৩০ মে ১৯২৬ দ্বিতীয়বার ইতালি যান তিনি। পরদিনই ফরমিচিসহ সাক্ষাৎ করতে যান মুসোলিনির সঙ্গে। মুসোলিনি শুরুতেই বলেন, ইতালীয় ভাষায় অনূদিত রবীন্দ্রনাথের সব লেখা তিনি পড়েছেন। রবীন্দ্রনাথ খুশি হয়ে যান। মুসোলিনির চাল বুঝতে পারেন না। 

পরের দুই সপ্তাহে রবীন্দ্রনাথ ইতালির রাজাসহ রোমের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করেন। পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেন। দেন কয়েকটি বক্তৃতাও। একটিতে মুসোলিনি উপস্থিত ছিলেন। 

সফরের শেষ দিকে ১৩ জুন রবীন্দ্রনাথ আবার দেখা করেন মুসোলিনির সঙ্গে। আতিথেয়তায় জন্য ধন্যবাদ জানান। এ সময় মুসোলিনি তাঁকে আধুনিক রোম তৈরির পরিকল্পনা দেখান। একপর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ দার্শনিক বেনেদেত্তো ক্রোচের সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছা জানান। মুসোলিনিবিরোধী ক্রোচের কথা উঠতেই উপস্থিত ফরমিচি আপত্তি করেন, কিন্তু চতুর মুসোলিনি তাঁকে থামিয়ে দেন। সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে বলেন। ক্রোচের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎটি হয়ও, তবে মুসোলিনি বাহিনীর কড়া পাহারায়। সেখানে ক্রোচে তেমন কোনো কথাই বলেননি। 

এরপর রবীন্দ্রনাথ যান সুইজারল্যান্ডে। সেখানে আতিথ্য নেন ফরাসি সাহিত্যিক রোম্যাঁ রোল্যাঁর। তাঁর কাছেই রবীন্দ্রনাথ মুসোলিনির আসল সত্য জানতে পারেন। জানতে পারেন ইতালীয় পত্রপত্রিকায় তাঁর কথা বিকৃত আকারে এসেছে। গোটা ইউরোপে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটা ভুল বার্তা চলে গেছে। 

রোল্যাঁর জোরাজুরিতে ৮ আগস্ট রবীন্দ্রনাথ ইতালি সফর ও সেখানে দেওয়া সাক্ষাৎকারের ব্যাখ্যা দিয়ে দীর্ঘ একটি চিঠি লেখেন, ভারতে অবস্থানরত ব্রিটিশ অনুরাগী চার্লস অ্যান্ড্রুজকে। চিঠিটি ছাপা হয় তখনকার ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান পত্রিকায়। পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিবাদসহ সব ধরনের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রবল বিরোধিতা করেছেন। 

হিটলারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন নরওয়ের নোবেলজয়ী সাহিত্যিক নুট হামসুন (মধ্যে), ১৯৪৩
হিটলারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন নরওয়ের নোবেলজয়ী সাহিত্যিক নুট হামসুন (মধ্যে), ১৯৪৩

নুট হামসুন

১৯২০ সালে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন এই নরওয়েজীয় সাহিত্যিক। ২৫ বছর পর আডলফ হিটলারের মৃত্যুতে শোকবার্তা লিখেছিলেন, ‘হিটলার ছিলেন মানবজাতির যোদ্ধা। সব জাতির জন্য ন্যায়বিচারের বার্তা প্রচারক।’ এতে হামসুন নিজেকে ‘হিটলারের ঘনিষ্ঠ অনুসারীদের একজন’ পরিচয় দিয়েছিলেন। 

দ্বিতীয় বোয়ার যুদ্ধের (১৮৯৯-১৯০২) পর থেকেই মূলত হামসুন ব্রিটিশবিরোধী অবস্থান নেন। দক্ষিণ আফ্রিকার স্বর্ণখনির দখল পেতে ব্রিটিশরা স্থানীয় বোয়ারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। ব্রিটিশরা জয়ী হয়। বোয়ারদের জন্য তৈরি হয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। যুদ্ধের কারণে ৪৬ হাজার বোয়ার মৃত্যুবরণ করে, বেশির ভাগই ছিল শিশু। 

ব্রিটিশদের এই আগ্রাসী যুদ্ধের পর থেকেই হামসুন আরও কট্টরপন্থী হয়ে ওঠেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিও তাঁর মনোভাব বিরূপ ছিল। ক্রমে তিনি জার্মানি ও জার্মান সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হামসুন জার্মানির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জার্মানি নরওয়ের দখল নিয়ে নেয়। হামসুন জার্মানির পক্ষে লেখালেখি করতে থাকেন। তত দিনে ৮০ পেরিয়েছেন, কানে তেমন কিছুই শুনতে পান না। খবর পেতেন কট্টরপন্থী পত্রপত্রিকা থেকে। 

একসময় আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে হামসুন তাঁর নোবেল পদকটি হিটলারের প্রচারণামন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলসকে পাঠিয়ে দেন। সঙ্গে নোবেলের কিছু অর্থও। শিগগিরই হিটলারের দরবারে ডাক পড়ে তাঁর। ১৯৪৩ সালের জুনে হামসুন দেখা করতে যান। ৪৫ মিনিটের সেই অভিজ্ঞতা তাঁর জন্য মোটেই সুখকর ছিল না। 

হিটলারের কাছে নরওয়েতে জার্মানির বেসামরিক প্রশাসক জোসেফ ট্যারবোভেনের ব্যাপারে নালিশ করেন হামসুন। অনুরোধ করেন, ট্যারবোভেন যে নরওয়েবাসীকে জেলে পুরেছেন, তাদের ছেড়ে দিতে। এ কথায় হিটলার এতটাই রেগে যান যে শান্ত হতে সময় নিয়েছিলেন তিন দিন! হামসুনও দুঃখ পেয়েছিলেন খুব। 

তবু হিটলারের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর ৮৬ বছরের হামসুন শোকবার্তাটি লিখেছিলেন। যুদ্ধ শেষে উত্তেজিত জনতা নরওয়ের বিভিন্ন শহরে হামসুনের বই পুড়িয়েছিল। বিচারের আগে হামসুনের মানসিক সুস্থতার পরীক্ষা করা হয়। তাতে ‘অসুস্থ’ প্রতীয়মান হওয়ায় বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনা হয় না তাঁর প্রতি। নাগরিক দায়ের আরেকটি মামলায় হামসুনকে বড় অঙ্কের জরিমানা দিতে হয়। 

বিতর্ক আছে, হামসুন আসলেই অসুস্থ ছিলেন কি না। বিচারের পর ১৯৪৯ সালে তাঁর শেষ যে বইটি প্রকাশিত হয়, সেখানে ডাক্তার ও বিচারকদের বেশ গালমন্দ করেছিলেন। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালিতে মুসোলিনির পক্ষে প্রচারণা লিখছেন মার্কিন সাহিত্যিক এজরা পাউন্ড, ১৯৪০
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালিতে মুসোলিনির পক্ষে প্রচারণা লিখছেন মার্কিন সাহিত্যিক এজরা পাউন্ড, ১৯৪০

এজরা পাউন্ড

গত শতাব্দীর অন্যতম সেরা কবি তিনি। মার্কিন সাহিত্যিক পাউন্ডকে বলা হয় ‘কবিদের কবি’। বিশ শতকের প্রথম দিকে ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে আমেরিকার বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকীর বিদেশ সম্পাদক ছিলেন। তাঁর সম্পাদনায় ছাপা হয়েছে টি এস এলিয়ট, জেমস জয়েস, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, রবার্ট ফ্রস্ট, ডব্লিউ বি ইয়েটসের লেখা। 

বহু সাহিত্যিককে উৎসাহিত করেছেন পাউন্ড। বন্ধুদের মধ্যে ইয়েটস, এলিয়ট, হেমিংওয়ে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন। পাউন্ড পাননি। কারণটা সম্ভবত মুসোলিনির পক্ষে তাঁর সক্রিয়ভাবে কাজ করা। 

সম্পাদকজীবনে পাউন্ড সাহিত্য নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। রাজনীতি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পাউন্ড গ্রেট ব্রিটেনের প্রতি আস্থা হারান। যুদ্ধটিকে পুঁজিবাদী চক্রান্ত হিসেবে দেখতে শুরু করেন। ক্রমে দক্ষিণপন্থী মতাদর্শের দিকে ঝুঁকতে থাকেন তিনি। 

 ১৯২৪ সালে পাউন্ড ইতালি চলে যান। ১৯৩০ ও ৪০ দশকজুড়ে তিনি মুসোলিনির পক্ষে সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন কাজ করেন। হিটলারকে সমর্থন দেন, তাঁর আত্মজীবনীর প্রশংসা করেন। ব্রিটিশ ফ্যাসিবাদী রাজনীতিক অসওয়াল্ড মুসলের প্রকাশনার জন্য লেখেন। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মুসোলিনির পক্ষে পাউন্ড অনেক রেডিও প্রচারণা তৈরি করেন। এগুলো ছিল মিত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে ঘৃণায় ভরা। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টকে ফাঁসিতে ঝোলানোর কথাও বলেন তিনি। দিনের পর দিন পাউন্ড রেডিওতে ইহুদিদের বিরুদ্ধে চরম বিষোদ্গার, প্রচারণা চালিয়ে যান। 

যুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালে ইতালিতে মার্কিন বাহিনী পাউন্ডকে গ্রেপ্তার করে। পিসার সামরিক ক্যাম্পে কয়েক মাস আটকে রাখা হয়। তিন সপ্তাহ ছিলেন ৬ ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থের লোহার খাঁচায়, খোলা আকাশের নিচে। এরপর তাঁর ভেতর মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ দেখা দেয়। পরের বছর বিচারক তাঁকে অসমর্থ ঘোষণা করেন। প্রায় ১৩ বছর যুক্তরাষ্ট্রের একটি মানসিক হাসপাতালে থেকে মুক্তি পান পাউন্ড। 

হামসুনের মতো পাউন্ডের মানসিক অসুস্থতা নিয়েও সন্দেহ আছে। বলা হয়, পাউন্ডকে বাঁচাতে তাঁর আইনজীবী আদালতে তাঁকে মানসিকভাবে অসুস্থ বলেছিলেন। বিচারক মাত্র চার মিনিটে তাঁর অসুস্থতা ঘোষণা করেন। হাসপাতালে পাউন্ডের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন তাঁর সাহিত্যিক বন্ধুরা। তরুণ সাহিত্যিকেরা এসে সাহিত্য আলোচনাতেও যোগ দিতেন। 

বিচার হলে পাউন্ডের ফাঁসির সাজা হতে পারত। একই ধরনের অপরাধে অন্যদের ক্ষেত্রে এমন নজির আছে। বিচার ও মুক্তিপ্রক্রিয়ায় অনেকে পাউন্ডের সাহিত্যিক বন্ধুদের প্রভাব দেখেন। এলিয়ট, হেমিংওয়েসহ কয়েকজন নানা সময় তাঁর পক্ষে কথা বলেন। 

চিলির একনায়ক অগাস্তো পিনোশের সঙ্গে আর্জেন্টিনার সাহিত্যিক হোর্হে লুই বোর্হেস, ১৯৭৬
চিলির একনায়ক অগাস্তো পিনোশের সঙ্গে আর্জেন্টিনার সাহিত্যিক হোর্হে লুই বোর্হেস, ১৯৭৬

হোর্হে লুই বোর্হেস

বোর্হেসের রাজনৈতিক অবস্থান গোলমেলে। একদিকে জার্মানির অ্যাডলফ হিটলারের বিরোধিতা করেছেন, অন্যদিকে প্রশংসা করেছেন চিলির অগাস্তো পিনোশে, স্পেনের ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো, আর্জেন্টিনার হোর্হে রাফায়েল ভিদেলার। 

বোর্হেসের দেশ আর্জেন্টিনা দীর্ঘ সময় ধরে সেনাশাসনের অধীনে ছিল। ১৯২০ ও ৩০-এর দশকে বোর্হেস গণতান্ত্রিক রাজনীতির সমর্থন করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদী হিটলারের বিরোধিতা করেন। ১৯৪৬ সালে আর্জেন্টিনার ক্ষমতায় আসেন স্বৈরশাসক হুয়ান পেরন। এ সময় বোর্হেসকে গ্রন্থাগারের সরকারি চাকরি থেকে পোলট্রি ও খরগোশ খামারের পরিদর্শক হিসেবে বদলি করা হয়। তিনি চরমভাবে অপমানিত বোধ করেন। 

পেরন শাসনের িবরোধিতায় আর্জেন্টিনার কমিউনিস্ট পার্টির দোদুল্যমানতা দেখে বোর্হেস কমিউনিজমের প্রতিও আস্থা হারিয়ে ফেলেন। ১৯৭৬ সালে পেরনের স্ত্রী ইসাবেলের সরকারকে উৎখাত করে জেনারেল ভিদেলার নেতৃত্বে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে। বোর্হেস এতে সমর্থন দেন। ভিদেলার আমন্ত্রণে দেখা করতে গিয়ে আর্জেন্টিনাকে পেরনের প্রভাবমুক্ত করার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানান। 

একই বছর বোর্হেস পিনোশের আমন্ত্রণে একটি পুরস্কার নিতে চিলিতে যান। অনেকে নিষেধ করেছিলেন, বোর্হেস শোনেননি। কথিত আছে, নোবেল কমিটি থেকেও অনুরোধ এসেছিল। 

পিনোশের সঙ্গে দেখা করে তাঁর প্রশংসা করেছিলেন বোর্হেস। বলেছিলেন, আর্জেন্টিনা, চিলিতে অরাজকতার অবসান হয়েছে। অঞ্চলটিকে কমিউনিজমও কখনো গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। বোর্হেস বলেছিলেন, গণতন্ত্রে তাঁর আর আস্থা নেই। অন্য দেশের জন্য ভালো হলেও হতে পারে, কিন্তু চিলি বা আর্জেন্টিনায় এটি কার্যকর কোনো পদ্ধতি নয়। 

পিনোশে ক্ষমতায় এসেছিলেন নির্বাচিত নেতা সালভাদর আয়েন্দেকে হত্যা করে। ধারণা করা হয়, পিনোশের নীতির সমর্থনের দায়ে বোর্হেস সাহিত্যে নোবেল পাননি। অনেকে বলেন, বোর্হেসকে ভুল বোঝা হয়েছিল। সেনাশাসনে তিনি দুই দেশের পরিস্থিতির উন্নতির আশা করেছিলেন। বলা বাহুল্য, এই আশা অচিরেই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল।