বহুমাত্রিক মানবিক রবিদা

রবিউল হুসাইনের সেই ‘কংক্রিট পোয়েট্রি’। এটি প্রকাশিত হয়েছিল এনামুল করিম নির্ঝর সম্পাদিত হুবহু নামের একটি প্রকাশনায়।
রবিউল হুসাইনের সেই ‘কংক্রিট পোয়েট্রি’। এটি প্রকাশিত হয়েছিল এনামুল করিম নির্ঝর সম্পাদিত হুবহু নামের একটি প্রকাশনায়।

আশির দশকের শুরুতে মফস্বল শহরের শিল্পমনস্ক তরুণ ঢাকায় এসে ছায়া খুঁজলে রবিদা ছিলেন একমাত্র ভরসা। সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, চাকরি, অর্থ, লেখা—যেটাই লাগুক, মায়াপূর্ণ অভিভাবক বলতে আমরা রবিদাকেই চিনতাম। রবিদা মানে রবিউল হুসাইন (৩১ জানুয়ারি ১৯৪৩—২৬ নভেম্বর ১৯১৯), স্থপতি, কবি ও প্রগতিশীল সংস্কৃতিকর্মী। সে সময়টায় গ্রিন রোডে তাঁর অফিসটা ছিল আমাদের আবদার আর সমস্যা সমাধানের গন্তব্য। বিশেষত তখন স্থপতি সমাজের সঙ্গে দেশের সাংস্কৃতিক অন্যান্য মাধ্যমের যোগসূত্রের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন রবিউল হুসাইন। দেশবরেণ্য কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার, ভাবুক—সবার সঙ্গে অদ্ভুত হৃদ্যতার সম্পর্ক তাঁর। এমন মানবিক গুণের মানুষ, যাঁর স্বচ্ছ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি স্বাধীন চিত্তের শিল্পচর্চা, সরল ব্যবহার এবং নির্মোহ জীবন যাপনই ছিল ব্যক্তিত্ব। এ দেশের স্থাপত্যগুরু মাজহারুল ইসলাম স্থপতি হিসেবে আন্ত-শিল্পচর্চার সংযোগ এবং জাতীয় ক্ষেত্রের স্থাপত্য সিদ্ধান্তে আন্তরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার যে ধারা শুরু করেছিলেন, রবিউল হুসাইন সেটাকে পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে যুক্ত করে আজকের জায়গায় আনতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।

এমনকি শিল্পচর্চায় বিভিন্ন প্রজন্মের সংযুক্তিতে পরম্পরার ধারা প্রক্রিয়ায় তাঁর সমর্থন ছিল সব সময় সক্রিয়। একটা সময় ছিল, যখন ঢাকা শহরের যেকোনো তরুণ শিল্পীর চিত্রপ্রদর্শনী হলে তার ভূমিকা বা আলোচনা লিখে রবিদা ওই শিল্পীকে নিজের অনুপ্রেরণা দিতেন শত ব্যস্ততার মধ্যেও। নব্বই দশকের শুরুতে ছাত্রত্ব শেষ করে যখন মধ্যবিত্তপাড়ায় আর্ট গ্যালারি করার ভূত মাথায় চাপে আমার, তখন প্রথম রবিদাকেই বলি। রবিদা সহজে না বলেন না। একটা ছোট ঘরে নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে শুরু করেছিলাম যোজন সমকালীন চিত্রশালা। যে সময় অভিভাবক হিসেবে যখন যা দরকার, একমাত্র ভরসা ছিলেন রবিদা। কত তরুণ শিল্পীর প্রথম প্রদর্শনী হয়েছে সেখানে, উৎসাহ, পরামর্শ, উদ্বোধক, অতিথি ব্যবস্থাপনায় রবিদা ছাড়া আর উপায় কী?

সবচেয়ে জরুরি যে বিষয়টা তা হলো, নিজস্ব ঐত্যিহের ভেতরে থেকে, কীভাবে প্রথাবিরোধী ভাবনা, শিল্প-সাহিত্য করা যায়, এই চর্চাটাই সে সময়ে মোটামুটি প্রশ্নবিদ্ধ, তখন রবিদার কাছে গিয়ে, তরুণ বয়সে, যেকোনো চিন্তা, কাজ, ভাবনা বলা যেত নিঃসংকোচে। তিনি সব সময় বলতেন, শিল্পচর্চায় সাহস সবচেয়ে বড় বিষয়। সাহস ছাড়া চিন্তা খুলবে না। সেই সঙ্গে দরকার ভিন্ন ভিন্ন শিল্পমাধ্যমের প্রতি কৌতূহল। কীভাবে অনান্য শিল্পের নানান ধারা স্থাপত্যচর্চায় বিবেচনা বোধকে জাগ্রত করে, এই বিষয়ে উৎসাহ দিতেন সবাইকে। স্থাপত্য, লেখালেখি ও অন্যান্য মাধ্যমে তাঁর কাজের পরিধি ছিল বিস্তৃত। কিন্তু কখনোই ঢাকঢোল পিটিয়ে সেটা বলার মানুষ ছিলেন না রবিদা। তাঁর বিনয়ী ব্যবহার সবার জন্য যেমন শেখার বিষয়, তেমনি তাঁর কাজ, ভাবনা ও কর্মকাণ্ডের প্রভাব বিষয় হলো আলোচনার। নিয়মিত স্থাপত্য পেশাচর্চা ও অন্যান্য সৃজনশীল কর্ম সফলভাবে পাশাপাশি সক্রিয় রেখে ও সম্পূর্ণ অভিযোগহীন থেকে বিভিন্ন জাতীয় সংগঠনের নেতৃত্বে সম্পৃক্ত হয়েছেন হাসিমুখে—সেটাই তাঁর নান্দনিক ব্যবস্থাপনা।

এমন মানসিকতা তাঁর অনুজদের ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে এবং ভবিষতেও করবে হয়তোবা। কিন্তু রবিদার শিল্পকর্ম আজকের তরুণদের কাছে অনেকটাই অপরিচিত। আমরা যে সময় কেবল চলচ্চিত্র সংসদকর্মী, তখন একদিন রবিদা তাঁর চিত্রনাট্য পড়ে শোনালেন, যেটা মুহাম্মদ খসরু সম্পাদিত ধ্রুপদী পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। ওই সময়ে এমন পরীক্ষামূলক প্রথাবিরোধী ভাবনার অগ্রজ হিসেবে তিনি ছিলেন আমাদের অনুপ্রেরণা। রবিদার আরেকটা কাজ—যেটাকে তিনি বলতেন ‘কংক্রিট পোয়েট্রি’—যেটা নিয়ে প্রদর্শনী করার কথা হবে হবে করেও হলো না। আশির দশকে আমার সম্পাদিত হুবহু নামের প্রকাশনায় সেটার একটা নমুনা দিলাম এখানে। এটা ছিল তাঁর আরেকটা নিরীক্ষাধর্মী কাজ। এই কাজগুলো সংগঠিত করে প্রকাশনা–প্রদর্শনীটাই এখন জরুরি কাজ। আমাদের মতো আজকের তরুণেরাও তা চিনুক–জানুক।

রবিউল হুসাইন, রবিদা—এই মানুষটাকে নিয়ে কথা বলতে গেলে আবেগটাই সামনে চলে আসবে। কারণ, অনুজ স্থপতি হিসেবে তাঁর ছোঁয়া শুধু কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শোধ করা কঠিন।