যেতে নাহি দিব

নাশতার টেবিলে এক কাপ চা এবং সংবাদপত্র পাঠ, অনেকেরই প্রতিদিনের অভ্যাস। ছবি: ছুটির দিনে
নাশতার টেবিলে এক কাপ চা এবং সংবাদপত্র পাঠ, অনেকেরই প্রতিদিনের অভ্যাস। ছবি: ছুটির দিনে

গণমাধ্যম বর্তমান সময়ে যে দ্রুত রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, ইতিহাসে বিশ্বব্যাপী এমন রূপান্তরের ঘটনা এর আগে কোনো ক্ষেত্রে ঘটেছে কি না, বলা কঠিন। বরং বলা যায়, নীরবে ঘটলেও এই ‘বিপ্লব’ বোধ করি সব বিপ্লবের বাড়বাড়ন্ত। 

নাশতার টেবিলে ধূমায়িত চায়ের সঙ্গে দিনের কাগজটি পড়া হবে না, এমন ‘নিষ্ঠুর’ দিনের আগমনের বার্তা প্রচার করে ‘বিশ্বগ্রাম’ ধারণার প্রবর্তক ম্যাকলুহান সাহেব বেশ কিছুদিন আগেই ইহলোক ছেড়েছেন। তাঁর জীবিতকালেই আমরা, কাগুজে সংবাদপত্রের একনিষ্ঠ প্রেমিকেরা ঘোর বিতর্কে মেতেছিলাম লোকটির মতবাদ নিয়ে। এই ‘পাগলাটে’ পণ্ডিত বলে কিনা কাগজের সংবাদপত্র টিকবে না, একদিন তা বিলুপ্ত হয়ে যাবে! কাগজ (পড়ুন সংবাদপত্র) আমাদের অনেকেরই নিত্যসঙ্গী, আমাদের অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আমাদের ভালোবাসা। এমন সঙ্গী হারালে আমাদের অবস্থা কী দাঁড়াবে? অনেকেই বলেছেন, এমন কথা ভাবলে বুকের ভেতর বড় কষ্ট হয়।

এ প্রসঙ্গে একদিনের অভিজ্ঞতা বলি। বেশ অন্তরঙ্গ পরিবেশে অনুষ্ঠিত এক ঘরোয়া সভায় এক মধ্যবয়স্ক স্মার্ট নারী, যিনি সমাজে খুবই পরিচিত, ম্যাকলুহানের সংবাদপত্রের অস্তিত্ব বিলীন হওয়াবিষয়ক মতামতকে পাত্তাই দিলেন না। পূর্ণ বিশ্বাসের দৃঢ়তায় তিনি বললেন, কাগজের সংবাদপত্র কখনো বিলুপ্ত হতে পারে না। বললেন বটে, কিন্তু তাঁর চোখে-মুখে বিষাদের ছায়া সভার অন্যদের দৃষ্টি এড়াল না।

পরিবর্তন সব ক্ষেত্রেই

মুহূর্তে মুহূর্তে এখন বদলে যাচ্ছে গণমাধ্যমের অবয়ব। গণমাধ্যম সম্পর্কে যেসব কথা সদ্য জেনে আপ্লুত হচ্ছি, আগামীকাল বা পরশুই তা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক অতীত ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে। আজকের ইন্টারনেটের দুনিয়ায় এই বিষয়টি যেমন ঘটছে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে, ততটা দ্রুত না হলেও এই পরিবর্তন আসছে আমাদের প্রিয় কাগুজে সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও। সংবাদপত্র বিলুপ্ত হওয়ার নয়, এই বিশ্বাসের পক্ষে কিছুদিন আগেও কিছু ‘অকাট্য’ প্রমাণ হাজির করতে আমরা চেষ্টা চালিয়েছি। সেই সব প্রমাণের বিশ্বাসযোগ্যতা এখনো পুরোটা হারিয়ে যায়নি। 

ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রায় অপ্রতিরোধ্য চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও মুদ্রণ মাধ্যমের ইতিবাচক দিকগুলোর অন্বেষণ করতে গিয়ে আমরা বলেছি, মুদ্রণ মাধ্যম সহজেই সংরক্ষণযোগ্য, এর তাৎক্ষণিক ক্রয়মূল্য কম, এটা যখন খুশি পড়া যায়, এটা পড়ার সময় পাঠক মাধ্যমের সঙ্গে দৈহিক সংযোগ ঘটে, পাঠকের সঙ্গে এর সংযোগটা একান্তই ব্যক্তিগত, এর আধেয়র গ্রহণ-বর্জনের ক্ষেত্রে পাঠক সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং সবচেয়ে বড় কথা, আমরা এটাকে হারাতে চাই না। এই প্রেম ‘নিকষিত হেম’। জোর গলায় বলতে ইচ্ছা হয়, তাকে আমরা ‘যেতে নাহি দিব’। 

এখানে সংবাদপত্র ছাড়াও বইপুস্তকসহ নানা দরকারি মুদ্রিত কাগজপত্রের প্রসঙ্গও এসে যায়। এক একটির প্রয়োজন ও আকর্ষণ একেক রকম। সংবাদপত্র বিলুপ্ত হলে কি সবাই সব ধরনের মুদ্রিত কাগজপত্র পড়া ছেড়ে দেবে? বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে অতি সংক্ষেপে এর উত্তর, না, তা হতেই পারে না।

কৌতূহল ও অভ্যাস

গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা বলেন, পাঠক-শ্রোতা-দর্শকেরা গণমাধ্যমের প্রতি আকর্ষণবোধ করেন প্রধানত দুটি কারণে। সেই দুটি হচ্ছে কৌতূহল ও অভ্যাস। কৌতূহল মানুষের প্রায় জন্মগত, শিশুরা দারুণ কৌতূহলী, নতুন কিছু জানার জন্য বয়স্কদের কৌতূহলী হওয়াটাও স্বাভাবিক। গণমাধ্যম আবার কখনো কখনো মানুষের মধ্যে নতুন কৌতূহলের সৃষ্টিও করে। ফলে ক্রমে ক্রমে গণমাধ্যমের প্রতি আকর্ষণ অভ্যাসে রূপান্তরিত হয়। আর কে না জানে যে মানুষ অভ্যাসের দাস। যখন ইলেকট্রনিক মাধ্যম ছিল না, শিক্ষিতদের মধ্যে সে সময়ই গড়ে উঠতে থাকে সংবাদপত্র পড়ার অভ্যাস। দীর্ঘস্থায়ী এই অভ্যাস কখন যেন নিজেদেরই অজান্তে পাঠকদের জীবনেরই অংশ হয়ে যায়। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, এটা একধরনের আসক্তি। হয়তো তাই। তবে এটা নিশ্চিতই একটি শিক্ষামূলক ইতিবাচক আসক্তি।

এরপর এমনকি সংবাদপত্রের জন্মের আগেও মানুষ নানা ধরনের আসক্তিতে অভ্যস্ত হয়েছে। আধুনিক পৃথিবীতে আসক্তির সীমা নেই। মানুষ কোনো কোনো আসক্তিকে ক্ষতিকর ভেবে তা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা চালিয়েছে এবং এখনো চালাচ্ছে। কিছু মারাত্মক আসক্তির কথা বাদ দিলেও গণমাধ্যমের ক্ষেত্রেও ইন্টারনেটে আসক্তি এখন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু প্রকৃত সংবাদপত্রের প্রতি মানুষের আসক্তির নেতিবাচক দিক নেই বললেই চলে। ভালো জনপ্রিয় সংবাদপত্র পাঠ ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। তবে স্বীকার করতেই হবে, ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ও আছে এবং সেগুলো পাঠ থেকে বিরত থাকাই মঙ্গলকর। সেগুলো আসলে সংবাদপত্র পদবাচ্যই নয়।

তবু নতুন পাঠক

সংবাদপত্রজগতের সর্বশেষ অবস্থা হলো, উন্নত দেশগুলোতে হালে সংবাদপত্র অনেকটাই পাঠকের আকর্ষণ হারাচ্ছে। সেই সব দেশে অনেক নামকরা বড় সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক কাগজের সংবাদপত্র কেবল অনলাইনে টিকে আছে। কিন্তু উন্নয়নশীল এমনকি মধ্য আয়ের দেশগুলোর ক্ষেত্রেও চিত্রটি খানিকটা আলাদা। এই দেশগুলোতেও অনলাইন মাধ্যমের জনপ্রিয়তা বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে নতুন সংবাদপত্র প্রকাশের ঘটনাও নেহাত কম নয়। সংবাদপত্রের দীর্ঘদিনের পাঠকেরা তাঁদের এই বিশ্বস্ত বন্ধুকে একেবারে ছেড়ে যায়নি। তবে এটা ঠিক যে যুগের হাওয়া বুঝে বড় বড় সংবাদপত্র অনলাইন সংস্করণ চালু করেছে। একই সঙ্গে কাগজের সংবাদপত্র ক্রমশই তাদের রূপ পাল্টাচ্ছে। একদিকে সংবাদপত্র যেমন প্রধানত ইলেকট্রনিক মিডিয়ার চ্যালেঞ্জের মুখে আগের চেয়ে অনেক রঙিন হচ্ছে, তেমনি সংবাদপত্রের আধেয়রও পরিবর্তন হচ্ছে। সংবাদ হিসেবে গণ্য ঘটনার বিবরণ ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের কাছে, খেলাধুলাসহ অনেক ঘটনাই সরাসরি দেখানো হচ্ছে টিভিতে, ফলে পরের দিন প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলো দিতে বাধ্য হচ্ছে সেই ঘটনারই ব্যাখ্যা কিংবা বিশ্লেষণ। আবার সংবাদপত্র এই মুহূর্তে আলোচনায় নেই, তেমন বিষয় নিয়েও ব্যাখ্যামূলক কিংবা অনুসন্ধানমূলক সংবাদ প্রকাশ অথবা ফিচার তৈরি করছে। বেশ কিছু পাঠক অবশ্য এই প্রক্রিয়া পছন্দই করছেন এবং তাঁদের সংখ্যা বাড়ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি নতুন পাঠক সৃষ্টিতেও সহায়ক হচ্ছে। 

বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে কোনো ক্ষেত্রে অন্য মাধ্যমে ইতিমধ্যে খবরটি জেনেছেন বিধায় সংবাদপত্রে ফিচারই বেশি মাত্রায় পড়ছেন। উন্নয়নশীল, এমনকি মধ্য আয়ের দেশগুলোতে তাই বলা যায়, সংবাদপত্র বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা পাঠকের মধ্যেও সম্ভবত অপেক্ষাকৃত কম। নতুন সম্ভার নিয়ে সংবাদপত্রের আপাত সাফল্যও একেবারে উপেক্ষণীয় নয়। এ ব্যাপারে শেষ কথা বলার সময় এখনো না এলেও অন্যভাবে বলা যায় যে বাণিজ্যিক দুনিয়ায় নতুন পণ্য বাজারে এলেই পুরোনো পণ্য বিলীন হয়ে যায় না, তেমনি গণমাধ্যমে উন্নত নতুন প্রক্রিয়া এলেও হয়তো তার কারণেই সংবাদপত্র একেবারে বিলীন হয়ে যাবে না। 

আমরা কি এখন পুরোনো দিনের গান শুনতে ভালোবাসি না? সংগীতজগতে অবিস্মরণীয় পরিবর্তনও প্রকৃত বোদ্ধার কাছে পুরোনো গানের স্বাদ নষ্ট করছে বলা যাবে না। এভাবেই আমরা আশায় বুক বাঁধতে পারি। তাই হয়তো এও আশা করতে পারি যে ম্যাকলুহানের ভবিষ্যদ্বাণী পুরোটা না-ও ফলতে পারে। সংবাদপত্র পাঠকেরা আবার তাঁদের জীবনে সেই পুরোনো সাথিকে অন্তরঙ্গভাবে ফিরে পেতে পারেন। বর্তমানের আপাত ‘বিরহ’ থেকে তেমন ‘মিলন’ কি একেবারেই অসম্ভব?

বিশ্বাসযোগ্যতাই সংবাদপত্রের মেরুদণ্ড

বলা হয়ে থাকে, মুখের কথার চেয়ে মুদ্রিত বাণী অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য। বর্তমানের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই (সোশ্যাল মিডিয়া) অধিকাংশ ‘ব্রেকিং নিউজ’ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একাংশ তাতে সত্য-মিথ্যা গুলিয়ে ফেলছে। কেউ কেবল অর্ধ সত্য দিয়ে সৃষ্টি করছে বিভ্রান্তি। অথচ বিশ্বাসযোগ্যতাই হচ্ছে প্রকৃত গণমাধ্যমের মেরুদণ্ড। আশা করা যায়, কাগুজে সংবাদপত্রের কাছেই হয়তো ফিরে আসবেন পাঠকেরা প্রকৃত ঘটনা জানতে।

আমি সংবাদপত্রের পাঠক। সংবাদপত্র ভালোবাসি। তাই যদি আমার কথাগুলো কিছুটা একপেশে হয়ে থাকে, তবে পাঠকদের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাইছি। সজীব সংবাদপত্র বজায় রাখার জন্য এই মাধ্যমের পরিচালকেরা আন্তরিক প্রচেষ্টা চালালে এবং পরিবর্তনের এই ধারায় সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে আশা করি সেই আগের মতোই কাগুজে সংবাদপত্র আমাদের প্রাতরাশের টেবিলেই থাকবে এবং ধূমায়িত চায়ের সঙ্গে সংবাদপত্র পাঠের অনির্বচনীয় আনন্দ থেকে আমরা বঞ্চিত হব না।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অনারারি প্রফেসর