সুফিয়া কামাল : নারীর ঘর, নারীর বাহির

>
সুফিয়া কামাল (২০ জুন ১৯১১–২০ নভেম্বর ১৯৯৯)
সুফিয়া কামাল (২০ জুন ১৯১১–২০ নভেম্বর ১৯৯৯)
তিনি কবি, তবে সবার কাছে সুফিয়া কামালের আরেকটি পরিচয়ও ছিল—জননী সাহসিকা। সুফিয়া কামাল কি নারীবাদী? কোন রূপে নারীকে দেখতে চেয়েছেন তিনি? পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী-পুরুষের অংশগ্রহণকে কীভাবে দেখেছেন? নারীর ঘর ও বাহির কেমন ছিল তাঁর কাছে? ২০ নভেম্বর এই কবি ও নারী অন্দোলনের পুরোধার মৃত্যুদিন উপলক্ষে অনুসন্ধান করা যাক প্রশ্নগুলোর উত্তর। লিখেছেন সুমন সাজ্জাদ

‘আমার নারীকুলে কেন জন্ম হইয়াছিল? আমার জীবন ধিক্।...আমি যদি পুত্রসন্তান হইতাম, আর মার আসন্ন কালের সম্বাদ পাইতাম, তবে আমি যেখানে থাকিতাম, পাখির মতো উড়িয়া যাইতাম। কি করিব, আমি পিঞ্জর-বদ্ধ বিহঙ্গী।’

মুমূর্ষু মাকে দেখতে না-পাওয়ার আকুলতায় ভরা কথাটি বলেছেন উনিশ শতকের এক দুর্ভাগা বাঙালি নারী রাসসুন্দরী দাসী; আমার জীবনী বইয়ে ১৮৬৮ সালে বলা ওই কথার ভেতর জমে আছে গভীর দীর্ঘশ্বাস ও মর্মবেদনা। সত্যিই নারী যেন পিঞ্জরে বাঁধা পাখি! নারীর জন্য নির্দিষ্ট ছিল একটিমাত্র স্থান—তার ‘ঘর’; এই ঘরই তার পৃথিবী, ঘরই তার অন্তিম গন্তব্য। কিন্তু নারী তো ‘বাহির’ও চিনতে চেয়েছে, ঘরের সীমানা পেরিয়ে যেতে চেয়েছে বিস্তৃত দিগন্তে। পিঞ্জরভাঙা পাখির মতো সে–ও তো মেলতে চেয়েছে মুক্ত ডানা। আজকের বাঙালি নারীর মনে দীর্ঘশ্বাসের ওই দহন হয়তো কমে এসেছে। কারণ, সে তার বাসনার জগৎকে কোনো খোপে আটকে রাখে না। পড়ালেখা, জীবনধারণ, আয়–উপার্জন, রাজনীতি, শিল্প–সাহিত্য—সংস্কৃতির সব স্তরে সমান অধিকারের বোধকে সে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। যদিও সামাজিক-পারিবারিক নিষেধাজ্ঞা তাকে চোখ রাঙায়। 

দেড় শ-দুই শ বছর আগে চোখরাঙানির ধরন কতটা ব্যাপক ছিল তার বৃত্তান্ত আমরা পড়তে পারি রাসসুন্দরী দাসী কিংবা বেগম রোকেয়ার লেখায়। বাঙালি নারীর ‘ঘর’ ও ‘বাহিরে’র বৃত্তান্তে আরেকটি উজ্জ্বল নাম সুফিয়া কামাল; রাসসুন্দরী, রোকেয়াদের বদ্ধ পৃথিবী থেকে যিনি নেমে এসেছিলেন খোলা জমিনে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার জোরালো কোনো ভিত্তি তাঁর ছিল না, অথচ তিনি পড়েছেন, লিখেছেন। তাঁর দিকেও তাক করা হয়েছিল নিষেধের তর্জনী। 

লেখালেখি
সুফিয়া কামাল অসংখ্য পাতা ভরে লেখেননি। প্রধানত কবিতা লিখেছেন, যদিও সাহিত্যে প্রবেশ করেছিলেন কেয়ার কাঁটা নামের গল্পগ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ছোটদের জন্য লিখেছেন দুটো ছড়ার বই। লোকপরিসরে একটি সাধারণ ধারণা এই যে সুফিয়া কামাল ‘নারীর হয়ে নারীর জন্যেই’ লিখে গিয়েছেন। আদতে তাঁর লেখার বিষয় কেবলই নারী, নারীমুক্তি কিংবা নারী-অধিকার নয়। অন্য অনেকের মতো প্রকৃতি ও প্রেম প্রসঙ্গে আছে তাঁর আবেগে কম্পিত কবিতা। সমাজ ও রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার বিরুদ্ধে আছে প্রবল প্রতিবাদ। সুফিয়া কামালের গল্পে ছড়িয়ে আছে ব্যক্তিক অনুভূতিকে ছুঁয়ে–ছেনে দেখার তীব্র পিপাসা ও সংবেদনশীলতা। 

তাঁর কালে তৈরি হওয়া আধুনিকতার খাত ছিল পুরুষের দ্বারা নির্মিত ও পরিচালিত। এ আধুনিকতা এক দিকে পুরুষতান্ত্রিক, অন্য দিকে ইউরোকেন্দ্রিক; যেখানে নারীকে দেখা হয়েছে রহস্যাবৃত, প্রেম ও যৌনতার প্রতীক হিসেবে। রোকেয়া, জ্যোতির্ময়ী দেবী কিংবা সুফিয়া কামাল আধুনিকতার এ ভাষাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কৃতিত্ব ও মহিমা স্বীকার করে নিয়েও পুরুষতান্ত্রিক আধুনিকতার বিপরীত-ভাষ্য তৈরি করেছিলেন সে কালের নারীরা। ‘শিল্পের জন্যে শিল্প’—এ ধরনের নন্দনতত্ত্ববাদী ধারণার সঙ্গে নারীর সম্পৃক্তি ছিল ক্ষীণ। নারীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক আধুনিকতার খাত নিঃসন্দেহে স্বতন্ত্র। এ প্রেক্ষাপটেই সুফিয়া কামালের জীবন, সাহিত্য ও কর্মকাণ্ডকে বিবেচনা করতে হবে। 

তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিগ্রন্থ লিখেছেন তিনি—সোভিয়েটের দিনগুলি, একালে আমাদের কাল ও একাত্তরের ডায়েরী। বাঙালি নারীর ঘর-বাহিরের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে এই তিনটি বই অত্যন্ত মূল্যবান উৎস-পুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। কেননা বইগুলো আমাদের সামনে মেলে ধরে নারীর ঘর থেকে বাইরে যাবার টুকরো টুকরো উপাখ্যান। সেই উপাখ্যানে নারী হারে না, জেতে। প্রথাগত কাঠামো ভেঙে বেরিয়ে আসা এই নারী রাসসুন্দরীর মতো ভয়ে কাতর নন, পিঞ্জর খুলে উড়ে চলা পাখি, যিনি আপন কণ্ঠে গেয়ে যান নিজের গান। 

নারীকে সুফিয়া কামাল দেখেছেন মাতৃপ্রতীকে। ছবি: সংগৃহীত
নারীকে সুফিয়া কামাল দেখেছেন মাতৃপ্রতীকে। ছবি: সংগৃহীত

ঘরে-বাইরে
একালে আমাদের কাল বইটিতে দেখতে পাই নারীর অন্দরমহলের আন্তরিক ছবি; নারীরা সেখানে অখণ্ড অবসরে জীবনকে উদ্​যাপন করে নিজেদের মতো। রান্না করে, বই পড়তে শোনে, চুরি করে বই পড়ে, মেহেদির রঙে হাত মাখে, দরজিরা মেয়েদের গায়ের মাপ জেনে যাবে বলে মেয়েরা নিজেই নিজেদের পোশাক তৈরি করে, অংশ নেয় ধর্মীয় কৃত্যে। চার দেয়ালে তবু একটা ভয় জড়িয়ে ছিল। আমাদের কালের পরিভাষায় আমরা সে দেয়ালকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বলে চিহ্নিত করতে পারি। সুফিয়া কামাল সে গল্পও আমাদের শুনিয়েছেন। তাঁর সংস্কৃত-ফারসি জানা বড় মামা মেঘদূত, রাজতরঙ্গিণী, রঘুবংশ অনুবাদ করে পড়ে শোনাতেন, শোনাতেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের রত্নদীপ, আবার সেই মামাই ছিলেন নারীশিক্ষার ঘোর বিরোধী। নারী হিসেবে গল্প-কবিতা লেখার প্রসঙ্গ ছিল প্রশ্নাতীতভাবেই বিস্ময়কর ও নিষিদ্ধ। 

সুফিয়া কামাল এই ভয়ের সংস্কৃতি ভেঙেছিলেন লিখতে আসার সূচনাবিন্দুতেই। তাঁর লেখা প্রকাশ পেয়েছে দেখে নাখোশ হলেন পারিবারিক অভিভাবক। সুফিয়া কামাল লিখেছেন, ‘আমার বড় মামা শায়েস্তাবাদের বাড়ী বসেই সে লেখা দেখে আগুন হয়ে আমাকে শহর থেকে আবার শায়েস্তাবাদে নিয়ে গেলেন। অকথ্য গালি দিলেন তাঁর আপন ভাইয়ের ছেলে আমার স্বামীকে।’ বাস্তবতার ধাক্কা খেয়ে থেমে যেতে পারতেন তিনি। সুফিয়া কামাল লেখা থামালেন না, লেখার পাশাপাশি লেগে গেলেন সমাজসেবার কাজে। পর্দার মোড়কে ঢেকে ছুটে গেলেন অসহায় মা ও শিশুদের পাশে। তিনি তখন কিশোরী এবং বিবাহিত। 

রাজনীতির ময়দানে
সময়ের গভীর টানে একসময় সুফিয়া কামাল নেমে এসেছেন রাজনীতির ময়দানেও। বরিশালে মহাত্মা গান্ধীর হাতে তুলে দিয়েছেন নিজের হাতে কাটা সুতো। বিভিন্ন কারণে প্রকাশ্য সভায় তাঁর জন্য যাওয়া ছিল অসম্ভব। তাই সাধারণ পোশাকে সিঁদুর পরে তিনি বাইরে এলেন। মনে গেঁথে নিলেন গান্ধী-দর্শনের অক্ষয় স্মৃতি। তারপর যুদ্ধ এল, মন্বন্তর এল। লিখেছেন, ‘যুদ্ধ-সংগ্রাম, মানুষের স্বাধীনতার প্রাণপণ প্রচেষ্টা, প্রতিটি মানুষ যোগ দেয় কর্মে, আত্মমর্যাদায় বাঁচতে চেয়ে। তাই দেখলাম দুকূল প্লাবী স্বাধীনতা সংগ্রামের প্লাবন।’ এরপর এল পাকিস্তান। সে মুহূর্তের অনুভূতিকে রূপ দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘কী বিরাট বিপুল প্রাণবন্ত সে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার দাবি।’ পাকিস্তানের প্রতি তাঁর এই অনুভূতি দেখে অস্বস্তি বোধ করার কিছু নেই। এই সংবেদনা ঐতিহাসিকভাবেই সত্য। দেশভাগ ও পাকিস্তানের একটি রাজনৈতিক মূল্যায়নও করতে দেখি তাঁকে। দেশবিভাগের পরবর্তী কালের নেতৃত্বকে তিনি বলেছেন, ‘মোহাচ্ছন্ন, ভ্রান্ত, স্বার্থকুটিলমনা।’ 

পূর্ববাংলার জনগোষ্ঠী পাকিস্তানকে স্বাগত জানিয়েছিল। আবার সেই পাকিস্তানকেই নাকচ করে প্রতিষ্ঠিত করেছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র। সব সময় জনতার কণ্ঠস্বরে গলা মিলিয়েছেন সুফিয়া কামাল। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১—দীর্ঘ এই কালপর্বে তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন। ভাষা আন্দোলনে নারীদের মিছিল সংগঠিত করেছেন, সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকী অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেছেন, গণ-অভ্যুত্থানে নিজের নেতৃত্বে মিছিল করার পাশাপাশি প্রত্যাখ্যান করেছেন সরকারি পদক। ক্রমেই তিনি হয়ে উঠেছেন সর্বজনমান্য ও নন্দিত নারী। বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হননি তিনি। তাঁর কাছে মুখ্য ছিল বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধ ও আত্মত্যাগের ইতিহাস ধারণ করে ’৭৫-পরবর্তী সামরিকায়নের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সোচ্চার। আর ১৯৯০-এ আমরা তাঁকে দেখি স্বৈরাচারবিরোধী প্রতিবাদী মৌন মিছিলে নেতৃত্ব দিতে।

রাজনীতির কোলাহলময় ময়দানে সুফিয়া কামাল বিশ্বাস ও ভরসার এক আশ্রয়স্থল। লোকবয়ানে তিনি তাই ‘জননী সাহসিকা’। ভয়ের বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসার সাহস সে কালের একজন নারীর জন্য বহুরৈখিক এক তাৎপর্যময় ঘটনা। কেননা পুরুষনিয়ন্ত্রিত পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বলয় ভেঙে তাঁকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। আজকের পরিপ্রেক্ষিতে আপাতভাবে সহজ মনে হলেও সুফিয়া কামালের লড়াই মোটেও সহজ কোনো প্রক্রিয়া ছিল না। 

নারী ও মাতৃপ্রতীক
বৃত্ত ভাঙার প্রসঙ্গে প্রশ্ন উঠতে পারে, সুফিয়া কামাল কি নারীবাদী? কোন রূপে তিনি নারীকে দেখতে চেয়েছেন? পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী-পুরুষের অংশগ্রহণকে কীভাবে দেখেন তিনি? প্রশ্নগুলোর জবাব খোঁজার আগে বলে নেওয়া ভালো, আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিত ও পরিস্থিতি ভিন্নতায় নারীবাদ ও নারী-আন্দোলন বিভিন্ন তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞায়িত ও প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। নারীবাদ কিংবা নারী-আন্দোলনের একটি মাত্র কোনো রূপ বা সংজ্ঞার্থ হাজির করার কোনো সুযোগ নেই। প্রতিটি জনপদ ও সংস্কৃতির ইতিহাস সাপেক্ষে নারীবাদ ভিন্ন ভিন্ন তরিকায় সংগ্রাম করে চলেছে।

সুফিয়া কামালকে ভাবতে হবে বিশ শতকের প্রথমার্ধের মুসলমান সমাজ ও সংস্কৃতির পাটাতনে। ওই সময়পর্বেই তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক উত্থান। সে সময় অভিজাত ও শিক্ষিত মুসলমান নারীর জন্য পর্দা ছিল একটি অবশ্যপালনীয় প্রথা। বাঙালি মুসলমান সমাজে ছিল প্রগতিশীলতা ও রক্ষণশীলতার দ্বন্দ্ব। নারীরা ঘরের বাইরে যাবে-কি-যাবে না—এ ধরনের প্রসঙ্গও ছিল বিরাট তর্কের বিষয়। মোহাম্মদ নাসির আলী, আবুল মনসুর আহমদের লেখায় এ সময়ের বিবরণ আমরা পাব। আমাদের এ–ও মনে রাখতে হবে যে নারীবাদ বা নারী আন্দোলনের তত্ত্বগত আলোচনা সুফিয়া কামাল করেননি। তাঁর সব বক্তব্য ও চিন্তা মূলত ব্যক্তিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে উদ্ভূত। তিনি যতখানি অনুশীলনের ততখানি তত্ত্বের নন। 

নারীকে সুফিয়া কামাল দেখেছেন মাতৃপ্রতীকে। পৃথিবী নিজেই তাঁর কাছে মাতৃরূপে ধরা দিয়েছেন। ‘নারী ও ধরিত্রী’ কবিতায় যেমন দেখিয়েছেন পৃথিবীর দুই রূপ—মাতা ও দুহিতা; এই কবিতায় নারীকে দেখিয়েছেন জননী, ভগিনী, বধূরূপে; যে ‘গৃহে ও বাহিরে করে কর্মক্ষেত্র’ প্রসারিত। পুরুষের কাঠোর সংগ্রামে নারীই দীপ্ত প্রেরণা। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে নারীর কোনো সামাজিক সক্রিয়তা নেই। নারী তাঁর কাছে মহীয়সী ও অনন্যা। মাটির মতো নারী যেন মমতারও প্রতীক। আবার ‘যবে সে বাহিরে আসে সংসার সংগ্রামে/ অ-কম্পিত পদে পথে নামে।’ কল্যাণ ও মঙ্গলের বার্তা বহন করে উৎপীড়নের বিরুদ্ধে ‘অনন্যা’ নারী হয়ে ওঠে বজ্রকণ্ঠ, ‘সে তখন সকলের অকথিত কথা/ বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিয়া দিকে দিকে পাঠায় বারতা।/ সে আহ্বানে সাড়া দিবে মৌন মূক পুরুষ রমণী/ দিকে দিকে বাজিবে সে ধ্বনি।’ রোকেয়াবিষয়ক প্রশস্তিমূলক কবিতায়ও তিনি পেশ করেছেন ‘মাতৃস্বরূপা কল্যাণী’ নারীর ধারণা। রাশিয়ায় কলকারখানা, ট্রেড ইউনিয়নে নারীদের ‘শক্তিময়ী রূপ’ দেখে তাঁর অনুভূতি, ‘মা হিসেবে নারী জাতির এই উন্নতিতে আমি গৌরব বোধ করছি।’ 

বাংলাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতির প্রবহমানতায় সুফিয়া কামাল নিজেও হয়ে উঠেছিলেন ‘মাদার ফিগার’। ১৯৯২ সালে লেখা ‘নারী’ নামের ছোট্ট একটি কবিতায় তিনি নারীকে বলেছেন ‘মাতা মহীয়সী’, ‘সর্বংসহা জননী’। তাঁর লেখায় নারী প্রধানত এই রূপেই উপস্থাপিত। মাতৃত্বকে নারীর সংকট, সমস্যা কিংবা দুর্বলতা হিসেবে দেখার প্রবণতা থেকে ভিন্ন তাঁর উপস্থাপনা। মাতৃত্ব ও মাতৃপ্রতীক তাঁর লেখায় বরং মহিমান্বিত। তবে মহিমার টানে পিছু হটে গিয়ে নারী ঘরকেই নিয়তি হিসেবে বেছে নেয়নি। সুফিয়া কামালের ব্যক্তিজীবনে তাকালে দেখি, একই সঙ্গে তিনি সামলে নিচ্ছেন ঘর ও বাহির। একাত্তরের ডায়েরীতে দেখা যাচ্ছে রিলিফ ক্যাম্পে ঘুরছেন তিনি, গ্রামে গ্রামে রিলিফ বিতরণ করছেন। লেখক সংঘের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সন্তানদের রেখে চলে গিয়েছেন করাচি। পিছু ছাড়েনি ‘জননী ও বধূ’র উৎকণ্ঠা, ‘আল্লাহ জানেন উনি, জামাল, আলভী, লুলু, টুলু, শমু এতক্ষণে ঘরে ফিরে কী করছে!’ ঘর ও জনপরিসরের মধ্যে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থা। 

 সুফিয়া কামালের সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পুরুষতন্ত্রের সব স্তম্ভকে ধসিয়ে দেয় না। নারীর মতো পুরুষও তাঁর সহচর। সোভিয়েত রাশিয়ায় ভ্রমণের স্মৃতির সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন এ রকম উক্তি, ‘ভাষার জন্য, স্বাধীনতার জন্য, মারী-মড়কে, দুর্ভিক্ষে, সংগ্রামে আমার দেশের ছেলেরা মেয়েরা এক সাথে এগিয়ে এসেছে।’ আবার এই প্রশ্নও তাঁর মনে জেগেছে, ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের শহীদ দেশভক্ত সন্তানদের স্মৃতি আমাদের কোথায়? ভাষা আন্দোলনের মা-বোন-বধূরা আছে? তারা কারা? এসব কি আমাদের ইতিহাসে থাকবে?’ সংশয় ছিল যে, নারীর অংশগ্রহণের ইতিহাস লিখিত হবে তো! নাকি, history পরিণত হবে his Story-তে, যে ইতিহাস কেবলই পুরুষের? 

একালে আমাদের কাল ও একাত্তরের ডায়েরী—সুফিয়া কামালের এই দুই আত্মস্মৃতিতে আছে তাঁর ঘর ও বাহিরের বিবরণ। ছবি: সংগৃহীত
একালে আমাদের কাল ও একাত্তরের ডায়েরী—সুফিয়া কামালের এই দুই আত্মস্মৃতিতে আছে তাঁর ঘর ও বাহিরের বিবরণ। ছবি: সংগৃহীত

যৌথতার ইতিহাস
সুফিয়া কামালের আকাঙ্ক্ষা নারী ও পুরুষের যৌথ যাত্রায় নির্মিত হবে ভবিষ্যতের ইতিহাস। হয়তো তাই জীবনের প্রতিটি পর্বে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বাধা সত্ত্বেও পুরুষকে শত্রুজ্ঞান করে দূরে ঠেলে দেননি। তাঁর অবস্থান প্রকৃতপক্ষে উদার মানবিকতাবাদী; অবশ্য রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ তাঁকে মুগ্ধ করেছে। এ ব্যবস্থায় নারী হিসেবে এককভাবে শিশুর দায়িত্ব পালনের ভার বইতে হয় না বলে তিনি স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। 

রোকেয়া যেভাবে পুরুষতন্ত্রের ভিত্তি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন, সে রকম প্রশ্নও তোলেননি সুফিয়া কামাল। ধর্ম প্রসঙ্গে তাঁর কঠোর কোনো সমালোচনা নেই। ইসলাম তাঁর বিশ্বাস ও চর্চার অংশ। ইসলামের শাস্ত্রীয় বয়ানে থাকা নারী-অধিকারকে সমর্থন করেছেন। আবার ইসলামের ধর্মবোধ থেকেই তিনি মিশে গিয়েছেন সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষের সঙ্গে। তাই হিন্দু-খ্রিষ্টান নারীদের সঙ্গে কাজ করতে তাঁর কোনো দ্বিধা ছিল না। ধর্ম, শ্রেণি ও সম্প্রদায়-নিরপেক্ষতা ও নারী-আন্দোলনকে তিনি বাঁধতে পেরেছিলেন একটি সুতোয়। সম্ভবত মাতৃত্ববোধই সে সুতো। ফলে নাস্তিক, ধর্মবিরোধী, রাজনৈতিক কিংবা পুরুষবিদ্বেষী অভিধা দিয়ে তাঁকে বাতিল করতে পারেনি কোনো প্রতিপক্ষই। 

প্রতিপক্ষের প্রতি নীরব এক প্রত্যাখ্যানের ভাষা ছুড়ে দিয়ে আপন কর্তব্যে মগ্ন থেকেছেন সুফিয়া কামাল। দেশ-জনতার গভীর সংকটে নিজের/নারীর মাতৃমূর্তি দিয়ে প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন সবাইকে। তাঁর সেই মাতৃরূপ নারী ও পুরুষের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করেনি; দারুণ এক যৌথ চেতনার দ্বারা স্পিরিচুয়ালি সেটি হয়ে উঠেছে সম্মিলিত মানবতার পারস্পরিক সমঝোতা। সুফিয়া কামালের সাহিত্য ও সামাজিক কর্মকাণ্ড মূলত এ অনুভবেরই এক মহাকাব্যিক বিস্তার। তাঁর জীবন ও কর্ম আমাদের জানান দেয়, নারী-পুরুষের উভয়েরই ঘর আছে, বাহিরও আছে, সম্মিলনেই মুক্তি। নারী-আন্দোলন মোটেও অরাজনৈতিক কোনো বিষয় নয়; নারীর লড়াই একলার নয়, এক আধিপত্যের বিরুদ্ধে আরেক আধিপত্য কায়েমের নয়, মানুষের সামগ্রিক মুক্তির। কর্ম ও অনুশীলনই সুফিয়া কামালের তত্ত্বরূপ। নারী-পুরুষের সহাবস্থান ও সহনশীলতার পাঠ নেওয়ার ক্ষেত্রে আজও তাই প্রাসঙ্গিক তিনি।