কিংবদন্তির কমলকুমার

‘লেখকদের লেখক’ তিনি—কমলকুমার মজুমদার। খ্যাতিমান এই ঔপন্যাসিক জীবদ্দশায়ই হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি পুরুষ। সৃষ্টিতে, আড্ডায়, পাণ্ডিত্যে, রসিকতায়, পরনিন্দা–পরচর্চায়, নতুন নতুন কাহিনি সৃষ্টি করতে করতে তিনি নিজেই পরিণত হয়েছিলেন বিভিন্ন কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্রে। ১৭ নভেম্বর ছিল এ লেখকের জন্মদিন। তাঁর জীবনের দিকে ফিরে তাকিয়ে জানা যাক চমকপ্রদ কয়েকটি কাহিনি। বিভিন্ন সূত্র ঘেঁটে কমলকুমার মজুমদারের কিংবদন্তি কাহিনিগুলো জানাচ্ছেন শোয়াইব জিবরান

হাতের লেখা বিশেষজ্ঞ
ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী আর দুরন্ত ছিলেন কমলকুমার। ৭–৮ বছর বয়সে কমলকুমার ও তাঁর ভাই নীরদ মজুমদারকে বিষ্টুপুর শিক্ষাসংঘে ভর্তি করা হয়েছিল। তবে তাঁরা ছিলেন দুষ্টুর শিরোমণি। বাবার স্বাক্ষর নকল করে রোজ রোজ ছুটি নিতেন। শেষে একদিন হোস্টেল সুপারকে মেরে খাবার টেবিলের সব খাবার, কাচের প্লেট সব ছুড়তে ছুড়তে স্কুল ছেড়েছিলেন। তারপর দুভাইকে ভর্তি করা হয়েছিল সংস্কৃত টোলে। সেখানে সংস্কৃত শেখার চেয়ে তাঁদের উৎসাহ ছিল নানা রকম মজার কাণ্ডে। টোলে ভর্তি হয়েই মাথা ন্যাড়া করে টিকি রাখেন দুই ভাই। মা জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন, টোলে পড়লে অমনি টিকি রেখেই পড়তে হবে। না হলে সংস্কৃত শেখা যাবে না। ফ্রেঞ্চ শিখতে গিয়েও অমন নানা কাণ্ডকারখানা করেছিলেন। একসময় দুই সহোদরকে স্কুল ছাড়িয়ে পাঠানো হয়েছিল হাতের লেখা বিশেষজ্ঞের কাছে। বাবার স্বাক্ষর নকল করা ছাত্রকে বিশেষজ্ঞ সাহেব প্রথম দিন পরীক্ষার পরই বলেছিলেন, ‘এ তো অলরেডি এক্সপার্ট!’

পোশাক যখন চেনার চিহ্ন
যৌবনের সূচনায় জাহাজের আমদানি-রপ্তানি, মাছের ভেড়ি, ডিডিটি প্রভৃতি ব্যবসায় জড়িয়েছিলেন কমলকুমার। কাঁচা টাকাও হাতে এসেছিল। চলাফেরা, পোশাক–আশাকে একদম সাহেব হয়ে উঠেছিলেন। কথাবার্তায়, চালচলনে তাঁর প্রিয় অভিনেতা চার্লন বারকে অনুসরণ করতেন। তাঁকে দেখে মার্শেল স্মিথ বলেছিলেন, জিন্নাহর পর এত ওয়েল ড্রেসড ভারতীয় আর তিনি দেখেননি। কিন্তু তাঁর এ সাহেবিভাব বেশি দিন থাকেনি, বেহিসাবিপনার জন্য দ্রুতই সব কিছুর পতন ঘটে। পরিণত বয়সে তিনি সব সময় পাঞ্জাবি–ধুতি পরতেন। তবে নতুন পাঞ্জাবি পেলেই অদ্ভুত কাণ্ড করতেন। তিনি পান খেতেন। সেই পানের পিক দিয়ে প্রথমেই জামার বুকের দিকটায় দাগ দিয়ে নিতেন।

সিনেমাকাণ্ড এবং কমল–সত্যজিৎ উবাচ
চল্লিশের দশকের শুরুতে কফি হাউসে কলকাতার চলচ্চিত্র আন্দোলনকর্মীদের যে আড্ডা জমে ওঠে, তার নাটের গুরু ছিলেন কমলকুমার মজুমদার। কমলকুমার, সত্যজিৎ, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, পরিতোষ সেন, চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়দের এ আড্ডা থেকেই গঠিত হয়েছিল ‘ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি’। সোসাইটির উদ্যোগে ঘরে বাইরে উপন্যাসটি চলচ্চিত্র করার পরিকল্পনা করা হয়। কমলকুমারকে দায়িত্ব দেওয়া হয় শিল্প নির্দেশনার। সত্যজিতের দায়িত্ব ছিল চিত্রনাট্য রচনার। এরপর শরৎচন্দ্রের অভাগীর স্বর্গ আর রবীন্দ্রনাথের দেবতার গ্রাস চলচ্চিত্রের জন্য দুই হাজারের বেশি স্কেচ করেছিলেন কমলকুমার। এর কোনোটিই সে সময় শেষ পর্যন্ত আর নির্মিত হয়নি। একমাত্র নির্মিত হয়েছিল পথের পাঁচালীত্যজিৎ রায়ের এ ছবির ডিটেলের কাজগুলো কমলকুমারের। তবে মজার তথ্য হলো, পথের পাঁচালী পরে বিশ্বজয় করলে সেটা কমলকুমারের একদম পছন্দ হয়নি।

কমলকুমার মজুমদার (১৭ নভেম্বর ১৯১৪—৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯)। ছবি: সংগৃহীত
কমলকুমার মজুমদার (১৭ নভেম্বর ১৯১৪—৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯)। ছবি: সংগৃহীত

প্রায় একই রকম প্রতিক্রিয়া তিনি দেখিয়েছিলেন বিখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্রকার জাঁ রেনোয়ার দ্য রিভার চলচ্চিত্র নিয়ে। জাঁ রেনোয়া চলচ্চিত্রটি শুটিং করতে কলকাতায় এলে কলাপাতায় পিঠা মুড়িয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হোটেলে গিয়েছিলেন কমলকুমার। হোটেলে গিয়ে রেনোয়াকে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে ছবি করতে হলে হোটেলে থাকলে চলবে না। লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করতে হবে, রাস্তঘাটে ঘুরতে হবে, রোদে পুড়তে হবে, একপেটে খেয়ে গরমকালে বটগাছের ছায়ায় ঘুমুতে হবে, জলে ভিজতে হবে, গঙ্গার রূপ দুচোখ ভরে দেখতে হবে।’ রেনোয়া ছবিটি পরিশ্রম করেই বানিয়েছিলেন। তারপর ছবিটি যখন নাম করল, এ বিষয়ে একটি বাক্যও আর ব্যয় করেননি কমলকুমার! এমনকি ছবিটি একবার দেখতেও চাননি তিনি। তবে সত্যজিতের বেশুমার অনুরোধের পর ছবিটি দেখে কমলকুমার কেবল বললেন, পুরো ছবিতে দুর্গা-অপু চিনিময়রার পেছনে ছুটছে, ওই দৃশ্যটুকু ভালো লেগেছে। পরে সত্যজিৎ বলেছিলেন, ছবি বানিয়ে কমলবাবুকে তৃপ্ত করার মতো ক্ষমতা আমার নেই। কমলকুমার একসময় সত্যজিতের সঙ্গে যোগাযোগও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বাসায় যান না কেন— জিজ্ঞেস করলে সত্যজিৎকে কমল বলেছিলেন, আপনার বাড়িতে আজকাল ভদ্দর লোকদের খুব আনাগোনা। এরপর সত্যজিৎ তাঁকে বলেছিলেন, ঠিকাছে আপনি যেদিন যাবেন আগে বলে রাখবেন, দু–চারটে ছোটলোকও আনিয়ে রাখব।’

শেষ বয়সে তীব্র হাঁপানিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন কমলকুমার। হাঁপানির জন্য কী করেন? সত্যজিৎ একবার এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে কমলকুমার বললেন, ‘শীতের রাতে জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকি, চিকিৎসে করাই না, সাফারিংয়ের মধ্যে গ্র্যাঞ্জর আছে!’

পেঁপেগাছের নিচে নিন্দে
পরনিন্দা, পরচর্চা ও অপরের চরিত্রহরণকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন শিল্প পর্যায়ে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে রবীন্দ্রনাথ, সমকালীন কবি বুদ্ধদেব বসু থেকে অনুজপ্রতিম শক্তি-সুনীলদের নিয়েও ঠাট্টা রসিকতা করতে ছাড়তেন না। কিন্তু আড়ালে যাঁকে নিয়ে ঠাট্টা রসিকতা করতেন, দেখা গেল কাজের ক্ষেত্রে তিনি তাঁকেই সম্মান করছেন, সামনে এলে সম্মান করে কথা বলছেন। এ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ বলেছেন, ‘আপাতবিরোধী এতগুলো দিক তার মধ্যে ছিল, এমন আর কোন মানুষের মধ্যে দেখিনি।’

রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ছিলেন বলে রবীন্দ্রনাথকে ‘বেম্মো’ বলে অবজ্ঞা করতেন কমলকুমার। অথচ কমলকুমার প্রসঙ্গে শিল্পী শানু লাহিড়ী বলেছেন কমলকুমার প্রায় সময় হেলেদুলে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস নিয়ে ছবি বানানোর কথা ভেবেছেন, রবীন্দ্রনাথের নাটক অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে মঞ্চায়ন করেছেন।

আবার বিষ্ণু দে, সুধীন দত্ত ও বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে তাঁর ছিল প্রীতি-শ্রদ্ধার সম্পর্ক। রিখিয়ায় গেলে সুধীন দত্ত কমলকুমারের বাড়িতেই উঠতেন। অথচ সুধীন দত্ত সম্পর্কে আড্ডায় বলেছেন, ‘বুঝলেন বাবু, আপনাদের সুধীন দত্ত একটা চোর।’ ত্রিশ-চল্লিশের দশকের কবি–সাহিত্যিকদের সম্পর্কে কমলকুমারের ধারণা অত্যন্ত খারাপ ছিল। তিনি তাঁদের পাশ্চাত্যমুখিতাকে এবং বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে অজ্ঞতাকে বিচিত্র স্থানে সমালোচনা করেছেন। ত্রিশের কবি বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে বলছেন, ‘ঘটনা বলি, একদিন কয়েক বছর পূর্বে ইন্দ্রনাথের দোকানে বসিয়া আছি হঠাৎ আমাদের সে প্রশ্ন করিল, “কাহার কাহার মহাভারত ইংরেজিতে আছে?” আমরা কহিলাম, “কেন? কোন ... মেটে ফিরিঙ্গি”, এটুকু বলিতেই সে নিম্নকণ্ঠে কহিল, “অমুকের লোক দাঁড়াইয়া আছে”, এবং মাস কয়েক পর শুনিলাম তিনি মনোজ্ঞ মহাভারত কথা লিখিতেছেন। এরূপ আমাদের দেশীয় পাণ্ডিত্য। আমরা বুঝতে পারি, এ মনোজ্ঞ মহাভারত কথার লেখক বুদ্ধদেব বসু। বুদ্ধদেব বসু কমলকুমারকে তাঁর বই উপহার দিলে সে বই কমলকুমার টেবিলের নড়াচড়া বন্ধ করার জন্য পায়ার নিচে রাখার কথা বলেছেন। বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদকে বলেছেন উড়ি অনুবাদ এবং শাটুলকে দিয়ে মদ্যশালায় এ আবৃত্তি সবাইকে শোনাবেন বলেছেন। অথচ বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে ‘রেখো মা দাসেরে মনে’ শিরোনামে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন। এ প্রবন্ধ যখন প্রেসে ছাপা হয়, তখন প্রেসে প্রুফ দেখতে গিয়ে বলেছেন, এ লেখাটি বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে, লেখার কোথাও যেন ভ্রান্তি না থাকে।

কমলকুমার অন্যের নিন্দা-মন্দ করতেন বটে, কিন্তু অপরের মুখে সেই ব্যক্তির নিন্দা সহ্য করতে পারতেন না। একবার কেউ একজন তাঁর সামনে নিন্দা করলে বলেছিলেন, ‘ওর নামে নিন্দে করবেন না মশাই। ওর নামে পেঁপেগাছের নীচে দাঁড়িয়ে নিন্দে করলে, পেঁপেটি পর্যন্ত তেতো হয়ে যাবে!’

বামুনের ছেলে
বাংলাদেশের কবি বেলাল চৌধুরী ছিলেন কমলের অন্যতম সহচর। একদিন কলকাতার খালাসিটোলা থেকে সুরাপান করে তাঁরা দুজন উঠেছেন ট্রামে। ট্রামের কন্ডাক্টর একসময় ভাড়া চাইল। জামার পকেটে কোনো টাকা রাখতেন না কমল। আর জামা বলতে তিনি সব সময় পরতেন পাঞ্জাবি। তা–ও নতুন পাঞ্জাবি কেনার পর প্রথমেই তাতে পানের পিক লাগিয়ে ময়লা করে তারপর পরতেন। কিন্তু ওটার পকেটে কখনো টাকা রাখতেন না। তাঁর হাতে সব সময় থাকত একটি চটের থলে। টাকা–পয়সা—সব রাখতেন সে থলের ভেতরে রাখা কোনো দুর্লভ গ্রন্থের পাতার মধ্যে। ট্রামের ভাড়া চাওয়ার পর স্বভাবতই টাকা খুঁজে বের করতে সময় লাগল। এ নিয়ে কন্ডাক্টরের বাঁকা কথায় তার সঙ্গে ঝগড়া লেগে গেল কমলকুমারের। একপর্যায়ে কন্ডাক্টরকে ধুম করে নাক বরাবর ঘুসি বসিয়ে দিলেন তিনি। বেধে গেল বিরাট হট্টগোল। বিষয়টি পুলিশ পর্যন্ত গড়াল। পুলিশ কমল ও বেলাল চৌধুরীকে থানায় নিয়ে লকআপে ভরে রাখল। রাত হয়ে এলে কমলকুমার থানার কর্তাকে ডেকে বললেন, ‘বাবু, আমি বামুনের ছেলে। আপনি আমাকে যে থানায় আটকে রেখেছেন, এতে আপনার পাপ হবে। আপনি ওটিকে রেখে আমাকে ছেড়ে দিন।’ থানার কর্তা কী মনে করে তাই করলেন। বাসায় গিয়ে যখন স্ত্রী দয়াময়ী মজুমদারকে ঘটনাটি বললেন কমল, তখন নিজের ভাইকে নিয়ে বেলাল চৌধুরীকে ছাড়াতে থানায় এলেন দয়াময়ী। এ সময় বেলালকে দেখে খানিকটা বিস্মিত হন তিনি। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে কমলকুমারকে তিনি এই বলে ভর্ৎসনা করেছিলেন যে, ‘একটা দুধের বাচ্চাকে মদ খাইয়ে থানায় রেখে এসেছ।’

লেখক হিসেবে তিনি যেমন বড় ছিলেন, একইভাবে ভেতরে–ভেতরে কমলকুমার মজুমদার ছিলেন শিশুর মতো সরল। শেষ বয়সে বারবার বলতেন, ‘মা, আমায় শিশু করে রেখো।’

মৃত্যুশয্যায় নিঃসন্তান কমলকুমারকে ভিজিয়ে ফেলা বিছানার স্থানটুকু থেকে সরাতে গেলে স্ত্রী দয়াময়ীকে অস্ফুট স্বরে বলেছিলেন, ‘আমি তো শিশুত্বই লাভ করেছি।’