কেউ কথা রেখেছিল

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কম্পিউটারের স্ক্রিনটা সমস্যা করছে কদিন ধরে। কেমন যেন আলো কমে আসছে। সারাতে দিতে হবে দ্রুতই। কবে না জানি হুট করে নিভে যায়।

এই মুহূর্তে খুব অপরিচিত একজন কাউকে খুঁজছি আমি। এমন কেউ, যে খুব দূরের। তার সঙ্গে আমাদের এই জীবনে দেখা হবে না, কোনো দিন না। সার্চ অপশনে গিয়ে ইংরেজি বর্ণমালা জেড লিখলাম। উল্টো দিক দিয়েই শুরু করা যাক...

এক.
‘ভাই, আপনি কি আমায় চেনেন?’

আজহারুল ইসলাম নামের একটা আইডি থেকে মেসেজটা এসেছে। আমি ক্লিক করে তার আইডিতে গিয়ে দু-তিনটে ছবি পেলাম। সেগুলো দেখলাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। নাহ্‌, একে আমি চিনি না। চেনার কোনো কারণও নেই। নাকের পাশের আঁচিলটা দেখে সামান্য যা চেনা চেনা মনে হচ্ছিল, কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও অমন কাউকে ঠিকঠাক মনে করতে পারলাম না। আজহারুল ইসলাম নামের দু–একজন আমার চেনা আছে অবশ্য, ইনি তাদের কেউ নন। কেন যেন আমার সন্দেহ হলো, আইডিটা ফেক। খুব বেশি তথ্য দেখছি না।

একটু বাজিয়ে দেখার জন্যই আমি লিখলাম, ‘আপনি কি সাংবাদিক আজহার ভাই?’

‘না।’ ওপাশ থেকে জবাব এল।

‘তাহলে? ডাক্তার আজহার ভাই?’

‘না।’

‘তাহলে?’

ওপাশ থেকে টাইপ হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। বেশ সময় নিয়ে জবাব পেলাম, ‘ভাই, আমার মনে হয় না আপনি আমায় চিনবেন। আমি নিজেও আপনাকে চিনি না।’

‘তাহলে? আমায় মেসেজ দিয়েছেন কেন?’

আবার দীর্ঘক্ষণ পর মেসেজ আসে। ‘আমি একজন দুঃখী মানুষ। আমার খুব দুঃখ। আপনাকে বলতে চাই সেসব কথা।’

‘কী অদ্ভুত! আপনি আমায় চেনেন না, অথচ আমাকেই আপনার দুঃখের কথা বলতে চান?’

‘হ্যাঁ। চিনি না দেখেই আপনাকে বলতে চাই।’

মেসেঞ্জারে দেখতে পাচ্ছি ‘আজহারুল ইসলাম ইজ টাইপিং...।’

আমি বের হয়ে যাই ফেসবুক থেকে। ওষুধ খেতে হবে। কী বিদঘুটে নামের ডিপ্রেশন কমানোর একটা ওষুধ দিয়েছে ডাক্তার, খেতে ভুলে গিয়েছিলাম। কই রেখেছি, তা–ও মনে নেই।

ফেসবুকে মেসেজ চেক করতে গেলে মূল মেসেজের পাশে ‘মেসেজ রিকোয়েস্টস’ বলতে একটা জায়গা আছে, সে এক রহস্যময় জগৎ। অদ্ভুত অদ্ভুত সব মেসেজ এসে জমে থাকে সেখানে। আমার বন্ধু আতিক আমায় দিয়েছিল এই রহস্যময় কুঠুরির খোঁজ। যারা আমার ফেসবুকের বন্ধু নয়, কস্মিনকালেও যাদের সঙ্গে আমার মেসেজ চালাচালি হয়নি, তাদের পাঠানো সব মেসেজ এসে জমে থাকে এই বক্সে। আতিক প্রথম যখন বলে, আমি অবাকই হয়েছিলাম। রাতে বাসায় এসে ভালো করে লক্ষ করতে দেখি, সত্যিই এমন একটা অপশন ঘাপটি মেরে আছে দূরের গ্রামের কোনো এক আকাশের মতো গাঢ় নীল বক্সের এক পাশে। আশ্চর্য, এত এত দিন যাবৎ খেয়াল করিনি বিষয়টি!

সেই রহস্যময় ঘরে ক্লিক করে দেখি, ৭৮টি মেসেজ জমে আছে। এত দিন ধরে, অথচ আমি সেটা জানতামই না। কী আশ্চর্য! আস্তে আস্তে মেসেজগুলো চেক করতে থাকি। বেশির ভাগই ‘হাই’, ‘হ্যালো’, ‘বন্ধু হতে চাই’—এসব লেখা। স্ক্রল করে করে নামতে থাকি এবং হাইয়ের জবাবে হ্যালো আর হ্যালোর জবাবে হাই লিখে উত্তর দিতে থাকি। দু–একটা পেলাম, যেগুলো পঞ্চাশ-এক শ জনকে ফরওয়ার্ড করলে সুসংবাদ পাওয়া যাবে, না করলে দুঃসংবাদ...মানুষ আশ্চর্য প্রাণী। কী সব অদ্ভুত বস্তুতে মজে থাকে।

আম্মা মারা গেছেন দুমাস আগে, আমার স্ত্রী আমায় ছেড়ে চলে গেছে, ডিভোর্স লেটার চলে এসেছে, চাকরি নেই—এরপর আর কী দুঃখের সংবাদ আসতে পারে!

‘টিরিট’ করে একটা শব্দ এল—আজহারুল ইসলাম সাহেবের মেসেজ। টাইপিং শেষ হয়েছে এতক্ষণে। পাগল লোক। মানুষ কতটা ননসেন্স হলে অপরিচিত একজন মানুষকে তার ‘খুব দুঃখের’ গল্প শোনাতে আসে, আমার জানা নেই!

দুই.
চাকরিটা নেই দুমাস হয়ে গেল। জমানো টাকা ভাঙছি এখন। আরও মাসখানেক চলতে পারব। এর মধ্যে একটা চাকরি জোটাতেই হবে।

একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় ছিলাম। মোটামুটি ধরনের চাকরি আমার। ব্যয় কমাতে হবে, এই ছুতোয় একটা বড় ছাঁটাইপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে অফিস, সে প্রক্রিয়ায় অফিস ছুড়ে ফেলে দিয়েছে আমাকে। ফলে দুমাস ধরে বাসায় বসা।

বছরখানেক ধরে আমার আর মুনিয়ার বনছিল না একদম। মুনিয়া আমার স্ত্রী ছিল। ছিল বলার কারণ এই নয় যে মুনিয়া আর বেঁচে নেই, আসলে সে আমায় ছেড়ে চলে গেছে। যাওয়ার আগে একটা চিরকুট রেখে গেছে শুধু, সেখানে লেখা, ‘কথা দিলাম, তোমার দুঃখ কমিয়ে দেব আমি।’ কীভাবে কমিয়ে দেবে, মুনিয়াই জানে। আমি শুধু জানি, মুনিয়া কথা দিলে কথা রাখে। অদ্ভুত অদ্ভুত প্রক্রিয়া সে জানে। নিজে না বললে সেসব রহস্য ভাঙার কেউ নেই এ পৃথিবীতে।

আমাদের বাচ্চাকাচ্চা হচ্ছিল না। বিয়ে হয়েছে সাড়ে তিন বছর। সামনের অক্টোবরে চারে পড়ত। প্রথম বছর বাচ্চাকাচ্চা নিতে চাইনি দুজনের কেউই। দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকীতে সিদ্ধান্ত নিলাম, এবার বাচ্চা নেওয়া যায়। আম্মা খুব ঝামেলা করছিলেন। প্রথম দিকে আড়েঠারে বলতেন, পরে সরাসরি বলতে শুরু করলেন, ‘বাচ্চা নে, বাচ্চা নে, বাচ্চা নে...’

আমরা কেউই গা করিনি। মাত্র বিয়ে হলো। এর মধ্যে কিসের বাচ্চা? আগে কটা দিন খরগোশের মতো ছুটে বেড়াই দুজন। পরে যখন ক্লান্ত মনে হবে নিজেদের, তখন একটা ঘুম দিয়ে উঠে কচ্ছপের মতো ধীরে ধীরে চলব। তখন নাহয় আমাদের সমস্ত চিন্তাভাবনা হবে ভবিষ্যৎকেন্দ্রিক। কিছুদিন অন্তত বর্তমানটিকে উপভোগ করি। সত্যি কথা বলতে, আম্মা আমাদের কান ঝালাপালা করে দিচ্ছিলেন। বিয়ের দুবছর পূর্ণ হওয়ার সামান্য বাকি থাকতে থাকতে আব্বা আমাকে একদিন ডেকে সরাসরি বললেন, ‘এবার একটা বাচ্চা নে। এত দিন দেরি করতে নেই। সমস্যা হয় কিন্তু পরে।’

আব্বার সঙ্গে আমার সম্পর্কে একটা শিথিলতা আছে শৈশব থেকেই। বড় রাশভারী মানুষ আব্বা। আগে খুব মারতেন আমায়। ইন্টারমিডিয়েটে ওঠার পরও একবার ঘুম থেকে উঠতে দশটা বেজেছিল দেখে খুব পিটিয়েছিলেন।

অবশ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে উল্টোও হতে পারে ব্যাপারটা। আব্বার আর আমার সম্পর্কটা হয়তো খুব দৃঢ় ছিল। অতিরিক্ত দার্ঢ্য যেমন বস্তুকে কঠোর করে তোলে, বেঁধে ফেলে, আমাদের মধ্যেও তেমন একটা কাঠিন্য ছিল। আব্বা আমায় ঠিক সেই কথাগুলোই বলেন, যেগুলোতে আমার না করা উচিত নয়। কিংবা আব্বার কোনো কথাকে আমি না করার মতো মনে করি না। ফলে আব্বার বলার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আমি মুনিয়াকে বলি, ‘চলো, এবার বাচ্চা নিয়ে নিই একটা।’

মুনিয়া না করে না। আব্বা আর আমার সম্পর্কটাকে সে সমীহ করে। আব্বাকে সে বোধ হয় ভয়ও পায় কিছুটা।

আব্বার মৃত্যুটা ছিল আকস্মিক। আমাদের দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকীর মাস চারেক পরপর একদিন রাত এগারোটায় ওষুধ কিনতে নিচে নেমেছিলেন আব্বা। কারা ছুরি মেরে ফেলে যায়। সাদা জামা পরে বের হওয়া আব্বার পকেটে মোবাইল ফোন, ওয়ালেট—সবই ঠিকঠাক ছিল, শুধু জামার পেছনটা ঈর্ষণীয় রকমের লাল হয়ে আছে।

আব্বার মৃত্যুটা রহস্যই থেকে গেল একরকম। পুলিশ যে চেষ্টা করেনি, তা নয়, তাদের আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতি ছিল না, কিন্তু অপরাধী একজনও ধরা পড়েনি।

এর মাস চারেক পর মুনিয়ার সঙ্গে বড় ঝগড়া লাগল আম্মার; ডিম ভাজার মতো তুচ্ছ একটি বিষয় নিয়ে। মুনিয়ার মেজাজ সারাক্ষণ খিটমিটে হয়ে থাকত কিছুদিন ধরে। এত চেষ্টা করছিলাম একটা বাচ্চা নেওয়ার জন্য। কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। পিরিয়ড অনিয়মিত ওর। ফলে একটু ডেট পেছালেই মুনিয়া ভাবত ‘কনসিভ’ করেছে। আমাকে ফোন দিয়ে বলে, ‘আজ আসার সময় একটা প্রেগন্যান্সি কিট নিয়ে এসো।’ কিট এনে দেখা যেত রেজাল্ট নেগেটিভ।

মুনিয়া বলে, ‘কী সব কম দামি জিনিস কিনে আনো তুমি, ভালো না। কাল আসার সময় ভালো একটা কিনে নিয়ে আসবে।’

আমি বিরক্ত হয়ে বলি, ‘এটাই ভালো।’

মুনিয়া খেপে যায়, ‘ঘোড়ার ডিমের ভালো! তুমি নিয়ে এসো।’

আমি বিরক্ত হয়ে পরদিন নানা ধরনের, নানা কোম্পানির অনেকগুলো কিট কিনে নিয়ে আসি। বলি, ‘এবার মনভরে টেস্ট করো। প্রস্রাব রাখার জন্য যে পাত্র, সেটা একটু পরিষ্কার কোরো। ড্রপারটাও টেস্ট কোরো। আমার মনে হয় ওগুলোর কোনোটাতেই ঘাপলা আছে। আর একটু ভোর ভোর থাকতে উঠে টেস্ট কোরো। তুমি তো দশটার আগে ঘুম থেকে উঠতেই পারো না!’

সে রাতেই ব্লিডিং হয় মুনিয়ার। সারা রাত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে সে। আর পরদিনই আম্মার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হয় তার। কার দোষ ছিল কে জানে! আম্মা আমার দুলাভাইয়ের বাসায় গিয়ে ওঠেন।

তিন.
নতুন একটা চাকরিতে জয়েন করেছি। এটাও বিজ্ঞাপনী সংস্থা। আগেরটার চেয়ে স্যালারি দেড় গুণ। আমার ভাগ্য ভালো। সাধারণত একটা চাকরি থাকা অবস্থায় কোথাও চাকরির অ্যাপ্লাই করলে দেড়-দুই গুণ বেশি স্যালারি অফার করে। কিন্তু চাকরি না থাকলে? তখন অর্ধেকও বলে না কেউ। জানে যে এই লোক দুরবস্থায় আছে। একে যা অফার করা হবে, লুফে নেবে। সেখানে এরা নিজেরাই আমাকে বলল দেড় গুণ বেশি বেতনের কথা। রাজি না হয়ে উপায় কী!

বাসায় এসে ফেসবুক ওপেন করলাম। কদিন ঢুকিনি ফেসবুকে একদম। ঢুকে দেখি কয়েকটা মাত্র মেসেজ জমে আছে। এর মধ্যে আজহার সাহেবও আছেন। এখন আর মেসেজ রিকোয়েস্ট চেক করতে হয় না তাঁর জন্য। যেহেতু আগে আনসার করেছি, তাঁর মেসেজ নিয়মিত বক্সেই এসে জমে। ওপেন করলাম। দেখি সব একই ধরনের মেসেজ। ‘ভাই’, ‘ভাই কি রাগ করলেন’—এসব।

নতুন করে আবার মেসেজ এল বক্সে। ‘ভাই, আমার দুঃখের কথা শুনবেন না?’

বিরক্ত এবং আশ্চর্য—দুটিই হলাম। এই লোক কি আমার অপেক্ষাতেই বসে ছিল? উদ্দেশ্য কী এর? আমাকে টার্গেট করেনি তো আবার? শুনেছি এমন অনেক চক্র আছে—ফাঁদে ফেলে টাকাপয়সা হাতিয়ে নেয়। সতর্ক হয়ে যেতে হবে এখন থেকে।

আমি একরাশ বিরক্তি নিয়ে লিখলাম, ‘বলেন...’।

এরপর রান্নাঘরে চলে গেলাম। এক কাপ কফি খেতে হবে। মাথা ধরে আছে। আমার বন্ধু তাবির ব্রাজিলে থাকে। গত মাসে দেশে আসার আগে প্যাকেট প্যাকেট ব্রাজিলিয়ান কফি নিয়ে এসেছে সে বন্ধুদের জন্য। আমিও দুপ্যাকেট পেয়েছি। এখন যখন–তখন কফি খাই। খুব বাজে স্বাদ, কিন্তু একরকম নেশা ধরিয়ে দিয়েছে জিনিসটা।

আজহার সাহেবের মেসেজ লেখার যে গতি দেখলাম, তাতে দুঃখের কথা লিখতে ভালো সময়ই লাগার কথা। হয়তো চাইলে ভাতও রেঁধে ফেলতে পারব।

মাড় গালতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলি। পেস্টটা টিপেটুপে শেষ করে হাতে লাগাই, তা–ও জ্বলুনি কমে না। এসে দেখি মেসেজ পাঠিয়েছেন আজহার সাহেব। বিশাল মেসেজ। এই মেসেজ তো এত অল্প সময়ে লিখতে পারার কথা নয় এনার। আমি নিশ্চিত আগেই লেখা ছিল, স্রেফ কপি-পেস্ট করেছেন। তার মানে এভাবে তিনি অন্য অনেককেই দুঃখের কথা বলে বেড়ান।

মেসেজের ভাষা দেখে মনে হয় রাস্তার ক্যানভাসার।

‘ভাই, আমি আজহারুল ইসলাম। আমার অনেক দুঃখ। অনেক মানে অ...নে...ক। কিন্তু এমন একটা অবস্থা যাচ্ছে আমার যে সে দুঃখ পরিচিত কারও সঙ্গে শেয়ারও করতে পারছি না। দিন দিন টের পাচ্ছি, আমি পাগল হয়ে যাব। কিংবা হয়তো পাগল হয়ে গেছিও। ফলে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার দুঃখের কথা কাউকে বলব। এমন কাউকে, যে আমাকে চেনে না। আমরা থাকব দূরের কোনো শহরে, কোনো দিন আমাদের দেখাসাক্ষাৎ হবে না।

‘ভাই, জানেন, আমার আর আমার স্ত্রীর প্রথম সমস্যা হয় সন্তান হওয়া নিয়ে। ছোট্ট সংসার আমাদের। কোনো অভাব নেই। স্রেফ সন্তান না হওয়ার দুঃখ। সমস্যাটা আমার স্ত্রীরই। আমি আলাদা ডাক্তারের কাছে গেছি, ডাক্তার বলেছে যে আমি সম্পূর্ণ ঠিক আছি। সুতরাং বুঝতে বাকি নেই যে সমস্যাটা কার। আমার স্ত্রী বারবার ডাক্তারের কাছে যেতে চাইছিল, আমি জানি যে ডাক্তারের কাছে গেলে সে আমাদের দুজনকেই টেস্ট করবে। এবং ধরে ফেলবে যে সমস্যাটা আসলে ওর। ফলে আমি গড়িমসি করতে লাগলাম। এতে যেটা হলো, ও ধরে নিল সমস্যা আমারই। সে কারণেই আমি ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাই না। ফলে ও একসময় ডাক্তারের কাছে যাওয়া নিয়ে পীড়াপীড়ি বাদ দিল একদম। আমাদের মিলন হচ্ছিল একধরনের অভ্যাসবশত। সেখানে সন্তান জন্মানোর সামান্য স্পৃহাও ছিল না। অথচ দেখা গেল কদিন পর ওর চেহারায় একটা আলাদা লাবণ্য ভর করেছে। এবার ওর পীড়াপীড়িতে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে বাধ্য হলাম। আমরা গ্রামে থাকি। আমি ইংরেজি পড়াই ওখানকার একটা স্কুলে। ভালো ডাক্তারের জন্য শহরে আসতে হয়। এলাম ওকে নিয়ে শহরে।

‘ও কনসিভড ছিল। বুঝতেই পারছেন আমাদের মনের অবস্থাটা তখন কী। পরের নয় মাস আমরা যেন স্বর্গে কাটালাম। ঠিক নয় মাস সতেরো দিনের মাথায় আমাদের বাচ্চা হলো। যমজ বাচ্চা। মাথা জোড়া দেওয়া। আঞ্চলিক পত্রিকাগুলোয় এসেছিল সে খবর। ফেসবুকেও কিছু ছবি এসেছে।

‘বাচ্চা দুটি মারা যায়। চিকিৎসা করানোর মতো অবস্থা ছিল না আমাদের। আমি নিতান্তই গরিব মানুষ। স্কুলে পড়িয়ে আর কত টাকা হয় বলেন!

‘আমার স্ত্রী পাগল হয়ে যায়। সম্ভবত আমিও।

‘আমার গল্প এটুকুই। একে-তাকে বলে বলে দুঃখ কমিয়ে বেড়াই আমি। বেশির ভাগ মানুষই বিশ্বাস করে না। পাগল ভাবে। তাতে কী, আমার দুঃখ তো কমে! ভালো থাকবেন।’

মেসেজটা পড়া শেষ হতেই দেখি আমি আর উত্তর দিতে পারছি না। আজহারুল ইসলাম আমাকে ব্লক করে রেখেছেন। কিংবা মেসেজ ব্লক করে রেখেছেন। কিছু একটা হবে। ফেসবুকে ‘আজহারুল ইসলাম...মাথা জোড়া দেওয়া যমজ’ ইত্যাদি লিখে সার্চ দিই; যা আসে, আজহার সাহেবের ঘটনার সঙ্গে তার খুব মিল নেই। অবশ্য প্রযুক্তি সম্পর্কে আমার জ্ঞান সীমিত। যেমন সীমিত সুখ।

আকস্মিক আমার মাথায় প্রশ্ন খেলে, আজহারুল ইসলাম নামে কি সত্যি সত্যি কেউ আছেন? অন্য কেউ করছে না তো এসব? করুক। পাগল হওয়ার আগে আগে আমিও আমার দুঃখের গল্প কাউকে শোনাব—একদম অপরিচিত অতিদূরের কাউকে।

কম্পিউটারের ম্লান স্ক্রিনের দিকে তাকাই। িস্ক্রনটা সমস্যা করছে কদিন ধরে। ঠান্ডা লাগছে খুব। জানালাটা লাগাতে হবে।

কোনো দিন নিভে যাবে না জেনেই সম্ভবত খুব ম্লান আর মলিন এক চাঁদ জ্বলছে দূরে।