ঔপনিবেশিক

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

আমাকে অনেক কিছু বলিয়ে নিয়েছ তুমি নানা উছিলায়

আমি তো আমার কথা বলতে পারিনি,

আমার ভালোবাসার কথা, সহসা হৃদয়–দরজায় কড়া নেড়ে

দুই গোছা ফুল রেখে পালানো মালিনী,

গন্ধ আর ছায়াসূত্র ধরে খুঁজেছি তাহারে উন্মাতাল দাবদাহে

ছাইভস্ম বেদনার বাগানে বাগান...

ভুলেছি তো অভাগা দূর্বার কথা, ধূলির বাকলে রেখে ঢেকে

পায়ের তলায় কত আঁকিবুঁকি দিয়েছে জীবনে, আমি তো বুঝি না কিছু,

এখনো সোনালি আলো পড়ে আছে আমারই আঁতুড়ঘরে,

উঁকি মেরে দেখে আসি জননীর ওমে শুয়ে আছি জন্মনাড়িডোরে,

বুঝি নাই দুনিয়ার আগামী সময়, রক্তের স্রোতের ’পরে

আশার নাগিনী দোল খায়, কবিতা কবিতা করে কথা বলি, শরমাই...

আমাকে বলিয়ে নিয়েছ তুমি আর তোমারই কথা

আমার ভাষা তো আজও কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে অদেখা ঋতুর শীতে,

কুয়াশায় ঢেকে আছে অর্থ ও অনর্থ সব, মুড়ি–মুড়কির মতো

এলোমেলো পড়ে আছে যতিচিহ্নগুলো

কত কাঁটা বিছায়ে দিয়েছ উচ্চারণপথে, আর শ্রুতি, সে–ও পলাতকা বাতাসের মতো

শাঁ শাঁ ফেলে যাচ্ছে দূরে, আমার কী গান আমি গেয়েছি জীবনে,

পড়ে রইল সুরের ফাগুন পরিচ্ছেদহীন, নাঙাভুখা গাছের জংলায়

যত আসে কোকিল-কোকিলা, তুমি না গুলতি ছুড়ে তাড়িয়েছ,

আমারই আঙুল চুপ করিয়ে রাখে ঠোঁট আমার, সজোর ঠেস দিয়ে

শোনে না আমার কথা, এখন ক্যামনে পিতা হব, কী করে সন্তানে আমি

এ আঙুল দেব ধরতে, কী করে সে যাবে পেরিয়ে ভয়–দুঃখ–ত্রাসের কর্কট

এখনো তবুও ওড়ে মেঘ, দারুণ দারুণ বজ্রপাত ছুড়ে দিচ্ছে কী অবলীলায়

এখনো পারিনি—অবধারিত অঙ্গারে নেমে পড়ি বাসনামণ্ডলে,

পোড়াতেও দিলে না নিজেরে

রেখেছে জড়িয়ে প্রেম ছিন্নমূল স্মৃতি থরথর কেঁপে ওঠা মাটির নাভিতে

বল্লম খুঁচিয়ে আনা দেহপর্শমণি, তড়াসে যে মরে, ফিরেও দ্যাখে না চরমপন্থীর দল,

কত গল্প জমে ছিল পরম নিদ্রার আঁখিপল্লবের নিচে...

আমি তো আমার চোখে তাকাতে পারি না আজও

অপর পলক এক নড়ে–চড়ে কর্ণিয়ার ভেতরে আমার,

যেদিকে তাকাতে যাই, সে তার উল্টো পথে টেনে নেয়, ভাবি আমি—

দেখব সারস, দেখি শুধু শিকারির হাতের ট্রিগার,

ভাবি, দেখি তার কপালের টিপ, দেহের ত্বকের ’পরে ফুটে ওঠে আগুনাভ চাঁদ

দেখি গুহা, অন্ধকার, শাবলে শাবলে ক্ষত মাংসপ্রাচী

আমারও শরীর নাই, তুমি আর তোমরাই চিনিয়েছ দেহ

বলো—হাত, মুখ, চোখ, বলো—ওই পৌরুষ তোমার

আমার মমতা হয়, নেড়েচেড়ে দেখি, অবিশ্বাস ঘৃণা তার করেছে রচনা

উত্থানের শ্রমণের যত ব্যাকরণ, আমার অনুভূতির যত পরশন

তোমাদের রুপালি পর্দায় মাখা রাঙা ইল্যুশনে নেতিয়ে থেকেছে,

এখনো লজ্জাবতীর মতো পরশকাতর

স্তনবৃন্তে একটি কুসুম, কয়েকটি পাপড়ি মেলাতে নিষ্ফল পূর্ণিমাগুলি

ঢুকে গেছে অপর-নারীর পরিহাসের আঁচলে,

আহা রে আমার ঘুম কই, নিশুতি মৌনের বুক চিরে বিনিদ্র ঝাঁঝালো তীর

ছুড়ে ছুড়ে রেখেছ জাগর, আসে ঝড়, ঘূর্ণি, উড়ন্ত সন্ন্যাস

বাস্তুভালোবাসার পিঞ্জরে ধড়ফড়ায়ে মরা পাখিটারে কে ওড়ায়ে নেবে

আমার ভেঙেছ পাখা তুমি, তোমরাই, ভেবেছি নিমেষে যাব অন্য অন্য দেশ—

মানুষের নতুন নতুন রূপের বাজারে হৃদয়–সওদা করে ঝুড়ি ভরে

পিঠে চেপে ঘুরি মুসাফির, কই, আল বেঁধে দিলে মানুষেরও

একটা একটা ভাগ আলগ আলগ বাঁধা পড়ে আলে আলে,

যত টুটিচাপা নিষেধের বাণী, আমি তার অর্থও বুঝি না

কেন না বধির আমি তারও আগে, তোমারই বোমার শব্দে মাটিতে লুটাই

কেন আজও সোনারং সরিষার ক্ষেতে পড়ে আছে বিকল কৈশোর

তোমরাই করেছ উন্মূল আমার জমিন থেকে, চাষের–বাসের ধর্ম থেকে!

চাষ নাই, আমার কী ধর্ম আছে আর,

ধর্ম আজ তোমাদের হাতের আধুলি, আমাদের ভাগ্য দেখো টস করে,

জিতে যাব কি না, জেতা মানে বেঁচে থাকা, বেঁচে ওঠা নয়,

যে শ্লোকে বেঁধেছ পৈতা, তা-ই মানি ফাঁসি, আমাকে একটিবার

আমার মতন করে বুঝতে দিলে না ঊষার আভাস, সূর্যের কেমন রেখা ধরে

শ্রুতিপথে ঘুরে ঘুরে ফেরে ইতিহাস, আহ!

নিদারুণ রক্তপাতে ফেটে গেছে আসমানের ছাতি...

উড়ে গেল আজানুলম্বিত কেশরাশি, অট্টালিকা থেকে নেমে এসেছিল

ভিখারি সে পথিকের পথ করে দিতে, কীভাবে ধরব কেশ,

তোমাদেরই তর্জনীর নাচ দেখে দেখে আঙুল অসাড়,

জোড় হাতে বৃক্ষের তলায় বসে থাকি, যেও না যেও না হাওয়া,

ফিসফিসিয়ে গুঞ্জরন তোলা আমার শত গল্পকথার পরিরা

তোমারি পিঠের ’পরে আবারও সওয়ার হবে, নিশিলণ্ঠনের কাচ ভেঙে

প্রকাশিবে সত্যের আগুন, পুড়ে যাবে অনর্থক সহি বাস্তবতা

আমি তো মিথ্যাই, তা–ও সই, আমারে দিও না তুমি তোমার নির্মিত সত্যদায়ভার

ভেঙে গেছে মেরুদাঁড়, মুছেছে পায়ের ছাপ, চোখে চোখে নাছোড় পিঁচুটি

যাবার কথা তো ছিল নভোনীলে, ব্র্রহ্মাণ্ডরাখাল এক

বাঁশি হাতে ডেকেছে গোপনে—‘এসো দেখে যাও, অনন্তের কাছে কত তুচ্ছ তুমি! ’

বড় হতে চাইব আমরা, অভিমানে জাতি-অভিমানে বিশাল ব্রহ্মাণ্ড হতে চাইব, যদিও

সত্য এক পরিহাস, তবু কচুরিপানার মতো কে চায় ভাসতে জলে, কে চায় শ্যাওলা হয়ে

উঠানের কোনায় কোনায় অবহেলা সয়ে থেকে যেতে,

স্বপ্নেরও কি পরিমাপ–আয়তন আছে, দুটো ছোট্ট জলপাইদানার মতো চোখে

ধরা পড়ে জাদুকল্প, না-দেখা, না-চেনা শত রং, রূপরেখাবলী

আছে কি উপায় বলো কাঠামোর ঘের ভেঙেচুরে

নিজেকে ভাসিয়ে দেব অন্তহীন নিশীথসলিলে, তরঙ্গিনীপারে...

আমাকে তো তোমরাই নিখাঁদ বাস্তবে বন্দী করে ভেঙে দিলে ডানা

কল্পনার ফুলকিগুলো দিয়েছ নিভিয়ে

হিমকন্যাদের যোনির ভেতরে ঘুম যায় শীতল ঔরস

আগামীর ব্যর্থ এক উত্তরাধিকার

আহা, তবু এক চুমুকে পান করে নেব বলে দাঁড়িয়েছি

জীবনের দ্রাক্ষাসমুদ্রের পাড়ে, ঠোঁটে আহা তোমারই খরার দাহ,

জিভের ডগাও নিয়ে গেছ কেটে, সম্মুখে রুপালি ঢেউয়ে নেচে আকাঙ্ক্ষাকুমারী

একে একে ফুঁসে উঠছে ঘৃণাজলোচ্ছ্বাসে,

আমাকে রেখেছ দাঁড় করে অলৌকিক চিত্রনাট্যপটে, বলো—গান করো, গান

আমার কী গান আছে আর, নাই

কথা নাই, দৃশ্য নাই—সুরও আজ অশ্রুতিপ্রবণ

তোমরাই আমাকে আমার থেকে খুবলে নিয়েছ ধীরে ধীরে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে,

কে করবে গান আর, কে বাসবে ভালো

আলেয়ার পশরা বিছানো পথে বেজে ওঠে অন্তরীণ আলো...