'নিজের লেখার প্রেমে পড়ে যেতে নেই'

নবনীতা দেবসেন বললেন, বইপড়া আর সাহিত্যপাঠ দুটো এক বিষয় নয়। ছবি: খালেদ সরকার
নবনীতা দেবসেন বললেন, বইপড়া আর সাহিত্যপাঠ দুটো এক বিষয় নয়। ছবি: খালেদ সরকার
>নবনীতা দেবসেনের জীবন ছিল বিচিত্র, তাঁর সাহিত্যজগৎও ছিল বহুবর্ণিল। বেড়ে উঠেছিলেন সাহিত্যিক পরিবারে। পদ্মশ্রী ও পশ্চিমবঙ্গ সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পাওয়া এই লেখক ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছিলেন ঢাকায়। সেই সময় নেওয়া হয়েছিল এই অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার। এখানে তিনি উন্মোচন করেছেন নিজের লেখার ভুবন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুরুল আহসান বুলবুল।

মনজুরুল আহসান বুলবুল: আপনার জীবনকথা দিয়েই শুরু করি। আপনার মা–বাবা দুজনেই সাহিত্য অঙ্গনের। আপনাদের যে বাড়ি, সেটিরও নাম ‘ভালো–বাসা’। মা–বাবা সম্পর্কে বলবেন একটু।
নবনীতা দেবসেন: ওই বাড়িতেই আমি জন্মেছি। এখনো সেখানেই থাকি। আমার মা–বাবা দুজনেই লেখক ছিলেন বলে ছোট থেকেই আমার মনে হতো, লেখা ছাড়া আমার আর কোনো কাজ করার নেই। মনে হতো, বড় হয়ে বোধ হয় সবাই এটাই করে। বাবা লেখেন, মা–ও লেখেন, বাবার বন্ধুরাও লেখেন, যাঁরা বাড়িতে আসেন, তাঁরাও সবাই লেখেন। ফলে আমার মনে হতো, সেটাই জীবিকার একমাত্র উপায়। আমার জীবনও এর বাইরে যাবে না। এভাবেই আমার বড় হয়ে ওঠা।

বুলবুল: আপনার মা–বাবা কী লিখতেন, কবিতা?
নবনীতা: আমার বাবা (নরেন্দ্র দেব) একট পত্রিকা চালাতেন। মূলত কবিতা লিখতেন। বড়–ছোট সবার জন্যই লিখতেন। তিনি নামকরা সাহিত্যিক ছিলেন। আর মা (রাধারানী দেবী) লিখতেন সব বিষয়েই।

বুলবুল: আপনি বলছিলেন, আপনার মা–বাবা পূর্ববঙ্গের সাহিত্য সম্মেলনেও এসেছিলেন।
নবনীতা: মা–বাবা দুজনেই পূর্ববঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে এসেছিলেন। কাগমারীতে (সাহিত্য সম্মেলন) হয়েছিল। ভারতবর্ষের বাংলা সাহিত্য সম্মেলন ছিল সেটি। ১৯৫৪, পরে ১৯৫৭–তে। মা–বাবা দুজনেই সেখানে নিমন্ত্রিত ছিলেন। ১৯৫৭ সালে হুমায়ুন কবির (ভারতের সেই সময়ের শিক্ষামন্ত্রী) এসেছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী আবদুল ওদুদ। পরে গল্প শুনেছি, সম্মেলন খুব ভালো হয়েছিল। আমি তো তখন ছাত্র, তাই আসতে পারিনি।

বুলবুল: যত দূর জানি, লেখালেখি করেই আপনা বাবা জীবিকা নির্বাহ করতেন। গত শতকের কুড়ির দশকে কি এটা সম্ভব ছিল?
নবনীতা: হ্যাঁ, তিনি লিখতেন; অনুবাদ করতেন। কাগজে কাজ করতেন। তবে শুধু লেখার কাজই করতেন।

বুলবুল: আপনার পড়াশোনা, ছাত্রজীবন সম্পর্কে জানতে চাই।
নবনীতা: আমার পড়াশোনা কলকাতায়। গোখলে স্কুল শেষে প্রেসিডেন্সি কলেজে। পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে লেখাপড়া করেছি। আমি স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছি ২০ বছর বয়সে। ওই সময়েই আমি আমেরিকায় চলে যাই। সেখানে হার্ভার্ডে পড়েছি, ইন্ডিয়ানাতে পড়েছি, কেমব্রিজেও পড়েছি। পোস্টডক্টরেট করেছি বার্কলে থেকে। রাইটার্স ইন রেসিডেন্সে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কাজ করেছি।

বুলবুল: একটু আগে বলছিলেন, মা–বাবাকে দেখেই আপনার মনে হয়েছিল, সাহিত্যই আপনার ভবিতব্য। আপনার মা–বাবা লেখালেখির প্রেরণা পেয়েছিলেন কোথা থেকে, এ নিয়ে কোনো ধারণা আছে?
নবনীতা: তাঁদের প্রজন্মটা আলাদা ছিল। আমার মা বাল্যবিধবা ছিলেন। তিনি লেখার মধ্য দিয়েই নিজেকে আবিষ্কার করেন। বড় হয়ে বাবাকে বিয়ে করেন ২৭–২৮ বছর বয়সে। তিনি বিধবা হয়েছিলেন ১৩ বছর বয়সে। তখনো শ্বশুরবাড়িতেই যাননি। মায়ের কাছে সাহিত্যটা ছিল তাঁর জীবন, প্রাণ ও অস্তিত্ব। আর আমার বাবাও অনেক দিন লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যে বাবার নামটা কখনো মুছবে না। বাবা বিশেষত বিশ্বসাহিত্যে উৎসাহী ছিলেন। মা–বাবা দুজনের সঙ্গেই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা ছিল। কাজেই সাহিত্যের একটা পরিবেশের মধ্যেই তাঁরা বেড়ে উঠেছিলেন। সবাই জানে, আমার নামটা রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। কিন্তু আসলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই নামটা আমার মাকে দিয়েছিলেন, যখন বাবার সঙ্গে মায়ের বিয়ে হলো সেই সময়। মা নতুন জীবনে আনীতা হলেন। মাকে কবিগুরু চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আজ থেকে তুমি নতুন জীবনে আনীতা হলে; তাই তোমার নাম হলো নবনীতা।’ আমার মা খুব তেজি মহিলা ছিলেন। তিনি জবাবে লিখলেন, ‘আমি আপনার আশীর্বাদটুকু নিলাম, কিন্তু আপনার নামটি নিতে পারছি না। আমি ২৮ বছর ধরে রাধারানী, আমার দুটো বই এই নামে আছে। কাজেই আমি এই নাম নিতে পারব না।’ পরে আমি যখন জন্মেছি, মা–বাবার বিয়ের প্রায় আট বছর বাদে। তখন রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখেছেন আমাকে ‘কল্যাণীয়া নবনীতা’ নামে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘তুমি যেহেতু এখনো কোনো উপহার প্রত্যাখ্যান করার মতো বড় হওনি; তাই উত্তরাধিকারসূত্রে তোমার এই নাম (নবনীতা) হলো।’ আমার বয়স তখন তিন দিন মাত্র। এই হচ্ছে আমার আশীর্বাদ। আমার জীবনে অনেক কিছু হয়েছে, যে জন্য আমি দায়ী নই। ঈশ্বরের দয়া। এভাবেই রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে নামটি পাওয়া। আমি যে আমার এই মা–বাবার কাছে জন্মেছি, সেটিও কিন্তু ঈশ্বরের দয়া।

বুলবুল: মা–বাবাকে দেখে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, লেখালেখিই হবে আপনার ভবিতব্য। সেই পথেই হাঁটলেন পরবর্তী জীবনে?
নবনীতা: না তো, আমি মাস্টারি করতাম। আমার দুটো বাচ্চাকে মানুষ করতে হয়েছে একা। আমি তো পেশাদার লেখক নই। আমার মা–ও পেশাদার লেখক ছিলেন না, বাবা ছিলেন। বাবার তো রোজগার করে সংসার চালাতে হতো। মায়ের তো তা না। তিনি প্রবন্ধ লিখতেন, কবিতা লিখতেন, কিন্তু টাকার জন্য লিখতেন না। আমিও টাকার জন্য লিখি না, টাকার জন্য পড়াই।

বুলবুল: সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় বিচরণ করেছেন আপনি। ৮০/৯০টি বই লিখেছেন। এখন পেছন ফিরে তাকালে কী মনে হয়?
নবনীতা: হ্যাঁ, পরিশ্রম যে আমি করিনি, তা তো নয়। নানা ধরনের বই–ই লিখেছি। তবে উপন্যাস আমি খুব বেশি লিখিনি, ১৭/১৮টা হবে হয়তো। রম্য লিখেছি, ছোটদের জন্য অনেক লিখেছি—শিশু সাহিত্য, রূপকথা আমার মতো করে।

বুলবুল: আপনার লেখালেখি তৈরি হয় কীভাবে—শুধুই ভালো লাগা থেকে, না পরিকল্পনা করে?
নবনীতা: দুরকমই। উপন্যাস পরিকল্পনা না করে লেখা যায় না। শুধু ভালো লাগা থেকে কেউ উপন্যাস লেখে না, উপন্যাস লিখতে হয় চিন্তা থেকে। কখনো আমার মনে হয়, আমার চিন্তা থেকে আসা বিষয়টি জরুরি, বিষয়টি সমাজের জন্য জরুরি এবং এই জরুরি বিষয়টা অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করা উচিত, তখনই আমার উপন্যাসের পরিকল্পনা তৈরি হয়। আমি শুধু আমার জন্য উপন্যাস লিখলাম, এটা হতে পারে না। উপন্যাস লেখার জন্য পরিকল্পনা জরুরি এবং পরিশ্রম দরকার বলে আমি মনে করি। হুট করে উপন্যাস হয়তো অনেকে লিখতে পারেন, কিন্তু আমি পারি না। প্রবন্ধ লেখার জন্যও পরিকল্পনা দরকার। চিন্তাভাবনা, পড়াশোনা ও পরিশ্রম না করে প্রবন্ধ লেখাও উচিত না। আর কবিতা লেখার জন্য ভাষা ও ভাবনা—দুই–ই দরকার। শুধু আবেগ দিয়ে তো কবিতা হয় না, ভাষা দরকার। ভাষার মধ্যেই আবেগ আর বুদ্ধিকে মানাতে হবে। কবিতা লিখি নিজের ভালো লাগার জন্য, মানুষকে জ্ঞান দেওয়া জন্য বা উদ্বুদ্ধ করার জন্য নয়। আমার একান্ত কথা বলার জায়গা ওটা।
আমার আরেকটা খুব ভালো লাগার জায়গা হলো বাচ্চাদের জন্য লেখা। আমার বাচ্চারা যখন ছোট ছিল, তখন ওদের গল্প বলতাম, তারপরই এগুলো লিখে ফেলতাম। এভাবেই আমার বাচ্চাদের জন্য লেখার শুরু। এখানে যা খুশি তাই বানাতে পারি তো। জীবনে যা হচ্ছে না, তা এই রূপকথায় হতে পারে। এখানে একটা আদর্শ জীবন, আদর্শ মানুষ, আদর্শ সমাজ তৈরির সুযোগ আছে। সে জন্য রূপকথা লিখতে ভালো লাগত আমার। বলা দরকার, আমার রূপকথাগুলোতে মেয়েরা প্রধান কুশীলব। সেখানে রানি এসে রাজাকে উদ্ধার করেন। আমার এ ধরনের অনেক গল্প আছে, অনেক ।

বুলবুল: আপনার এই ধারণা বা রূপকল্প সৃষ্টির পেছনে কি বিশেষ কোনো কারণ আছে?
নবনীতা: হ্যাঁ, বিশেষ কারণ আছে। রূপকথায় তো চিরকাল পুরুষেরাই মেয়েদের উদ্ধার করল। মেয়েদের তারা বন্দী করল, পিটল, কাটল, আবার উদ্ধারও করল। বিষয়টি এমন, পুরুষই তাদের কষ্ট দেয়, আবার তারাই তাদের উদ্ধার করে। প্রচলিত রূপকথাগুলোতে আমি মেয়েদের আসল চেহারা দেখতে পাই না। সেখানে মেয়েরা শুধু বন্দিনী, আর তাদের উদ্ধার করার গল্প। ছেলেদের তুলনায় এখানে তাদের চরিত্রটি প্যাসিভ। আমার রূপকথাতে মেয়েদের পজিটিভ ও অ্যাকটিভ রোলটাই আমি তুলে ধরেছি। তারা উদ্ধার করেন, যুদ্ধ করে নয়, অস্ত্র বলে নয়, বুদ্ধির অস্ত্র বলে। আসলে ছোট থেকেই মেয়েদের বোঝানো দরকার; তাদের মধ্যেও শক্তি আছে। রূপটাই একমাত্র নয়, তার বুদ্ধিও আছে। শুধু রূপবতী রাজকন্যা নয়, বুদ্ধিমতী রাজকন্যাই আমার চাই। বুদ্ধি, আবেগ, ভালোবাসা—সবই থাকতে হবে। এই দিয়েই তো মানুষের জয় হয়।

প্রথম কবিতার বই প্রথম প্রত্যয় প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৫৯ সালে। তখন তিনি লিখতেন নবনীতা দেব নামে
প্রথম কবিতার বই প্রথম প্রত্যয় প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৫৯ সালে। তখন তিনি লিখতেন নবনীতা দেব নামে

বুলবুল: আপনার এই ধারণাও কি পরিবারের কাছ থেকে পেয়েছিলেন?
নবনীতা: আরে, আমার মা–ই তো নারী শক্তির উত্থান দেখিয়েছেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিধবা হয়েছেন; সেখান থেকে আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। আমার বাবার সঙ্গে বিয়ের সময়ের কথা বলি। হিন্দু বিয়েতে কন্যা সম্প্রদানের বিষয়টি থাকে। মা বললেন, আমার বিয়ে তো হয়েছে। সে সময় বাবা আমাকে সম্প্রদান করছেন। এখন তিনি নেই। কাজেই আমিই আমার অভিভাবক, আমি আত্মসম্প্রদান করব। তিনি করেছেনও তাই। ওই সময় এটা খবর হয়েছিল বিভিন্ন কাগজে, ‘কন্যার আত্মসম্প্রদান’ শিরোনামে। সেই খবরের কাটিং আছে আমার কাছে। কাজেই আমার মধ্যে নারী শক্তির জাগরণ আমার জন্মের আগে থেকেই, মায়ের কাছ থেকে পাওয়া।

বুলবুল: সেই সময়ের বাস্তবতায় আপনার মায়ের এই কাজটি তো রীতিমতো বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত ছিল।
নবনীতা: কিন্তু আমার জীবনে আমি তা পারিনি। আমার বিয়ের সময় আমার বাবা আমাকে সম্প্রদান করেছিলেন। তবে এ কথা ঠিক যে সে সময়ে আমার মা যে রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ওই কালে তেমন সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব সহজ ছিল না।

বুলবুল: এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। একজন সাহিত্যিক কি তাঁর কাজে সব সময় নিজের সমাজ ও সময়কে ধারণ করতে পারেন? এ বিষয়ে কী মনে হয় আপনার?
নবনীতা: সমাজের বাইরে গিয়ে কেউ কিছু লেখে নাকি? যে বাউল গান গায়, সে তো অন্য জগতের গান গাইছে, কিন্তু ছবিগুলো তো এই সমাজেরই, চিত্রকল্পগুলো সমাজ বা জীবন থেকেই নেওয়া। আমরা সমাজবদ্ধ জীব, সংগত কারণেই সমাজের ত্রুটিগুলোও আমরা জানি। একজন লেখকের লেখায় সেসব বারবার ফিরে আসবেই।

বুলবুল: কিন্তু রূপকথায় তো আপনি ভিন্ন সমাজের চিত্র এঁকেছেন।
নবনীতা: খুবই সত্যি কথা। সমাজটাকে আমরা হয়তো বদলাতে পারি না, তবে আমরা যদি নিজের চিন্তাধারাকে খানিকটা পাল্টাই, তাহলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে বদল ঘটবে। তারা যখন বেড়ে উঠবে, তখন তারা এটা জানবে যে রূপকথায় রাজকন্যারা শুধু ঘুমিয়েই থাকে না, তারা জেগেও থাকে; তারা দৌড়ায়। তাদের মেধা আছে—এই জানাটা অত্যন্ত জরুরি। আমার রূপকথায় আমি এই সত্যই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

বুলবুল: তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক আপনি। আপনাকে যদি পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের সাহিত্যের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের তুলনা করতে বলা হয়, তাহলে কী বলবেন? বাংলা সাহিত্যের অবস্থানটা কোথায়?
নবনীতা: বাংলা সাহিত্যের ঐশ্বর্য জগতের কোনো সাহিত্যের চেয়ে কম নয়। আমাদের দুর্ভাগ্য, বাংলা ভাষার সাহিত্যটা শুধু দুই দেশের মধ্যে আবদ্ধ—ভারতবর্ষ আর বাংলাদেশ। ফলে এটি বাঙালি জাতির বাইরে পৌঁছায় না। আমার মনে হয়, আমাদের সাহিত্য যে কতটা ঐশ্বর্যমণ্ডিত, তা বিশ্বপরিসরে পরিচিত করার জন্য অনুবাদের বিকল্প নেই। আমাদের দুই দেশের সাহিত্য একাডেমিগুলোর মন দেওয়া উচিত অনুবাদে। ঢাকার বাংলা একাডেমিকে আমি বাংলা ভাষার অভিভাবকই মনে করি, সে জন্য তাদের প্রতি আমার আহ্বানটা বেশি। পশ্চিমবঙ্গের আকাদেমির প্রতিও আমার দাবি তাই।

নবনীতা দেবসেন। ছবি: খালেদ সরকার
নবনীতা দেবসেন। ছবি: খালেদ সরকার

বুলবুল: অনুবাদের কথা আপনি বললেন, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের পাঠচর্চাও কি জরুরি নয়?
নবনীতা: দেখুন, পাঠ ও চর্চার ক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। আমাদের স্কুলের পাঠ্যবইয়ে যা পড়ানো হয়, তা বিষয়গত বা উপস্থাপনগতভাবে এতটা একঘেয়ে যে এগুলোর মধ্যে আকর্ষণের কোনো শক্তি নেই। ফলে পাঠক্রম তৈরির ক্ষেত্রে এই বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া দরকার। শিশুদের জন্য একটা বইয়ের স্পর্শ, গন্ধ, চেহারা, রং—সবকিছুই জরুরি। আমাদের নতুনেরা এমন পাঠ নিয়ে বড় হচ্ছে, যা তাদের মননে স্থায়ী হচ্ছে না। সংকটের জায়গাটা এটিই।

বুলবুল: আমরা কি বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কহীন নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলছি, আপনার কি এমন আশঙ্কা হয়?
নবনীতা: হিন্দি নিয়ে আমি সমস্যা দেখি না। কারণ, হিন্দি বাংলা ভাষাকে গ্রাস করতে পারেনি, পারবে না। আমি ইংরেজি নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমরা ইংরেজি মাধ্যম নিয়েই পড়াশোনা করছি। এমনকি আমাদের করিডরেও বাংলা বলা নিষিদ্ধ ছিল। তাতে কি আমরা বাংলা ভুলে গেছি? বাংলায় লিখছি না, পড়ছি না? সবটা নির্ভর করে নিজের বাড়ির বা পরিবারের ওপর। ইংরেজি জানতেই হবে, এটি ইন্টারনেটের ভাষা, ইংরেজি গেটওয়ে টু দ্য ওয়ার্ল্ড। কিন্তু তা বাংলা ভুলে যাওয়ার বিনিময়ে নয়। এ দেশের শিক্ষিতেরা—কি বাংলায়, কি ইংরেজিতে—এখন সব মিডিওকার হয়ে যাচ্ছে।

বুলবুল: আমাদের নতুন প্রজন্মের একটি বড় অংশ, যারা বিদেশে বড় হয়েছে, তারা পড়ছে, লিখছে ইংরেজি ভাষায়, কিন্তু বিষয়বস্তুর জন্য তারা আবার দেশমুখী হচ্ছে—বিষয়টি কি আমাদের জন্য ইতিবাচক কিছু বয়ে আনতে পারে?
নবনীতা: বাংলা ভাষা বা সাহিত্যকে ইংরেজি ভাষার সঙ্গে মেলাবেন না। কারণ, এখানে ভাষাটাই মৌল। ইংরেজদের নিয়ে বাংলায় সাহিত্যচর্চা কি ইংরেজদের কোনো উপকার করছে? কাজেই কেউ যদি বাংলার জীবন নিয়ে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যচর্চা করেন, তাতে বাংলা ভাষা বা সাহিত্যের কী উপকার হয়? একটা উপকার অবশ্য হয় যে বাঙালির জীবনধারা বাইরের পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছায় এবং আমাদের জীবনযাপন সম্বন্ধে বিদেশিরা জানতে পারে। কিন্তু এতে বাংলা ভাষা–সাহিত্যের কি কোনো উপকার হয়? যাঁদের ‘ডায়াসপোরা’ বলা হয়, মানে যাঁরা বিদেশে বড় হয়েছেন, তাঁদের কথা আলাদা। কারণ, বঙালি হলেও তাঁরা যে দেশে বড় হয়েছেন, সেই দেশের ভাষাই তাঁদের মাতৃভাষা। কাজেই তাঁরা সেই ভাষাতে লিখবেন, এটাই স্বাভাবিক। সেখানে তাঁরা বাংলাকে যতটা পারেন ধারণ করবেন, তাতেও সমস্যা নেই। কিন্তু যাঁরা দেশে বেড়ে উঠেছেন, তাঁরা কেন ভিনদেশি ভাষায় লিখবেন? তিনি তো নিজের মাতৃভাষাতেই লিখবেন। একটা সম্মেলনে একজন পাকিস্তানিকে পেয়েছিলাম, যাঁর ভাষা উর্দু, কিন্তু লিখছেন ইংরেজিতে। একজন ভারতীয় হিন্দিতে কথা বলেন, কিন্তু লিখছেন ইংরেজিতে। আমি নিজেকে যেমন ভারতীয় মনে করি, তেমনি উপমহাদেশীয়ও মনে করি। আমি বাস করব উপমহাদেশে, উপমহাদেশের কোনো একটি দেশের ভাষা আমার মাতৃভাষা, কিন্তু সাহিত্যচর্চা করব ভিনদেশি ভাষায়—এটা আমার কাছে গ্রহযোগ্য মনে হয় না। বরং আমি মনে করি, আমি আমার ভাষাতেই লিখব; এবং সেটা অনুবাদ হয়ে ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বের নানা প্রান্তে।

বুলবুল: বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছে আপনার?
নবনীতা: না, হয়নি। তবে বাংলাদেশের যাঁরা সাহিত্যচর্চা করছেন, তাঁরা বাংলাতেই লিখছেন—এটা আশার কথা। অনেক লেখক বাংলায় লিখেই পৃথিবীর কাছে সম্মান অর্জন করেছেন, তাঁদের ইংরেজিতে লিখতে হয়নি।
সাহিত্যের ইতিহাসে ওঠা–নামা থাকে। কোনো একটা সময়ে অনেক শক্তিশালী লেখক একসঙ্গে থাকেন, আবার অনেক সময় থাকে, যখন শক্তিশালী লেখকের সংখ্যা হ্রাস পায়। এই ওঠা–পড়ার মধ্যেই তো জীবন। এখন ইংরেজিতে কেন লিখছি না বলে শক্তিশালী লেখকেরা যদি হাহাকার করেন, তাহলে কেন একুশে ফেব্রুয়ারি করা। আমাদের দিকে তাকান, আমাদের বন্ধুদের দিকে তাকান: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়,শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ—এঁরা সবাই তাঁদের কালের শ্রেষ্ঠ। এঁরা এমন এক সময়ের যাত্রী, যখন তাঁদের ভিন্ন ভাষার হাত ধরে পথ চলতে হয়নি।

বুলবুল: বর্তমান নিয়ে আপনার মন্তব্য কী; এপার–ওপার—দুই বাংলার সাহিত্যচিত্র নিয়ে?
নবনীতা: আমি নিজে লেখক, ভেতর থেকে দেখি। আসলে পাঠকেরা বা সমালোচকেরাই সঠিক চিত্রটি বলতে পারবেন।

বুলবুল: আমরা কি বই পাঠ থেকে দূরে চলে যাচ্ছি? ইন্টারনেট কি আমাদের সব কেড়ে নিচ্ছে?
নবনীতা: বই পড়া আর সাহিত্যপাঠ—দুটো কিন্তু এক বিষয় নয়। ইন্টারনেটে কিছু পড়া আর সাহিত্য পড়া কি এক বিষয় হলো? এ কথা ঠিক, অনেকে ই–বুক পড়ছে, বই কিনছে কম। কিন্তু যে বইটা আমি হাতে নিয়ে পড়ি বা শুয়ে পড়ি, সেই হাতে নিয়ে বই পড়ার মধ্যে একটা সামগ্রিক সুখ আছে, যা একটি কম্পিউটারের পর্দায় বই পড়ার মধ্যে নেই। বসে বসে কম্পিউটারের পর্দায় বই পড়ছি, এটা অনেকটা অফিস ওয়ার্কের মতো। বইয়ের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক নয় এটি। ছাপানো, বাঁধাই করা বইয়ের সঙ্গে আমাদের যে প্রেমপ্রীতি হয়, তা কখনো কি ই-বুক বা কম্পিউটারের যন্ত্রের সঙ্গে হয়?

বুলবুল: অন্য দেশের পরিস্থিতি কেমন।
নবনীতা: পৃথিবীর সব দেশেই এখন ই-বুক আছে। তাতে সেসব দেশে বই ছাপা কিন্তু বন্ধ হয়ে যায়নি, বইয়ের বিক্রিও বন্ধ হয়নি। কাজেই মানুষ বই পড়বে না, এটা ভয়ের বিষয় নয়। ভয় হচ্ছে বই থেকে মানুষের মনটা অন্যদিকে চলে যাওয়া।

বুলবুল: ফি বছর এপার বাংলা, ওপার বাংলায় প্রচুর বই বের হচ্ছে, সবই কি সাহিত্যমানসম্পন্ন?
নবনীতা: হোক না বই প্রকাশ। যেগুলো ভালো সেগুলো পাঠক নেবে, আর যা গ্রহণ করবে না, তা পড়ে থাকবে। একজন মানুষ যে বই লিখছেন, বই প্রকাশ করছেন—এটিও তো একটা ইতিবাচক ব্যাপার, ওই মানুষটি তো অন্য কিছুও করতে পারতেন। তিনি বই লিখছেন, লিখুন না।

বুলবুল: তরুণ লেখকদের জন্য কিছু বলবেন?
নবনীতা: দুটো কথা। ভালোবাসতে হবে নিজের কাজটিকে। আর পরিশ্রম করতে হবে। ভালোবেসে একটি কাজ করলে, তার সঙ্গে পরিশ্রম করলে, সে কাজটির মূল্য অবশ্যই হবে। অন্যে মূল্য দিক বা না দিক, একটা কাজের মধ্যে আমার আন্তরিক ভালোবাসা আছে, আমি যদি আমি সেটা জানি, এবং যতক্ষণ মনের মতো না হচ্ছে, ততক্ষণ যদি করতেই থাকি, তাহলে ফলটা ভালো হবে।
আর আমি যা লিখেছি তা দারুণ হয়েছে, এটি যদি মনের ভেতরে ঢুকে যায়, তবে তাহলে আর কিছুই হবে না। বারবার দেখতে হবে কোনো খুঁত নেই তো, আরও ভালো কিছু করা যায় কি না। নিজের লেখার প্রেমে পড়ে যেতে নেই, নিজের লেখাকে নিজেই সমালোচনা করতে হয়। ভালোবাসতে হয় এবং দূরে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়।