কদম ফুল হাতে ক্ষুধার্ত বালক

হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮—১৯ জুলাই ২০১২)। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮—১৯ জুলাই ২০১২)। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

রেসকোর্সের (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাশের রাস্তা ধরে হাঁটছি। হঠাৎ চোখে পড়ল,একটি ছেলে একগাদা কদম ফুল হাতে নিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে একপশলা বৃষ্টি হয়েছে। মেঘমেদুর আকাশ। এক কোণে অন্ধকার জমাট বাঁধছে, হয়তো আবার বৃষ্টি হবে। চমৎকার বর্ষার ছবি। এই ছবির সঙ্গে কদম ফুলগুলো এত সুন্দর মানিয়েছে। আমার ইচ্ছা করল কিছু কদম ফুল নিয়ে বাসায় ফিরতে। আমি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই, আমার কাছে বিক্রি করবি?’

তুই করে বলার কারণ ছেলেটির আদুল গা। পরনের সবুজ রঙের লুঙ্গিটি বর্তমানে ধূসর। অনাহারে জীর্ণ–অপুষ্ট শরীর। পুরুষ্টু কদম ফুলের সঙ্গে এর কোনো রকম মিল নেই। এ–জাতীয় ছেলেদের আমরা তুই করে বলি। বাংলা ভাষাটা বেশ চমৎকার। সব শ্রেণির জন্য আলাদা সম্বোধন।

তুই করে বলায় ছেলেটিকে মোটেই অসুখী মনে হলো না। বরং দাঁত বের করে হেসে ফেলল। আমি আবার বললাম, ‘কী রে, বিক্রি করবি?’

‘এইডি বিক্রির ফুল না।’

‘কেন? এতগুলি দিয়ে কী করবি?’

ছেলেটি চট করে জবাব দিতে পারল না। কারণ সে নিজেও হয়তো জানে না এগুলো দিয়ে কী করবে। তার কাছে সুন্দর লেগেছে, সে পেড়ে নিয়ে এসেছে। যা সুন্দর, তা আমরা সহজে হাতছাড়া করতে চাই না। এই জন্যেই সে হয়তো আমার কাছে বিক্রি করতে রাজি নয়।

‘কী রে দিবি? আমি তিনটা কিনব। আমার তিন মেয়ে। একেক মেয়ের জন্যে একেকটা।’

ছেলেটি তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার চোখে গভীর বিস্ময়। আমার ভালো লাগল যে ছেলেটির বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা একেবারে নষ্ট হয়ে যায়নি।

‘আমি নগদ পয়সা দিয়ে কিনব। তিনটার জন্যে তিন টাকা দেব। কী, দিবি?’

আমি মনে মনে আশা করছি, ছেলেটি বলবে, না, ফুল বিক্রি হবে না। যদি তা বলে, সুন্দর একটা গল্প হয়। আমি মোটামুটি একটা ফিলোসফি দাঁড় করাতে পারি, সৌন্দর্য বিক্রি হয় না—এ–জাতীয় কিছু। যদিও খুব ভালো করেই জানি, সৌন্দর্য বিক্রির জন্যে। পিকাসো ছবি আঁকা শেষ করেই তা নিলামে চড়িয়ে দেন। দস্তয়েভস্কি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি শেষ করেই প্রকাশকদের সঙ্গে দর–কষাকষি শুরু করেন।

এই ছেলেটি তিন টাকার বিনিময়ে তিনটা কদম ফুল বিক্রি করবে না,
তা হতেই পারে না। হলোও তা–ই। ছেলেটি তিনটা ফুল আলাদা করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এইগুলি কিন্তুক খায় না।’

এতক্ষণে তার বিস্ময়ের কারণটা পরিষ্কার হলো। সে ভেবেছিল, আমি হয়তো ফল ভেবেছি। শহুরে বাবুর পক্ষে এ রকম পুরুষ্টু জিনিসগুলোকে ফল ভাবা বিচিত্র নয়।

তিন টাকার বিনিময়ে তিনটি কদম ফুল কিনেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ
তিন টাকার বিনিময়ে তিনটি কদম ফুল কিনেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ

তিন টাকা দিয়ে তিনটা ফুল কেনা হলো। নিতান্তই বাজে খরচ। একটা টাকা দিলেই হতো। তা না করে তিন টাকা দেওয়ার পেছনের কারণটিও মনস্তাত্ত্বিক। আমি সৌন্দর্যের জন্যে ব্যয় করছি, যে কারণে এই মুহূর্তে আমি নিজেকে অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা ভাবার আত্মপ্রসাদ অনুভব করতে পারছি। একই সঙ্গে রাস্তার একটি শিশুকে আমি অভিভূত করতে পারছি। তিনটি টাকার জন্যে তাকে নিশ্চয়ই প্রচুর কষ্ট করতে হয়। ছেলেটিকে তার এই অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যে খানিকটা বিচলিত মনে হলো। কোঁচড়ের কদম ফুলগুলোর প্রতি তার এখন কোনো আগ্রহ নেই। সে বারবার চকচকে নোটগুলোর দিকে তাকাচ্ছে। কদম
ফুল নিয়ে আসবার সময় যে মুগ্ধ
বিস্ময় ও আনন্দ তার চোখে ছিল, এখন তা নেই।

সে আমাকে অবাক করে দিয়ে কোঁচড়ভর্তি ফুল ফেলে দিয়ে ছুটে চলে গেল। হয়তো আজ সারা দিন তার খাওয়া হয়নি। এখন গিয়ে মুড়ি
কিনবে। কিংবা রাস্তার পাশের রুটির দোকান থেকে রুটি কিনে গুড় দিয়ে খাবে। ফুল নিয়ে খেলার চেয়ে এটি তার কাছে অনেক জরুরি। তবু
আমি কি বিচিত্র উপায়ে চমৎকার একটা আনন্দ থেকে তাকে বঞ্চিত
করলাম না?

আমার সঙ্গে দেখা না হলে সে কি বেশ কিছু সময় বর্ষার এই চমৎকার ফুলগুলো নিয়ে খেলত না?

ঢাকা শহরে বেশ কিছু শিশু ফুল বিক্রি করে। ফুল ঠিক নয়, ফুলের মালা। বাসি কিছু ফুল দিয়ে কোনোমতে একটা মালা বানিয়ে গাড়ির জানালায় জানালায় ঘুরে একঘেয়ে গলায় বলে, ‘একটা মালা কিনবেন? সারা দিন খাওয়া হয় নাই।’

ফুলের মতো একটা সুন্দর জিনিসের সঙ্গে ক্ষুধার মতো একটি কুৎসিত জিনিসকে তারা একত্র করে। তবু আমরা কিছু বুঝতে পারি না। পাথরের মতো মুখ করে বসে থাকি। নিতান্তই যখন বিরক্ত হই,তখন কর্কশ গলায় বলি, ‘যা ভাগ।’ এবং এটা বলার জন্যে আমাদের মোটেও খারাপ লাগে না।

আমাদের এই কর্কশ ব্যবহার কি ওদের কাছে খারাপ লাগে? তারা কি আহত হয়? অপমানিত বোধ করে? আমার একজন সাইকোলজিস্ট বন্ধু আছেন। তাঁর ধারণা, ‘নিম্নস্তরের মানুষের বোধও নিম্নস্তরের। তাদের আনন্দ হচ্ছে শারীরিক আনন্দ। মানসিক কোনো ব্যাপার তাদের নেই। তারা জ্যোৎস্না দেখে না। জ্যোৎস্না তারাও পছন্দ করে, কারণ, চাঁদের আলোয় তারা ডাস্টবিনে খাবার খুঁজতে পারে। অন্ধকারে পারে না।’

>

সংগ্রহ ও ভূমিকা
হাসান হাফিজ

মানবিকতা, সমাজচিন্তন, সূক্ষ্ম মনস্তত্ত্ব, কৌতুক, রসবোধ ফুলের মতো ফুটে উঠত হুমায়ূন আহমেদের রচনায়। আরোপিত বা কষ্টকল্পিত নয়, এই প্রস্ফুটন সাবলীল ও স্বতঃস্ফূর্ত। এই মমতা ও দরদি শিল্পবুনন পাঠকনন্দিত করেছে তাঁকে। গেল ১৩ নভেম্বর ছিল নন্দিত কথাকার হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন।

গত শতকের আশির দশকে শফিকুল ইসলাম ইউনুস সম্পাদিত সাপ্তাহিক ঢাকা পত্রিকায় ‘এইসব দিনকাল’ শিরোনামে একটি কলাম লিখতেন জনপ্রিয় এই ঔপন্যাসিক। এখানে পত্রস্থ হওয়া অগ্রন্থিত এ রচনাটি সেই কলামের অন্তর্গত একটি লেখা। আমরা জানি, এইসব দিনরাত্রি নামে একটি টেলিভিশন ধারাবাহিক লিখেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ, যা সে সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়ে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। যাহোক,
অগ্রন্থিত এই কলামটি প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকা পত্রিকার ১১ বর্ষ ২১ সংখ্যায়, ১৭ জুন ১৯৮৮ সালে। রচনাটি আয়তনে ক্ষুদ্র কিন্তু খুবই মর্মস্পর্শী। লেখাটি সেই সময়ের সাপ্তাহিক ঢাকার (বর্তমানে দৈনিক) সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ইউনুসের সৌজন্যে প্রাপ্ত। আর এই লেখায় সমকালীন বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে।