শাহনূর মামুনের জলাঙ্গন

‘শাঁখারিবাজার’, শিল্পী: শাহনূর মামুন
‘শাঁখারিবাজার’, শিল্পী: শাহনূর মামুন

আমাদের দেশে সাধারণত কেবল একটা মাধ্যমকে কেন্দ্র করে কোনো শিল্পী গড়ে ওঠেননি। একমাত্র শাহনূর মামুনই জলরংকে ছবি আঁকার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে চিত্রান্তর্গত করেছেন। শাস্ত্রে আছে, ভারতবর্ষের আলো তেলরঙের জন্য নয়। এ কারণে প্রথম থেকেই তিনি কি বুঝে ফেলেছিলেন ভাটির দেশের জলাঙ্গন? ‘জল’ শব্দটির সঙ্গে মামুনের যোগাযোগ এতটাই আত্মিক আর নিবিষ্ট যে তাঁর ছবিযাপনে যে সুর-ছন্দের মহিমা বিম্বিত হয়ে আছে, তাতে কেবল জলের শব্দই পাওয়া যায় যেন। ছবিভীরু এই শিল্পী তুলির অনুরণনে যে সৌকুমার্য ব্যাপৃত করেছেন, তার সর্বত্রই প্রকৃতিদেবীর গুণকীর্তনে ভরপুর। তাঁর চিত্রণে প্রকাশ পেয়েছে প্রকৃতির প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা।

মূলত রংনির্ভর ছবি আঁকেন মামুন। সাধারণত মানুষ অপটিক্যালি বস্তুর রং দেখে, তারপর গড়ন। আর তাঁর ছবিতে জল আর রঙের টলমলে প্লাবন আছে, যে প্লাবন সমস্ত চিত্রভূমি ডুবিয়ে দিয়েছে। তাঁর ছোট-বড় তুলিগুলো প্লাবনে স্বচ্ছন্দে ভেসে বেড়ায়। তাঁর ছবিতে অভব্যতার লেশমাত্র নেই; আছে শুধু রঙে প্রাণসঞ্চার বা প্রাণে রংসঞ্চার। আছে দেশাত্মবোধ, জাতিচেতনা, মা, মাটি, বিশ্বপ্রকৃতি প্রভৃতি।

বর্তমানে উত্তরার গ্যালারি কায়ায় চলছে ‘স্টোরিজ’ শিরোনামে শাহনূর মামুনের একক চিত্রপ্রদর্শনী। এতক্ষণ কথাগুলো বলা হলো সেই সূত্রেই।

ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীদের দ্বারা প্রভাবিত মামুন। তাঁর ছবির রং, আলো, তাৎক্ষণিক সময়কে ধরা, লোজ ব্রাসিং, আউটডোরে ছবি আঁকা প্রভৃতিতে সেই ঘরানার ছাপ স্পষ্ট। তাঁর ছবির আরেকটি ব্যাপার বিশেষভাবে লক্ষণীয়, ছবিতে উষ্ণ রঙের প্রাবল্য বেশি। হলুদ, লাল, কমলা—এসব উত্তেজক রঙের সরাসরি ব্যবহার শিল্পীদের হাতে সাধারণত এতটা নিয়ন্ত্রণে থাকে না। তবে মামুনের হাতে এই রংগুলো সমস্বরে অনুজ্ঞাপ্রাপ্ত হয়েছে।

চীন–জাপানের শিল্পীদের মতে জলরং হচ্ছে জাদুকরি রং। আর আমাদের দেশের শিল্পীরা বলেন, জলরং হলো কবিতার মতো, অনেকটা অসম্পূর্ণ কথা, বাকিটুকু বুঝে নিতে হয়। মামুনের ছবিও বুঝতে হবে কবিতা পড়ার অভিজ্ঞতা দিয়ে। তাঁর ছবিতে প্রকৃতির বা বিষয়ের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ বা অতিকথন নেই; শুধু রং, জল, উপমা, প্রতীক—কবিতার মতোই এসব বুঝে নেওয়ার ব্যাপার আছে। মামুনের জলাঙ্গন, ছবি আর কবিতার মেলবন্ধন বুঝে নিতে আপনিও আসতে পারেন এ প্রদর্শনীতে। ২২ নভেম্বর শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি চলবে আগামী ৬ ডিসেম্বর অবধি।