নিঃসঙ্গ বন্দিজীবনের বয়ান ও একজন অ্যালবার্টের কথা

যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালবার্ট উডফক্স তাঁর কারাবাসের ৪৫ বছরে ৪৩ বছরই কাটিয়েছেন িনঃসঙ্গ েসলে। ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালবার্ট উডফক্স তাঁর কারাবাসের ৪৫ বছরে ৪৩ বছরই কাটিয়েছেন িনঃসঙ্গ েসলে। ছবি: সংগৃহীত
না, আমাদের দেশের জাহালমের ঘটনা নয়, ঘটনাটি যুক্তরাষ্ট্রের। বিনা অপরাধে সব মিলিয়ে ৪৫ বছর জেল খেটেছেন লুইজিয়ানার অ্যালবার্ট উডফক্স। এরপর নিজের জীবনের এই মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন সলিটারি শিরোনামের একটি বই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আলোচিত হয়েছে বইটি। এই গ্রন্থের সূত্রে এখানে থাকছে অ্যালবার্টের বন্দিজীবনের কার্যকারণ ও ইতিবৃত্ত, এর সঙ্গে থাকল তাঁকে নিয়ে লেখা একটি কবিতাও।

মুক্ত মানুষের পক্ষে ভাবা কঠিন কীভাবে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কয়েক দশক ধরে একটি নিঃসঙ্গ কারাপ্রকোষ্ঠে বন্দী অবস্থায় থাকা যায়। প্রতিদিনের নির্যাতনের কষ্ট নিয়ে হয়তো প্রতিবেদন লেখা যেতে পারে, বই রচনাও সম্ভব হতে পারে। কিন্তু কারাজীবনের কতটুকু শব্দে রূপান্তর করা যায়, বলা কঠিন। প্রায় অসম্ভব সেই কাজ সফলভাবে করেছেন অ্যালবার্ট উডফক্স।

সব মিলিয়ে ৪৫ বছর জেল খেটেছেন যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানার অ্যালবার্ট উডফক্স। তার মধ্যে ৪৩ বছর কেটেছে নিঃসঙ্গ সেলে—‘সলিটারি কনফাইনমেন্ট’-এ। বিনা অপরাধে তাঁকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন নিঃসঙ্গ কারাবাস (সলিটারি কনফাইনমেন্ট)। এই বন্দিজীবন নিয়ে তিনি যে বইটি লিখেছেন, তার নাম সলিটারি। তবে এর উপশিরোনাম বেশ বড়—‘আনব্রোকেন বাই ফোর ডিকেডস ইন সলিটারি কনফাইনমেন্ট। মাই স্টোরি অব ট্রান্সফরমেশন অ্যান্ড হোপ’। বইটির সহলেখক লেসলি জর্জ।

জাস্ট কল মি মাইক: আ জার্নি টু অ্যাক্টর অ্যান্ড অ্যাকটিভিস্ট অব মিউল অ্যান্ড ম্যান বইয়ের লেখক মাইক ফ্যারেল এই গ্রন্থ সম্পর্কে বলেন, ‘সলিটারি হচ্ছে একজন বীরের যাত্রার বিস্ময়কর রেকর্ড। যে জীবন সত্যিকার অর্থে শৃঙ্খলিত হয়ে কেটেছে, সেই জীবনের বলিষ্ঠ, অবিশ্বাস্য রকম বেদনাদায়ক এবং অত্যন্ত অনুপ্রেরণাদায়ক একটি কাহিনির মধ্য দিয়ে সাহসের সঙ্গে, কোনো ভণিতা ছাড়াই আমাদের নিয়ে গেছেন অ্যালবার্ট উডফক্স। পাঠক বুঝতে পারবেন যে তিনি একজন ইস্পাতে গড়া মানব। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে এই বই আমাকে ভীষণভাবে বিব্রত করে। আমাকে ক্রুদ্ধ করে।’

১৯৪৮ সালে লুইজিয়ানার নিউ অরলিন্সে জন্ম অ্যালবার্ট উডফক্সের। ছেলেবেলা কেটেছে দারিদ্র্যের মধ্যে। বাবাকে তিনি চিনতেন না। মায়ের কাছে শুনেছেন বাবা তাঁর মাকে ছেড়ে চলে গেছেন। পরে অ্যালবার্টের মায়ের আরেকজনের সঙ্গে বিয়ে হয়। সেটাও শেষ পর্যন্ত টেকেনি। এখানে তাঁর কয়েকজন ভাইবোনের জন্ম হয়। ফলে পুরো সংসারের দায়দায়িত্ব ছিল অ্যালবার্টের মায়ের। সংসার চালাতে নানা কাজের পাশাপাশি তাঁর মা পতিতাবৃত্তিও করেছেন। সাদাদের খুব ভয় পেতেন তাঁর মা। অ্যালবার্ট লিখেছেন, ‘সাদাদের অনেক ক্ষমতা আমাদের ওপরে।’

এই যখন সামাজিক বাস্তবতা, তখন কেমন ছিলেন অ্যালবার্ট? তিনি ছিলেন ‘লুম্পেন প্রলেতারিয়েত’ গোছের একজন। কবরস্থান থেকে ফুল চুরি করে বেচতেন। কৈশোরেই নানা ধরনের চুরির জন্য এবং কখনো শুধু কালো হওয়ার কারণে কারাগারে গেছেন তিনি। খুব অল্প বয়সেই বুঝেছেন, টিকে থাকার জন্য চলতে হবে বাঁকাচোরা পথে। যে কারণে দোকানে ঢুকে দুধ-রুটি চুরি করতেন অ্যালবার্ট। এর পরিণতিতে পুলিশের হাতে প্রায়ই ধরা পড়েছেন, পুলিশ টাকাপয়সা নিয়ে নিত, পেটাত। একপর্যায়ে একটার পর একটা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে থাকেন তিনি। এ সময় মাঝেমধ্যে তাঁকে জুভেনাইল হল ও সিটি লকআপে থাকতে হতো।

সলিটারি–এর প্রচ্ছদ
সলিটারি–এর প্রচ্ছদ

অ্যালবার্টের বয়স যখন ২২ বছর, সে সময় ডাকাতির অভিযোগে দীর্ঘ সময়ের জন্য লুইজিয়ানার অ্যাঙ্গোলা কারাগারে যান তিনি। তবে ‘ভালো ব্যবহার’ করলে তাঁর শাস্তি অর্ধেক কমে যেতে পারে, এই ছিল তাঁর আশা। এরপর জেলে থাকা অবস্থায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলো তাঁর। চমকপ্রদ তথ্য হলো, যে কারণে তাঁকে যাবজ্জীবন দেওয়া হলো, তা ছিল নির্জলা মিথ্যা—শ্বেতাঙ্গ এক কারা প্রহরীকে হত্যার অভিযোগ। মিথ্যা বিচারসভা সাজিয়ে, কোনো প্রমাণ ছাড়াই যাবজ্জীবন দেওয়া হলো অ্যালবার্ট উডফক্সকে। ‘আমি কী করেছি না করেছি সেটা কোনো কথা নয়, আমি কে সেটাই হলো কথা এবং সে জন্যই আমি কারাগারে।’ নিজের কারাবাস নিয়ে বইয়ে এমনই মন্তব্য করেছেন অ্যালবার্ট। তাঁর সঙ্গে একই কারাগারের ‘সলিটারি কনফাইনমেন্ট’-এ ছিলেন আরও দুজন—একজন একই অভিযোগে অভিযুক্ত, আরেকজন ভিন্ন আরেকটি হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত। কারাগারে তাঁরা তিনজন পরিচিত হন ‘অ্যাঙ্গোলা থ্রি’ নামে।

বিভিন্ন সময় কারাবাসেরকালে ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’দের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর থেকে জীবনে বদলে যেতে থাকে অ্যালবার্ট উডফক্সের। একে একে ডু বয়েস, ফ্রান্স ফেনো জেমস বল্ডউইন, ফ্রেডরিক ডগলাস এবং অন্যদের বই পড়তে শুরু করেন তিনি। এ সময়েই পড়েছেন কালো মানুষের ইতিহাস, বুঝেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থার বর্ণবাদী রূপ ও পুলিশের বর্ণবাদ সম্পর্কে। সাধারণ ও অপরাধ আইনের বইও তখন তিনি পড়েছেন। অ্যাঙ্গোলা কারাগারে আলবার্ট দেখেছেন দাসব্যবস্থার ধারাবাহিকতা। অন্যায়, নিপীড়নের বিরুদ্ধে কারাগারে অসংখ্যবার অনশন করেছেন তিনি। পাল্টে দিয়েছেন অনেকের জীবনও। এ সময় তাঁর এমন এক জীবনদর্শন গড়ে ওঠে, যা তাঁকে কারাজীবনের অবর্ণনীয় নির্যাতন আর দুঃসহ সময়কে সহ্য ও অতিক্রম করার শক্তি জোগায়। বইয়ে নিজের জীবনের বঞ্চনা ও নির্যাতনের কথা বলতে বলতে আ্যালবার্ট স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এমন হাজারো মানুষের কথা, যুক্তরাষ্ট্রে যারা ‘সলিটারি কনফাইনমেন্ট’-এ রয়েছে এবং ভোগ করছে নির্যাতনের আধুনিক রূপ।

ফিয়োদর দস্তয়েভস্কি তাঁর দ্য হাউস অব দ্য ডেড উপন্যাসে বলেছিলেন, ‘একটি সমাজ কতখানি সভ্য, তা নির্ণয় করা যায় তার জেলখানায় ঢুকলে।’ অ্যালবার্টের কারাজীবন আমাদের কাছে যেন এক ‘সভ্য’ দেশের ‘অসভ্যতা’র সত্যই তুলে ধরে।

সলিটারি নামের বইয়ে অ্যালবার্ট উডফক্স অকপটভাবে বলেছেন নিজের বন্দিজীবনের কথা। পাশাপাশি ‘সলিটারি’ অপরাধী বিচারব্যবস্থার নিষ্ঠুরতার তীব্র সমালোচনাও তিনি করেছেন। সব মিলিয়ে এই বই যেন আমাদের কাছে হয়ে উঠেছে বিরুদ্ধ পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনের শক্তি আর জয়ের অদম্য ইচ্ছার প্রতীক।

অ্যালবার্ট এখনো স্বপ্ন দেখে

আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী

চার দশকের বেশি

কেটেছে জেলখানায়,

অ্যাঙ্গোলা জেলের নির্জন

ন ফুট বাই ছ ফুট সেলে

প্রতিদিন তেইশ ঘণ্টা বন্দী। 

মা তুমি প্রায়ই জিজ্ঞেস করতে

অ্যালবার্ট, কবে তুমি ছাড়া পাবে?

এই করতে করতে তোমার

আয়ু গেল ফুরিয়ে,

নিউ অরলিন্সের গ্রেভইয়ার্ডে

যাওয়া হয়নি আমার,

তোমাকে গুডবাই না বলার ভার

সয়েছি বহুকাল,

বড্ড হেভিওয়েট সেই ভার।

কালেভদ্রে কেউ জানতে চাইত

কী করে কাটছে সময় সেলে,

আমি আমার মতো

নিজেকে নিয়েছি গুছিয়ে,

সেলকে রূপান্তরিত করেছি

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে,

নিঃসঙ্গ বিতর্কের প্ল্যাটফর্মে,

আইনের আলোকিত স্কুলে,

নির্যাতন আর নৈরাশ্য

তিক্ত ক্রোধ

ক্লস্ট্রোফোবিয়া

কোনো কিছুতে ভেঙে যাইনি আমি,

সেলের সালাখোঁ দিয়ে দেখতাম

রোজ ভোরবেলা

একটা সংবাদপত্রের গাড়ি

এসে দাঁড়াত,

তার জ্বলে থাকা হেডলাইট

আমাকে জানান দিত

একদিন বাইরে আসবে তুমি,

হবে সংবাদের লিড হেডলাইন,

আমি বাঙ্কে বসে

অপেক্ষা করতাম

রাতের আকাশ দেখব বলে

যেখানে তারায় তারায়

মিশে আছে আমার মা। 

অপরাধ নেই

তবু এক সাগর সময় হলো গুজার

গুমোট সেলের অন্ধকারে,

‘চার পা পেছনে, চার পা সামনের’

সেল থেকে আজাদ হলাম

সত্তর-ছোঁয়া বয়সে,

পাক ধরেছে চুলে,

কিন্তু চোয়াল হয়েছে দৃঢ়,

কবজি হয়নি কমজোর,

আজও আমি স্বপ্ন দেখি

বর্ণদ্বেষমুক্ত সমাজের,

যেখানে মানুষ নেবে

তিমির হননের পাঠ,

যেখানে ঋজু হবে

নুয়ে পড়া কালো মানুষ,

মুক্ত হবে বন্দী বিবেক,

কৃষ্ণজনের রুদ্ধ সংগীত।