মুক্তিযুদ্ধের কবিতা

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

মহাদেব সাহা
আমি যখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি

আমি যখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি তখন তেরোশত নদী
গেয়ে ওঠে আমার সোনার বাংলা,
সহস্র পাখির কণ্ঠে জয় বাংলা ধ্বনিত হতে থাকে; 

আমি যখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি তখন সাতই মার্চ

জেগে ওঠে, 

শেখ মুজিব ঘোষণা করেন স্বাধীনতা। 

আমি যখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি তখন পর্ণকুটিরে

জ্বলে ওঠে আলোকশিখা, 

শহীদজননীর প্রাণ গর্বে ভরে ওঠে, চোখের জল মুছে ফেলে, 

তখন বাংলার সবুজ প্রান্তর শস্যে ভরে যায়, পদ্মায় চলে

ইলিশের ঝাঁক, 

তখন লক্ষ লক্ষ রক্তগোলাপ ফুটে ওঠে বাগানে, আকাশে হয় নতুন সূর্যোদয়, 

হৃদয়ে-হৃদয়ে জেগে ওঠে বাংলাদেশ, আমার সোনার বাংলা। 

মোহাম্মদ রফিক

অন্য জন্মে, আমিও কি? 

পড়ে ছিল চেরাগির মোড়ে, 

ঝোপেঝাড়ে, রাস্তার বাঁ ঢালে; 

পাশ কেটে চলে গেছি, তাই

বা অনুহ্য প্রশ্ন, যুগান্তরে; 

এমন তো কিছুই ছিল না, 

জাঁক করে বলি, বলা যায়; 

বাতাসে বারুদ, হাঁসফাঁস, 

মর্টারের শেল, অবিশ্রাম; 

অন্ধকারে, চাটগাঁ স্টেশন, 

ছেঁড়া, একখণ্ড হাত, দে দে; 

কে কে, তীক্ষ্ণ বৈদ্যুতিক হা হা, 

পাঁজরের, এ-পিঠ ও-পিঠ; 

নিস্তব্ধতা, বেয়নেট ফলা, 

জলচ্ছল, স্রোতের ধিক্কার; 

ভোর হবে, কাকে বা দেখাই, 

যে মুখ পুড়েছে অগ্নিদহে! 

মিনার মনসুর

মুক্তি

তার স্পর্ধা দেখে সূর্যও ভ্রু-কুঞ্চিত করে। 

অতলান্তিকের ক্রুদ্ধ জলরাশি তাকে শাসায়। কুয়াশার কাফনে আপাদমস্তক মুড়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে যিনি ঝুলে আছেন জল-স্থল আর অন্তরিক্ষজুড়ে তার ভৌতিক নীরবতার ভাষাও কম ভয়ংকর নয়। কত নিরীহ-দর্শন এই খাঁচা, অথচ কী বিশাল তার সৈন্যসামন্ত! কী প্রচণ্ড তার দাপট। 

তবু ইকারুস শূন্যে ভাসিয়ে দেয় তার মোমনির্মিত দুই ডানা। ঘুরপাক খায় সূর্যদেবের ক্ষুধার্ত অগ্নিরথ ঘিরে। সহস্রবর্ষী খাঁচা রুদ্ধশ্বাসে তাকে দেখে। নিজের চোখকেও বিশ্বাস হয় না তার। 

হা করে আছে তেরশত লেলিহান আগুনের নদী। জল-স্থল আর অন্তরিক্ষজুড়ে মহাপরাক্রান্ত সূর্যের ক্রোধ। তবু ইকারুস উড়ছে।

রিফাত চৌধুরী

মেথিকান্দা মেমোরিয়াল সেভেন্টি ওয়ান

মেথিকান্দা মেমোরিয়াল

দ্য অ্যাটাক অব সেভেন্টি ওয়ান

দ্য ডার্ক ভিলেজ

তরঙ্গে ভেসে আসে অবিরাম

খবরের লাল চোখ, ধ্বংসের হাতছানি—

সময়ের ধোলাইখানায়

রক্তাভ তরমুজ সময়

সাবানের ফেনার মতো বৃদ্ধি পায়

স্বাধীনতার গর্জনের মাঝে

ছুটছে আমার কালো কৈশোর,

যুদ্ধের গন্ধ শোঁকে আমার আক্রান্ত শৈশব।

বুকে বসে মাংস ঠোকরাচ্ছে কাক।

মেথিকান্দা মেমোরিয়াল সেভেন্টি ওয়ান।

তারিক সুজাত

শূন্যদৃষ্টি জননীর চোখ

এইমাত্র যে দৃশ্যমান

পর মুহূর্তে সে নেই! 

একটি মাছরাঙা

ঠোঁটে তুলে নিচ্ছে

বর্ণিল একটি মাছ—

জলের মাছও একদিন

আকাশে ওড়ে! 

সময় কাউকে তৈরি করে

হাতে তুলে দিয়ে কালের কলম

আবার কারও হাতে

তুলে দেয়

দু-ধারী ধারালো ছুরি, 

কাউকে বানায় নেতা, 

কেউ ক্রীতদাস, 

কেউবা গুপ্তচরের প্রতিনিধি। 

বিদ্যাপীঠগুলোতে

দেওয়া হলো আগুন দিনদুপুরে

ঝলমলে মাছভর্তি পুকুরে

ঢেলে দেওয়া হলো প্রাণনাশক ডিডিটি

আর

বোধিবৃক্ষের শিকড়ে চুন! 

আ ম রা—একে অপরকে

ঘৃণা করাকেই ভাবলাম

শক্তির প্রকৃত পরিচয়! 

এইমাত্র যে আছি

পরমুহূর্তে সে নেই

যে আমি অতীতে ছিলাম

আগামীর কোনো এক প্রত্যুষে

তার হাতেও কোদাল দিয়ে

বলা হলো, 

খোঁড়ো, কবর খোঁড়ো

তুমি নিজ হাতে

সাড়ে তিন হাত নিচে

নামিয়ে দাও

তোমারই নির্মাণের ইতিহাস। 

দেবালয় পুড়ছে, পুড়ছে...

চক্ষুষ্মান একটি প্রজন্ম

কার পাপে অন্ধ হলো? 

দিনের প্রখর আলোয়ও

নিজেকে সে দেখছে না! 

বধ্যভূমির ঘাসে ঘাসে

কারাগারের দেয়ালে দেয়ালে

জয় বাংলা প্রতিধ্বনি...

যশোর রোড ধরে হেঁটে চলা ক্লান্ত পা

সল্টলেকের বৃত্তাকার পাইপের গহ্বরে

শূন্যদৃষ্টি জননীর চোখ

মুজিবনগর থেকে ট্রাফেলগার স্কয়ার

আগরতলা থেকে আর্জেন্টিনা

মুছে যাচ্ছে সীমান্তের সকল সীমানা

হে পিতা

শত ঝঞ্ঝা, ঝড় ও তুফানে

কবির কলম

আর

শিল্পীর তুলি

তবু জেগে থাকে অভিমানে।

কামরুজ্জামান কামু 

ডিসেম্বর একটা তর্কাতীত মাস

উৎসর্গ: শাহরিয়ার জামিল খান প্রিয়বরেষু

আহা ডিসেম্বর! একটা তর্কাতীত মাস! 

মুক্তিযুদ্ধের কবিতা লিখতে হবে কেননা

ডিসেম্বর একটা অর্থপূর্ণ মাস। 

কেননা এই মাসে ধু-ধু আকাশের নিচে

বধ্যভূমিগুলো চিৎকার করতে থাকে

মানুষ ও শিয়ালের সম্মিলিত কণ্ঠে—

কান্নার রোল পড়ে যায় ধরণিতে—

বিরাট একটা রক্তমাখা লাল সূর্য

আগুনের গোলার মতো দিগন্ত পুড়িয়ে 

লকলক করে উঠে যায় আকাশে—

মধ্যরাতে যে আকাশে চাঁদ ওঠে—

মধ্যরাতে যে পৃথিবী কম্পিত হয়—

মধ্যরাতে যে জননী ডুকরে কেঁদে ওঠে—

তার ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল

ফিরে আসেনি। 

তাই ডিসেম্বরে আমাকে কবিতা লিখতে হবে

—বিষাদ বিদীর্ণ বায়ু সুগম্ভীর চূর্ণিত নিনাদ

কেননা পৃথিবীতে ডিসেম্বর একটা শব্দ

যা শুধু গোঙানির ধ্বনি হয়ে

ধেয়ে চলে, মা

শাহীন মোমতাজ

ইতিহাস

পরিত্যক্ত খাদ্যগুদামের পাশে 

ভোরবেলা ঘন কুয়াশার পর্দা ভেদ করে 

সবুজ ঘাসের মধ্যে পড়ে থাকা লাল গোলাপের মতো 

তোমার রক্তাক্ত দেহ খুঁজে পাই, 

পিছমোড়া, মৃত আর আধখোলা চোখে তুমি 

চেয়ে আছ দিগন্তের দিকে, 

কোনো এক অচেনা গ্রামের চিরপরিচিত শান্তিময়তার দিকে, 

পাশ ফিরে। 

তোমার একাগ্র দৃষ্টি আর সেই দিগন্তের মাঝখানে নতুন চরের মতো জেগে উঠছে 

বাংলাদেশের নামপরিচয়, বংশলতিকা। 

তারপর একদিন সেই দেশে আমাদের ঘুরেফিরে জন্ম নিতে আসা।

জাকির জাফরান

হারানো দিনের স্টেনগান

ডিসেম্বর এলেই আগুন জ্বলে চোখে

আগ্নেয়াস্ত্র টের পাই নিজের শিথানে, 

বুকেতেও আগুন জ্বলে যখনই দেখি

ছদ্মবেশে ডাকু বসা আমারই বিতানে। 

অগ্নিঝরা চোখ জোড়া দেখো খুঁজে ফেরে

হারানো দিনের সেই সব স্টেনগান, 

তীব্র চিৎকারে জেগে ওঠে আজ সেই

স্নায়ুর ভেতরে জমে থাকা অভিমান। 

যুদ্ধ শেষেও যুদ্ধ থাকে, যেমন কান্নার

পরেও থাকে রোদনের অনিঃশেষ বাণ, 

ছদ্মবেশে হন্তারক ঘোরে-ফেরে আজ

ফিরে চাই হারানো দিনের স্টেনগান।