'ভালো-বাসা'র নবনীতা, ভালোবাসা নবনীতা

নবনীতা দেবসেনের শেষ যাত্রায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর দুই মেয়ে অন্তরা ও নন্দনা দেবসেনসহ গান গাইছেন শিল্পী মৌসুমী ভৌমিক (বাঁ থেকে দ্বিতীয়), ৮ নভেম্বর ২০১৯। ছবি: লেখক
নবনীতা দেবসেনের শেষ যাত্রায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর দুই মেয়ে অন্তরা ও নন্দনা দেবসেনসহ গান গাইছেন শিল্পী মৌসুমী ভৌমিক (বাঁ থেকে দ্বিতীয়), ৮ নভেম্বর ২০১৯। ছবি: লেখক

কলকাতা আসব শুনে ময়মনসিংহবাসী গভীর নবনীতা-পাঠক চিকিৎসক রনি শাহ আতিকুল হক অনুরোধ করলেন, দিদির কোনো বইয়ের পাতায় যেন তাঁর জন্য অটোগ্রাফ নিয়ে আসি। ঠিক সেই সময়টাতেই পড়ছিলাম নবনীতা দেবসেনের শেষের সেই সুন্দর-ভয়ংকর লেখা ‘অলরাইট, কামেন ফাইট! কামেন ফাইট’।

রবীন্দ্রনাথের ন্যায় জীবনরসিক নবনীতা (যাঁর নাম রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ) মৃত্যুকেও বরণডালা সাজিয়ে আবাহন করেছেন তাঁর সকল রসের ধারায়। শরীরে ঘাতক কর্কটের বীজ বহন করে তিনিই একমাত্র বলতে পারেন, ‘এই যে এত লম্বা জীবনটা কাটালুম, এর একটা যথাযথ সমাপন তো দরকার! পাঁজিপুথি দেখে, শুভ দিন, শুভ লগ্ন স্থির করে স্বজন–বান্ধবকে খাইয়ে তবেই তো শুভযাত্রা!’

কবিতা দিয়ে সাহিত্যিক শুভযাত্রা নবনীতা দেবসেনের (১৩ জানুয়ারি ১৯৩৮—৭ নভেম্বর ২০১৯)। ১৯৫৯-এ একুশে পা, সে বছরই প্রকাশ পেল প্রথম প্রত্যয়। কেমন ছিল তাঁর প্রারম্ভিক উচ্চারণ?

‘প্রথম পাপের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন পুণ্য’

(মন্দির, প্রথম প্রত্যয়) 

কিংবা,

হয়তো ছকে তোমার চেনা ঘুঁটি

এবং খেলা তোমার স্থির জয়

তবুও আমি চতুরতর জুটি

আমার হারে তোমার জিৎ নয়। 

(খেলা, প্রথম প্রত্যয়)

 ১৯৫৯-২০১৯; প্রথম পুস্তক প্রকাশের হীরকজয়ন্তীর বছরেই অচিনলোকের পথে পা বাড়ালেন তিনি। অচিনলোক তো নয়, যেন দেশ–বিদেশের সুগম-দুর্গম পথে ঘুরতেই গেছেন নবনীতা; ফিরে এসে লিখবেন করুণা, তোমার কোন পথ দিয়ে, ট্র্যাকবাহনে, ম্যাকমোহনে, হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে, যাবই যাব পেরু, ভ্রমণের নবনীতার মতো পায়ের তলার সর্ষে-সরস আখ্যান। কিন্তু না, এবার যে আর তা হওয়ার নয়, কলকাতায় বসে সে খবর পেলাম ৭ নভেম্বর রাতে সন্দীপন চক্রবর্তীর করুণ কণ্ঠে, ‘শুনেছ খবরটা? নবনীতা দেবসেন প্রয়াত।’ কবি নরেন্দ্র দেব আর কবি রাধারাণী দেবীর ‘ভালো-বাসা’ বাড়িটাকে তাঁদের কৃতীকন্যা নবনীতা তাঁর অক্ষর-তুলিতে এত মায়াময় রূপছবি করে এঁকেছেন যে কলকাতার হিন্দুস্তান পার্কের ওই বাড়িতে কখনো না গেলেও আমার মনোপটে ইতিমধ্যেই অঙ্কিত ছিল তার ছবি। তাঁর প্রয়াণের খবর শুনে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম ‘ভালো-বাসা’র পানে, যদিও শুনতে পেলাম কাছের মানুষ ছাড়া খুব কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না বাড়ির ভেতরকার শেষ শ্রদ্ধাপর্বে। তবু ভয় কী! আমি তো তাঁর পাঠক। পাঠকের মতো লেখকের কাছের মানুষ আর কে আছে এই ভুবনে? এমন ভরসায় বুক বেঁধে দেখি মানুষ আর মিডিয়ায় মুখর নিভৃত ‘ভালো-বাসা’ বাড়ির সামনেটা। ক্যামেরার লাইট আর রিপোর্টারের বাইট—মিলেমিশে এমন ধুন্ধুমার অবস্থা যে শোকের মাঝেও আমার মনে হচ্ছিল নবনীতা দেবসেন এটা নিয়ে একটা জবরদস্ত রম্য লেখাই লিখে ফেলতে পারতেন; যেমন রুপালি রম্যতা ছড়ানো—শব্দ পড়ে টাপুর টুপুর, ঘুলঘুলি, ৪ খণ্ডের ভালো-বাসার বারান্দা, নবনীতার নোটবই কিংবা নটী নবনীতায়। একটু পড়ি:

‘একবার আমার শ্বশুর-শাশুড়ি এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। ভদ্রমহিলা দরজা খুলেই বললেন “এই সেরেছে! আবার দু’কাপ?” তারপর ভীষণ লজ্জা পেয়ে ব্যস্ত হয়ে বলতে লাগলেন, “আসুন! আসুন! কদ্দিন পরে এলেন—কিছু মনে করবেন না, আমার একটা মানসিক রোগ হয়েছে, মনের কথাটা মুখে বেরিয়ে পড়ে।
ঘরে চিনি বাড়ন্ত কিনা, তাই ও রকম
বলে ফেলেছি।” আর মনেটনে
করবেন কী। এঁরা এখন পালাতে পারলে বাঁচেন।’

(মনে আর মুখে, নটী নবনীতা) 

এহেন রসের স্ফূর্তি আর বুদ্ধিগহন দীপ্তির যথামিলনে টইটম্বুর তাঁর ভাষাবাক্যের বাড়িঘর। বিশ্বের নামকরা বিদ্যাঞ্চলে শিক্ষা লাভকারী পণ্ডিত তিনি। তবে লেখায় পাণ্ডিত্যের উৎকট প্রদর্শপ্রত্যাশা নেই মোটেও, আছে হিংসার ধারাবিবরণীময় গ্রহগৃহে ‘ভালো-বাসার বারান্দা’ নির্মাণপ্রয়াস।

৮ নভেম্বর সকালে ‘ভালো-বাসা’ বাড়ির দোতলায় গিয়ে দেখি ঘরভর্তি মানুষের মাঝখানে শুয়ে আছেন নবনীতা, তাঁর দর্শনে এসেছেন শঙ্খ ঘোষ, অমিয় দেব, পবিত্র সরকার, বাণী বসু, শ্রীজাত, পায়েল সেনগুপ্ত, সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়সহ আরও কত কে! শিশুসাহিত্য দীপ মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, তিনি এই পাড়ারই ছেলে, নবনীতাদি তাঁর প্রতিবেশী। প্রতিবেশী ছিলেন ‘কাজলা দিদি’র কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীও; পাশের ‘ইলা নিবাস’ বাড়িটি তাঁর স্মৃতিবাহক। আর প্রতিবেশী তো নবনীতা, বাংলাভাষী পাঠকের মনবাড়িরও। শুয়ে আছেন, গায়ে ফুলের বসন, চোখে মোটা ফ্রেমের সেই চিরচেনা চশমা। মুখে স্মিত হাসি, যে হাসিমুখের সঙ্গে আমার ঢাকায় দেখা হয়েছিল ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, বাংলা একাডেমি আয়োজিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের এক ফাঁকে, মিলনায়তনে পাশের আসনে বসে কিছু কথা বিনিময় হলো কেবল। সেবারই প্রথম আলোতে আহমাদ মাযহারকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে কথা বলে ভালো লেগেছে বেশ। আমি বিস্মিত। কলকাতা ফিরে গিয়ে তাঁর নিয়মিত কলাম ‘ভালো-বাসার বারান্দা’তে–ও লিখলেন, ‘ঢাকায় গিয়ে যাদের সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগল, তাদের একজন পিয়াস...’। আমি মহাবিস্মিত। অল্প আলাপেই এমন কাছের করে নিতে পারতেন যিনি, সেই মানুষটা আজ দূরে চলে যাবেন! মানতে পারছিলেন না অনেকেই। পারছিলেন না কন্যা অন্তরা দেবসেনও। কে একজন বলল, শ্রদ্ধা নিবেদনার্থে মরদেহ যাদবপুরে নিয়ে যেতে গাড়ি তৈরি আছে। অন্তরা উদ্​গত অশ্রু মোচন করতে করতে ঈষৎ হেসে বললেন, ‘বাহ, কেমন সহজে বলা হলো, গাড়ি তৈরি আছে। যেন মা-ই বলছেন, আমি তৈরি আছি। ড্রাইভার, গাড়ি বের করো।’ মাতাহারা আত্মজার দীর্ঘশ্বাস কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধতার অনুবাদ করার অবকাশ খুঁজল সেই শোকার্ত আবহাওয়াতে।

থেমে গেছে নবনীতার জীবনগাড়ির চাকা আর তাঁকে শবগাড়িতে ওঠাতে বন্ধু-স্বজন-পাঠকসকলের আকুল কান্নায় সায় দিল হেমন্তের অকালবৃষ্টির আকাশও। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘সই সমিতি’র সদস্যসহ আত্মার আত্মীয়সভার সবাই গেয়ে উঠল, ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে তুমি আরও আরও মোরে দাও প্রাণ...’। প্রাণের মানুষ এভাবে চলে গিয়েও থাকে প্রাণে। আমি অতঃপর নবনীতা বসুহক-ইমানুল হকের সহৃদয় শকটে চললাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানকার তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের সুপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন তিনি। তাঁর প্রিয় এই পীঠস্থান। সেই পাঠস্থানে সমবেত শোকার্তজনের মধ্যে দেখা গেল শিল্পী মৌসুমী ভৌমিককেও। দুই কন্যা অন্তরা ও নন্দনা দেবসেনসহ সবাই মিলে ধরলেন নবনীতার প্রিয় জোয়ান বয়েজ:

‘হাউ দ্য উইন্ডস আর লাফিং

দে লাফ উইথ অল দ্য দেয়ার মাইট

লাফ অ্যান্ড লাফ দ্য হোল ডে থ্রো

অ্যান্ড হাফ দ্য সামার’স নাইট

ডোনা ডোনা ডোনা ডোনা

ডোনা ডোনা ডোনা ডন

ডোনা ডোনা ডোনা ডোনা

ডোনা ডোনা ডোনা ডন।’

দূর ইড্ডিশ ভাষার সংগীত-স্রোত যেন নবনীতার অনুষঙ্গে আছড়ে পড়ল বাংলার কূলে; মৃত্যু উজানো হাওয়ার হাসির কথাই যেন জোয়ান বয়েজ ফের বলে গেলেন নবনীতার মৃতদেহের নেপথ্যে বসে। কে একজন মৌসুমী ভৌমিকের কানে কানে বলল, ‘কালবৈশাখীর সময় আমাদের নিয়ে উনি যে গানটা করতেন, ওটা ধরো না...’। অতঃপর সবার সঙ্গে ‘আকাশভরা সূর্যতারা, বিশ্বভরা প্রাণ’–এর শরণ ও শপথ নিয়ে আমি আর কবিবন্ধু অরুণাভ রাহারায় নবনীতা-চর্চা করতে করতে মেট্রোতে চললাম পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির লোক-উপচানো অঙ্গনে; নবনীতাকে সারস্বত সমাজের পক্ষে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে, যেখানে সমবেত জয় গোস্বামী, শাঁওলী মিত্র, সুধাংশুশেখর দে, ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়, প্রসূন ভৌমিক প্রমুখ। আর তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে মেঘলা আকাশও গাইছে শোকস্বরে আর বিষাদিত সুরে। এরপর নবনীতাদি কেওড়াতলা শ্মশানের দিকে। আগুনে পুড়ে ছাই হয় হয়তো শরীর–নশ্বর, তার চেয়ে বেশি রয়ে যায় কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গবেষণা, রম্যরচনা, ভ্রমণকথা, অনুবাদ, শিশুসাহিত্যের অনশ্বর সব সোনার সৃষ্টি।

তাঁর গ্রন্থাদির মধ্যে রয়েছে কবিতা—প্রথম প্রত্যয়, স্বাগত দেবদূত, তুমি মনস্থির করো; উপন্যাস—আমি, অনুপম, প্রবাসে দৈবের বশে, অন্য দ্বীপ, স্বভূমি, শীত সাহসী হেমন্তলোক, একটি দুপুর, বামা-বোধিনী, দেশান্তর, ঠিকানা, মায়া রয়ে গেল, শনি-রবি, পাড়ি, উড়াল, তিতলি, অ্যালবাট্রস, একটি ইতিবাচক প্রেমকাহিনি, দ্বিরাগমন; গল্প—মঁসিয়ে হুলোর হলিডে, গল্প গুজব, খগেনবাবুর পৃথিবী এবং অন্যান্য; নাটক—অভিজ্ঞান দুষ্মন্তম; শিশুকিশোরসাহিত্য—পলাশপুরের পিকনিক, চাকুম চুকুম, স্বপ্ন কেনার সদাগর; অনুবাদ—শতেক বচন; প্রবন্ধ-গবেষণা—ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী, সীতা থেকে শুরু, চন্দ্রমল্লিকা এবং প্রাসঙ্গিক প্রবন্ধ, সম্পাদনা—রাধারাণী দেবীর শ্রেষ্ঠ কবিতা। 

স্মরণ করতে পারি, বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময়ী নবনীতা দেবসেন গল্প-উপন্যাসের মতোই তাঁর তীক্ষ্ণধার গবেষণাগদ্য ‘শশী ও রিউ-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও আলবের কামুর উপন্যাসে নির্বাসিত নায়কের ভূমিকায় ডাক্তার’–এ প্রমাণ করেন যে অ্যাবসার্ডিটি বঙ্গসাহিত্যে আমদানি করা বিষয় নয়, বরং বাংলার মানিক এ ক্ষেত্রে বিশ্বসাহিত্যেই পুরোধাপ্রতিম। নবনীতা দেবসেন সাহিত্যে ও সমাজে নারীর প্রাপ্য পরিসর খুঁজেছেন, আবার নারী–পুরুষ সম্পর্কের টানাপোড়েনকে ব্যক্তিগত জীবনাভিজ্ঞতার উদার-আলোকে ব্যক্ত করেছেন বৃহতের দরবারে। অমর্ত্য সেনের সঙ্গে তাঁর দাম্পত্য সম্পর্ক এবং একসময় এর ভাঙন নিয়ে তিনি কোনো আড়াল তৈরি করেননি, তাঁরা দুজনে শেষ পর্যন্ত ভালো বন্ধু ছিলেন আর নবনীতা ভাঙন নিয়ে করুণ-মধুর করে বলেছেন: ‘সংসারের কোনো কোনো বাসনকোসন, কাপপিরিচ সম্ভাব্য ভঙ্গুরতা অতিক্রম করে বিস্ময়করভাবে বহুদিন টিকে থাকে, কিন্তু একদিন হয়তো দেখা যায় যে জন্য এত আয়োজন, সেই সংসারটাই টেকে না, সম্পর্ক ভেঙে যায়।’ 

 নবনীতা দেবসেন এমন একজন লেখকমানুষ, যিনি সমস্ত ভাঙন-ভাটার বিপরীতে দাঁড়িয়ে এমন সৃজন-উজানের গান গেয়ে চলেন নিরন্তর, ঠিক যেন ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস আমি, অনুপম–এর এমন সংলাপবাক্যের মতোই: ‘কিন্তু সেই রিজেকশনেই তো ঠেকে থাকলে হবে না, যদি সেখানেই থেমে থাকো, তবে তুমি অবরুদ্ধ বয়ঃসন্ধির সমস্যায় ভুগছো বলে ধরে নিতে হবে। শিল্পের মূল লক্ষ্য তো পরিত্যাগ নয়, পুনরুজ্জীবন।’