তবুও কাগজের বুকে ছবি এঁকে রাখব

সমুদ্র গুপ্তের একটা কবিতা আছে—

আমি বললাম ফুল, তুমি বললে ফুল সে তো কাগজের।

আমি বললাম, তবুও তো ফুল।

লোকটা তো কাগজ দিয়ে বন্দুক বানাতে পারত।

কাগজ দিয়ে আমরা কত কিছু করি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাসও আছে—কাগজের বউ। কাগজের বউ কথাটা কিন্তু ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। মানে বউটা কাগজের তৈরি নয়। রক্তমাংসের তৈরি। কিন্তু তার হৃদয়টা অন্য কোথাও অন্য কোনো ঘাটে বাঁধা। সে শুধু কাগজে-কলমেই বউ।

প্রথম আলোর দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে িশল্পী ঢালী আল মামুন ও ওয়াকিলুর রহমানের যৌথ স্থাপনািশল্প প্রদর্শনী ‘কাগজের ছায়ায়’, ২০০৯
প্রথম আলোর দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে িশল্পী ঢালী আল মামুন ও ওয়াকিলুর রহমানের যৌথ স্থাপনািশল্প প্রদর্শনী ‘কাগজের ছায়ায়’, ২০০৯

চিরটা কাল কাগজ আমাদের হৃদয়ের কথা বলে এসেছে। আমাদের হৃদয়ের কথা ধারণ করে এসেছে। রবীন্দ্রনাথ যে কথা বলেছিলেন লাইব্রেরি সম্পর্কে—‘মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে। ইহারা সহসা যদি বিদ্রোহী হইয়া উঠে, নিস্তব্ধতা ভাঙিয়া ফেলে, অক্ষরের বেড়া দগ্ধ করিয়া একেবারে বাহির হইয়া আসে! হিমালয়ের মাথার উপরে কঠিন বরফের মধ্যে যেমন কত কত বন্যা বাঁধা আছে, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে মানবহৃদয়ের বন্যাকে বাঁধিয়া রাখিয়াছে!’

মানুষ আলতামিরা গুহায় ছবি এঁকেছে। পাথরের বুকে তার দুষ্পাঠ্য শিলালিপি, এখনো হাজার বছর পরে পাঠোদ্ধারের চেষ্টা চলছে। মানুষ ভূর্জপত্রে লিখেছে, চামড়ায় লিখেছে। অশোকের বাণীগুলো পাথরে খোদাই করে রাখা হয়েছে, যা এখনো মানুষকে শান্তির সন্ধান দিচ্ছে।

কিন্তু কাগজই সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে যুগান্তকারী আবিষ্কার, যেমন মানুষের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার আগুন। যেমন মানুষের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার চাকা। মানুষ যা কিছু ভেবেছে, জ্ঞানের কথা, বিজ্ঞানের কথা, ভালোবাসার কথা, তার আইনকানুন, শাস্ত্র; তার গণিত, হিসাব-নিকাশ, দলিল-দস্তাবেজ—সবই তো শেষ পর্যন্ত আশ্রয় পেয়েছে কাগজে। আমাদের ধর্মগ্রন্থগুলো অবশেষে আমরা কাগজেই পেয়েছি।

যদিও আমাদের উপন্যাসের বয়স তিন–চার শ বছরের বেশি নয়, কিন্তু আমাদের মহাকাব্যগুলো—হোমারের ইলিয়াড, ওডিসি কিংবা রামায়ণ, মহাভারত সবই হাজার বছরের পুরোনো। ছাপাখানার উদ্ভাবন আরেক বিপ্লব। তার আগে মানুষ কথা বলত গদ্যে কিন্তু লিখত কবিতায়। কারণ, তা মানুষের মুখে মুখে ফিরত। ছাপাখানা উদ্ভাবিত হওয়ার পর মানুষ উপন্যাস লিখতে শুরু করল।

শিল্পবিপ্লব ঘটল, যন্ত্রবিপ্লব ঘটল, বিদ্যুৎ এল, ইলেকট্রনিক যন্ত্র রেডিও-টেলিভিশন এল, এল চলচ্চিত্র। কিন্তু এখনো রয়ে গেছে কাগজ। রয়ে গেছে কলম, রয়ে গেছে ছাপা পত্রিকা এবং বই। রয়ে গেছে চিঠিতে মনের কথা প্রকাশ করার প্রীতিপূর্ণ ঐতিহ্য। প্রেমিকা এখনো তার প্রেমিককে বলে, তুমি আমাকে ই–মেইল কোরো না, টেক্সট কোরো না, হাতে একটা চিঠি লিখো। আমরা একটা ইলেকট্রনিক বই পেলে খুশি হই না, কিন্তু একটা বই যেটা ছাপার অক্ষরে লেখা, কাগজে বাঁধাই করা; সে এক অপূর্ব গন্ধ, সেটা হাতে পেলে খুশি হই।

সেই যে কৌতুক আছে, এক লোক বলল, আমি এমন একজনকে বিয়ে করতে চাই, যে আমাকে বিনোদন দেবে, জ্ঞান দেবে এবং সব সময় আমার কথা শুনবে। আমি যখনই তাকে কথা বলতে বলব, সে বলবে এবং যখনই তাকে থামতে বলব, সে থামবে।

তাকে বলা হলো, তুমি কোনো নারীকে বিয়ে করো না, তুমি বিয়ে করো  টেলিভিশনকে। সেভাবে বলা যায়, ইলেকট্রনিক গ্যাজেট আমাদের সব দিতে পারবে, কিন্তু যা দিতে পারবে না, তা হচ্ছে মানবিক স্পর্শ। মায়ের শাড়ি থেকে একটা গন্ধ আসে। স্ত্রীর সামান্য স্পর্শ আমাদের মনকে আগুন থেকে পানিতে পরিণত করতে পারে। তেমনিভাবে যখন আমরা একটা কাগজের বই বা পত্রিকা হাতে নিই; যা পাই তা কোনোভাবেই পেতে পারি না অন্য কিছুতে। ই–বই পড়া আর টেলিভিশনকে বিয়ে করা একই কথা। ভালোবাসতে চাইলে রক্তমাংসের মানুষ লাগবে। আর বই পড়তে চাইলে সত্যিকারের বই লাগবে।

যদিও আমরা জানি না, প্রযুক্তি কত দ্রুত বদলে যাবে। কাগজের বই আর কত দিন বেঁচে থাকবে। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে কাগজের বই টিকে থাকবে। আমরা আমাদের ভালোবাসার কথা কবিতায় লিখব, চিঠিতে লিখব আর তা পৌঁছে দেব আমাদের প্রিয়জনদের কাছে। বোতলের মধ্যে মনের কথা একটা কাগজে লিখে ভাসিয়ে দেব সমুদ্রের জলে। বই থাকবে না, কাগজ থাকবে না—এই পৃথিবী আমরা কল্পনাও করতে পারছি না।

মান্না দে গান গেয়েছেন, ‘যদি কাগজে লেখো নাম কাগজ ছিঁড়ে যাবে,/ পাথরে লেখো নাম পাথর ক্ষয়ে যাবে,/ হৃদয়ে লেখো নাম সে নাম রয়ে যাবে...।’ কাগজ থাকবে কি না জানি না, হৃদয় থাকবে, হৃদয়ের কথা থাকবে। আপাতত সেই হৃদয়ের কথা আমরা কাগজে লিখে রাখি। 

আমরা কথায় কথায় বলি, কাগজ ঠিক আছে তো! প্রবাসীরা বৈধ বা অবৈধভাবে যখন বিদেশে আসেন, বলেন কাগজ হয়ে গেছে। দুজন নারী–পুরুষ মিসরে গেলে হোটেলের রুমে থাকতে হলে হয়তো তাদের কাগজ দেখাতে হয়। কাগজ মূল্যবান। অন্তত ১০০ ডলারের একটা কাগজ তো সাড়ে ৮ হাজার টাকার সমান মূল্যবান। কিন্তু দ্রুতই সবকিছু ‘ই’ হয়ে যাচ্ছে। ই–মেইল, ই–টাকা। আর যাই হোক ই–হৃদয়, ই–বউ, ই–ফিমেল হবে না। ই–মেইল বানান তো আলাদা। এই মেইল মানে পুরুষ নয়।

আমরা কাগজকে ভালোবাসি, কাগজের পত্রিকা এবং বই ভালোবাসি। কিন্তু শুধু ভালোবাসা দিয়ে কাগজকে ৫০ বছর পরেও ধরে রাখতে পারব—এই গ্যারান্টি আমি দিতে পারব না।

তবুও কাগজের বুকে ছবি এঁকে রাখব। জলরঙে আঁকা সে ছবি।

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক এবং প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক