প্রচ্ছদশিল্পী জয়নুল

>জয়নুল আবেদিন—আমাদের শিল্পাচার্য, বিখ্যাত চিত্রকর। এর বাইরে তাঁর আরেকটি পরিচয়—অনন্য প্রচ্ছদকার তিনি। তবে কালের আবর্তে এখন ঢাকা পড়ে গেছে জয়নুলের আঁকা মনোহর সব প্রচ্ছদপট। শিল্পাচার্যের রং-রেখায় আঁকা প্রচ্ছদের সেই অনিন্দ্যভুবনের উন্মোচন থাকছে এই সংখ্যায়। 
জয়নুল আবেদিন (২৯ ডিসেম্বর ১৯১৪—২৮ মে ১৯৭৬)
জয়নুল আবেদিন (২৯ ডিসেম্বর ১৯১৪—২৮ মে ১৯৭৬)

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন (১৯১৪–১৯৭৫) এক অসামান্য চিত্রকর, এ কথা এখন আর প্রমাণ দাখিল করে বলার দরকার হয় না। শুধু নিজের আঁকাআঁকি নয়, বাংলাদেশের চিত্রকলা ও চিত্রকলাচর্চা আজ যে অবস্থানে এসে পৌঁছেছে, তার পেছনে এই শিল্পীর রয়েছে অতুলনীয় অবদান।

বাংলাদেশের প্রচ্ছদশিল্পের ইতিহাসেও জয়নুল আবেদিনের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। কেননা, প্রচ্ছদকে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করার যে প্রচেষ্টা জয়নুল গত শতাব্দীর সেই ত্রিশ-চল্লিশের দশকে নিয়েছিলেন, তার পরম্পরায় দিনে দিনে ফুলে-পুষ্পে বিকশিত হয়ে আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের প্রচ্ছদশিল্প।

বিশ শতকের তৃতীয়-চতুর্থ দশকে কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা বইয়ের প্রকাশনার জগতে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে পথিকৃৎ প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন কাজী আবুল কাশেম (১৯১৩–২০০৪)। তাঁর পরে এলেন কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলের দুই ছাত্র জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসান (১৯২১–১৯৮৮)। তাঁরা কেবল প্রচ্ছদপটের মধ্যে নিজেদের সীমিত রাখেননি, দুজনে অলংকরণের কাজেও নিয়োজিত ছিলেন।

কাজী আবুল কাশেম প্রকাশকদের চাহিদা অনুযায়ী বাণিজ্যিক কাজ করেও শিল্পীর খ্যাতি অর্জনে সমর্থ হয়েছিলেন। পরবর্তী দুজন—জয়নুল ও তাঁর শিষ্য কামরুল প্রচ্ছদচিত্র রচনায় নিজেদের সৃজনক্ষমতার স্বাক্ষর রাখলেন।

জয়নুল আবেদিনের আঁকা বইয়ের প্রচ্ছদ
জয়নুল আবেদিনের আঁকা বইয়ের প্রচ্ছদ

বই প্রকাশনাশিল্প মূলত বাণিজ্যিক হলেও জয়নুল ও কামরুল এবং তাঁদের উত্তরসূরি কাইয়ুম চৌধুরী (১৯৩২–২০১৪) প্রমুখ প্রচ্ছদশিল্পে ‘কমার্শিয়াল আর্ট’-এর সঙ্গে ‘ফাইন আর্ট’-এর সমন্বয় সাধনে ব্রতী হয়েছিলেন এবং সাফল্য অর্জনেও সক্ষম হয়েছিলেন।

জয়নুলের প্রচ্ছদ আঁকার প্রধান প্রণোদনা অর্থনৈতিক হলেও বইয়ের মলাটচিত্র নির্মাণে বন্ধু-স্বজনদের অনুরোধ-উপরোধও সমান কার্যকর ছিল।

পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের পূর্বাপর জয়নুল তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন। উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি, ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি তিনি প্রথম বইটির মলাটচিত্র আঁকেন, সেটি ছিল আবুল কালাম শামসুদ্দীনের পোড়ো জমি।

১৯৪৩ সালের ‘দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা’ আঁকার এক যুগ আগে জয়নুল আবেদিন মাসিক মোহাম্মদীর (১৩৪০) রচনার অলংকরণ করেছিলেন। সে বছর সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন (১৮৯৭-১৯৭৮) কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিলেন জয়নুলকে। শামসুদ্দীন (পরে আজাদ সম্পাদক ও ১৯৫২ সালে প্রথম শহীদ মিনারের উদ্বোধক) তখন মাসিক মোহাম্মদীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। আর্ট কলেজের শিক্ষার্থী জয়নুলকে সে সময় কলকাতায় নিজের পড়ালেখার খরচ চালানো ছাড়াও বাড়িতে আর্থিক সাহায্য করতে হতো ভাইদের পড়াশোনার জন্য। তাই বাড়তি রোজগারের জন্য এ সময় মোহাম্মদী পত্রিকায় অলংকরণের কাজ করতেন তিনি।

অলংকরণ ছাড়াও বন্ধু-স্বজনদের উপরোধে এ সময় কয়েকটি বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকেন তিনি। 

এসব পত্রিকার জন্য প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন জয়নুল
এসব পত্রিকার জন্য প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন জয়নুল

জয়নুলের আঁকা সব বইপত্রের প্রচ্ছদের হদিস এখন আর পাওয়া যায় না। যেমন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু ও ফররুখ আহমদের সাত সাগরের মাঝি—জয়নুল অঙ্কিত এই দুটি বিখ্যাত বইয়ের প্রচ্ছদ বর্তমানে লুপ্ত।

দেশভাগের পর থেকে বিস্তর প্রচ্ছদ এঁকেছেন জয়নুল। এর মধ্যে রয়েছে কবি জসীমউদ্​দীনের একাধিক বইয়ের প্রচ্ছদ। তৎকালের বিভিন্ন বইপত্র ও সেই সময়ের বিভিন্নজনের সাক্ষাৎকারের সূত্রে এই কৃতী শিল্পীর যেসব বইয়ের প্রচ্ছদের হদিস পাওয়া যায়, সেগুলোকে সালওয়ারি নিম্নরূপে বিন্যস্ত করা যেতে পারে: আবুল কালাম শামসুদ্দীনের পোড়ো জমি (১৯৩৫) দ্বিতীয় খণ্ড, জসীমউদ্​দীনের রঙ্গীলা নায়ের মাঝি (১৯৩৫), ফররুখ আহমদের সাত সাগরের মাঝি (১৯৪৪) প্রথম সংস্করণ, আহসান হাবীবের রাত্রিশেষ (১৯৪৫), আবুল মনসুর আহমদের ফুড কনফারেন্স (১৯৪৭), কল্যাণী দত্তের ছোটদের সচিত্র কৃত্তিবাস (১৯৪৭), আবু জাফর শামসুদ্দীনের পরিত্যক্ত স্বামী (১৯৪৭) ও মুক্তি (১৯৪৮), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু (১৯৪৮), জসীমউদ্​দীনের পদ্মাপার (১৯৫০), নকসী কাঁথার মাঠ (১৯৫১) দ্বিতীয় সংস্করণ, মাটির কান্না (১৯৫১), বেদের মেয়ে (১৯৫২), গাঙের পাড় (১৯৫৪), সলিমুল্লাহ হল বার্ষিকী (১৯৫৩-৫৫), শামসুদ্দীন আবুল কালামের কাশবনের কন্যা (১৯৫৫), জসীমউদ্​দীনের পল্লীবধূ (১৯৫৬), সিকান্​দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল (আগস্ট ১৯৬৫), এখলাস উদ্দিন আহমদ সম্পাদিত ছড়ায় ছড়ায় ছন্দ (১৯৬৫), ভূঁইয়া ইকবাল সম্পাদিত পূর্বলেখ (১৯৬৬), মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর সম্পাদিত বিদ্রোহ আজ বিপ্লব চারিদিকে (১৯৭১), লেখক সংগ্রাম শিবিরের হে স্বদেশ (১৯৭২) ৩ খণ্ড, এখলাস উদ্দিন আহমদ সম্পাদিত টাপুর টুপুর (২ সংখ্যা—ফেব্রুয়ারি-মার্চ এবং মার্চ-এপ্রিল ১৯৭২), আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত লোকসািহত্য পত্রিকা (১৯৭২) মুহম্মদ মনসুরউদ্দীনের হারামণি (২য় খণ্ড) ও গোলাম সারোয়ারের পরীবানু (শেষ দুটি বইয়ের সাল জানা যায় না)।

এই তালিকার বাইরেও নিঃসন্দেহে জয়নুল আবেদিনের আঁকা আরও অনেক প্রচ্ছদ রয়েছে। তিনি যে সময় প্রচ্ছদ আঁকায় সক্রিয় ছিলেন, সে সময় আমাদের মধ্যে সংরক্ষণ করার প্রবণতা তেমনভাবে ছিল না ( প্রবণতাটি এখনো সেভাবে নেই), ফলে আগেই বলেছি, সংগত কারণেই জয়নুলের অনেক প্রচ্ছদের খবর এখন আর পাওয়া যায় না, জাতি হিসেবে আমাদের জন্য এটি বড় এক আফসোসের কারণ হয়েই থাকবে।

জয়নুল কেবল প্রচ্ছদই অঙ্কন করেননি, তাঁর প্রচ্ছদকৃত বইয়ের কোনো কোনোটি এই শিল্পীর অলংকরণেও শোভিত হয়েছে। এখানে সংযুক্ত তালিকার মধ্যে শামসুদ্দীন আবুল কালামের উপন্যাস কাশবনের কন্যা ও কল্যাণী দত্তের ছোটদের সচিত্র কৃত্তিবাস-এর অলংকরণও করেছেন তিনি।

এর বাইরে দৈনিক আজাদ, মিল্লাত ইত্যাদি পত্রিকায় গল্প-কবিতা-নাটিকা, প্রবন্ধের অলংকরণ করলেও বরাবরই বর্ণলিপি করতে অনাগ্রহী ছিলেন জয়নুল। কলকাতায় তাঁর ছাত্র কামরুল হাসান এবং পরে ঢাকায় কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান প্রমুখ তাঁর আঁকা বেশির ভাগ বইয়ের প্রচ্ছদের বর্ণলিপি লিখতেন। তবে কাইয়ুম চৌধুরী জয়নুল ক্যালিগ্রাফিকে ‘অনন্য’ বলেছেন। মামুন কায়সার বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ গ্রন্থে জয়নুলের সাতটি বইয়ের প্রচ্ছদচিত্র মুদ্রিত করেছেন। এই বইয়ে জয়নুল নজরুলের বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন বলে উল্লেখ থাকলেও এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।

অনেক কবি-সাহিত্যিকের স্মৃতিচারণায় জয়নুল আবেদিনের প্রচ্ছদ অঙ্কনের টুকরো টুকরো গল্প পাওয়া যায়। আহসান হাবীব চারণা করেছেন তাঁর স্মৃতি:

‘প্রয়াত বন্ধু শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন রাত্রিশেষ-এর প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন সানন্দে। তিনি বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকার কাজে কখনো উৎসাহী ছিলেন না। তা সত্ত্বেও ফররুখ আহমদের সাত সাগরের মাঝির এবং এক বছর পরে রাত্রিশেষ-এর প্রচ্ছদ এঁকে বন্ধুত্বের নিদর্শন তিনি স্বাক্ষরিত করেছিলেন। (‘পঁচিশ বছর পরে’, পৌষ ১৩৮৭, আহসান হাবীব রচনাবলি, ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ১৯৯৫) 

প্রতিকৃতি : কাইয়ুম চৌধুরী
প্রতিকৃতি : কাইয়ুম চৌধুরী

কাইয়ুম চৌধুরী জয়নুলের কাশবনের কন্যার প্রচ্ছদ বিষয়ে বলেছেন:

শামসুদ্দীন আবুল কালামের উপন্যাস কাশবনের কন্যা আমার মনে হয় প্রকাশনাক্ষেত্রে একটি দিকনির্দেশনা। জয়নুল আবেদিনের অঙ্কিত প্রচ্ছদ, তাঁর ক্যালিগ্রাফি ও ইলাস্ট্রেশন এখনো অনন্য। (‘প্রচ্ছদ-ভাবনা’, বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ, ঢাকা, বাংলা একাডেমি, ২০০৭, পৃ. ১৪৪)

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালুর ও ফররুখ আহমদের সাত সাগরের মাঝির প্রথম সংস্করণ জয়নুলের অঙ্কিত। তবে পরে প্রকাশকেরা ওই প্রচ্ছদগুলো বাতিল করে নতুন করে প্রচ্ছদ আঁকান। এ সময় লালসালুর প্রচ্ছদ আঁকেন আবদুর রউফ আর সাত সাগরের মাঝির প্রচ্ছদ অঙ্কন করেন কামরুল হাসান।

লালসালুর প্রচ্ছদ সম্পর্কে জানা যায়, ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ চেয়েছিলেন লালসালুর কাভার ডিজাইন করবেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। তিনিও খুব আগ্রহ প্রকাশ করেন। কালো রঙের ওপর প্রচ্ছদ করে দেন শিল্পাচার্য।’ এমরান কবির, ‘লালসালুর অন্তরালে’, উত্তরাধিকার, বৈশাখ-আষাঢ় ১৪২৬, পৃ. ১৫৭) 

জসীমউদ্​দীনের নকসী কাঁথার মাঠ কাব্যের প্রকাশকাল ১৯২৯ সাল। তখন জয়নুলের বয়স মাত্র ১৫ বছর। চার বছর পর কলকাতায় আর্ট কলেজে ভর্তি হবেন তিনি। ফলে ওই কাব্যের বর্তমানে প্রচলিত প্রচ্ছদটি ওইকালে তাঁর পক্ষে আঁকা নিশ্চয়ই সম্ভব ছিল না। সে ক্ষেত্রে এমন মনে করা সংগত যে গত শতকের ষাটের দশকে এই নতুন প্রচ্ছদচিত্র এঁকেছেন জয়নুল আবেদিন আর বর্ণলিপি লিখেছেন কাইয়ুম চৌধুরী। এ বিষয়ে বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ-এর ইতিবৃত্তে কিছুই উল্লেখ নেই। উপরন্তু, বঙ্গ অঞ্চলের আবহাওয়ায়, গ্রন্থাগারগুলোর পরিবেশে এবং আমাদের সংরক্ষণহীন মানসিকতার কারণে প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ যে এখনো অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যাবে, সেই আশা দুরাশারই নামান্তর। অন্যদিকে আলী আহমদের তালিকাগ্রন্থ মুসলিম বাংলা সাহিত্য-এ-ও বেঙ্গল লাইব্রেরি ক্যাটালগ থেকে নকসী কাঁথার মাঠ-এর প্রথম সংস্করণের প্রকাশক, মুদ্রাকর ও অন্যান্য তথ্য পাওয়া গেলেও প্রচ্ছদশিল্পীর নাম নেই।

আদতে বাঙালি লেখক-প্রকাশকেরা সেকালে প্রচ্ছদশিল্পীর নাম উল্লেখের প্রয়োজনীয়তাই উপলব্ধি করতেন না। ফলে কেবল জয়নুল আবেদিন নন, আরও অনেকের প্রচ্ছদের তথ্যই চিরতরে হারিয়ে গেছে কালের গহ্বরে। তারপরও প্রচ্ছদ আঁকিয়ে জয়নুলের বর্ণিল প্রচ্ছদ-ভুবনের যতটা এখনো পাওয়া যায়, তাতেই উপলব্ধ হয়, এই শাখাতেও কতটা পারঙ্গম এবং কতটা ‘মাস্টার’ ছিলেন তিনি।

এ পর্যায়ে নিতে হবে কয়েকজন মানুষের নাম, জয়নুল আবেদিনের দুষ্প্রাপ্য প্রচ্ছদচিত্র সংগ্রহে যাঁরা আমাকে সহযোগিতা করেছেন—আবুল মোমেন, আবুল আহসান চৌধুরী, জাঁনেসার ওসমান, পিয়াস মজিদ, আবদুস শাকুর ও জিয়াউদ্দীন চৌধুরী—লেখার অন্তিমে আমি বিনম্র কৃতজ্ঞতা জানাই তাঁদের প্রতি।